তিন কারণে নাম বদলে ফেলল তুরস্ক

প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের কাছে নতুন নাম তুর্কি জাতির সংস্কৃতি, সভ্যতা ও মূল্যবোধ প্রকাশের সবচেয়ে ভালো উপায়
ছবি: রয়টার্স

ইংরেজিতে তুর্কি (টার্কি) জাতির নাম নিতেই বড়সড় একটি পাখির কথা আসে। উত্তর আমেরিকার থ্যাংকসগিভিং উৎসবের প্রতীক এই টার্কি পাখি। একটি জাতির প্রাচুর্য এবং জনগণকে তা প্রদানের সামর্থ্যের প্রতীক হিসেবে এই উৎসবে পাখিটি খাওয়া হয়। গত বৃহস্পতিবার তুরস্কের নতুন নাম তুর্কিয়ের (টার্কিয়ে) স্বীকৃতি দিয়েছে জাতিসংঘ। উৎসবের ভোজের পাখির সঙ্গে মিলে যাওয়া ছাড়াও আরও দুই কারণে তুরস্ক দেশটির নাম পরিবর্তন করেছে বলে মনে করছে সিএনএন।

দেশের নাম পরিবর্তনের বিষয়ে তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলিত সাভাসগলু বলেছেন, এটি আমাদের দেশের ‘ব্র্যান্ড ভ্যালু’ তথা মর্যাদাপূর্ণ পরিচিতি বাড়াবে।

ইস্তাম্বুলভিত্তিক চিন্তক প্রতিষ্ঠান ইডিএএমের চেয়ারম্যান সিনান উলগেন বলেন, ‘পাখির নাম থেকে আলাদা করাই তুরস্কের নাম পরিবর্তনের মূল কারণ। এ ছাড়া কথ্যভাষায় ব্যর্থতা বোঝাতেও এই শব্দটি ব্যবহার হয়ে থাকে।’

আগামী বছরের নির্বাচনে আবারও লড়বেন প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান। তাঁর কাছে নতুন নাম ‘তুর্কি জাতির সংস্কৃতি, সভ্যতা ও মূল্যবোধ প্রকাশের সবচেয়ে ভালো উপায়’।

তুরস্কের রাজধানী ইস্তাম্বুলের একটি দর্শনীয় স্থান
ছবি: রয়টার্স

আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলো এখন থেকে নতুন নাম ব্যবহারে বাধ্য। কিন্তু একেবারে গণমানুষের পর্যায়ে তেমনটি রাতারাতি ঘটবে না। সিএনএনকে উলগেন বলেন, ‘আন্তর্জাতিকভাবে গণমানুষের পর্যায়ে টার্কি থেকে টার্কিয়ে ব্যবহারে অভ্যস্ত হতে অনেক বছর লাগতে পারে।’ তিনি বলেন, এই প্রথম তুরস্ক নাম পরিবর্তনের চেষ্টা করেছে বিষয়টি তেমন নয়। ১৯৮০–এর দশকে প্রধানমন্ত্রী তুরগুত ওজালের সময়ও নাম পরিবর্তনের একই প্রচেষ্টা চালানো হয়। তবে বিষয়টি তখন ততটুকু আগ্রহ তৈরি করতে পারেনি।

জনতুষ্টিবাদ ও নির্বাচন

অর্থনৈতিক সংকটে ভুগতে থাকা তুর্কিরা আগামী বছরের জুনে নির্বাচনে যাচ্ছেন। নাম পরিবর্তনের পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যও থাকতে পারে। চিন্তক প্রতিষ্ঠান কার্নেগি ইউরোপের জ্যেষ্ঠ প্রোগ্রাম ম্যানেজার ফ্রান্সেসকো সিকার্ডি বলেন, ‘তুরস্কের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ বছরটিতে জাতীয়তাবাদী ভোটারদের কাছে পৌঁছাতে তুরস্কের সরকারের প্রয়োগ করা এটি আরেকটি কৌশল।’ তিনি বলেন, আগামী বছরের ভোটের আগে নাম পরিবর্তনের এই সময়টি ‘গুরুত্বপূর্ণ’। নাম পরিবর্তনের সিদ্ধান্তের ঘোষণা দেওয়া হয় গত বছরের ডিসেম্বরে। ওই সময় সব মতামত জরিপে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান পিছিয়ে পড়ছিলেন। গত ২০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক অর্থনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল দেশটি।

কয়েক বছর ধরে জনসমর্থনে উল্লেখযোগ্যভাবে এরদোয়ানের অবস্থান নিম্নমুখী। রয়টার্সের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের শেষের দিকে ক্ষমতাসীন একে পার্টির সমর্থন ছিল ৩১-৩৩ শতাংশ। অথচ ২০১৮ সালের পার্লামেন্ট নির্বাচনে দলটি ভোট পেয়েছিল ৪২ দশমিক ৬ শতাংশ।

অবশ্য উলগেন বলছেন, নির্বাচন-পূর্ব ধাপ্পাবাজির চেয়ে দেশের আন্তর্জাতিক অবস্থান বাড়ানোর জন্য নাম পরিবর্তন একটি রিব্র্যান্ডিং কৌশল।

রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, আগের বছরের তুলনায় এপ্রিলে তুরস্কের বৈদেশিক বাণিজ্যের ঘাটতি বেড়ে ৯৮ দশমিক ৫ শতাংশে গিয়ে ঠেকেছে, যার পরিমাণ ৬ দশমিক ১১ বিলিয়ন ডলার। বার্ষিক মূল্যস্ফীতি ৭৩ দশমিক ৫ শতাংশ গিয়ে দাঁড়িয়েছে. যা গত ২২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, সংকটের এ সময়ে অভ্যন্তরীণ সমস্যা থেকে দৃষ্টি সরাতে প্রেসিডেন্ট জনতুষ্টিবাদী পদক্ষেপ সামনে আনার দিকে ঝুঁকছেন। অর্থনৈতিক টালমাটাল অবস্থা ইতিমধ্যে জনগণকে রাজপথে নিয়ে এসেছে, যা সরকারের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সিকার্ডি বলেন, নতুন নাম আরও বেশি সুনির্দিষ্ট ও কঠিন সমস্যা থেকে জনগণের নজর সরিয়ে দেবে। একই সঙ্গে শক্তিশালী ও ঐতিহ্যবাহী তুরস্ক ইস্যুতে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানকে আরেকটি যুক্তি ব্যবহারের সুযোগ করে দেবে।

এ ধরনের আরেকটি জনতুষ্টিবাদী পদক্ষেপের অংশ হিসেবে ২০২০ সালে ইস্তাম্বুলের ঐতিহাসিক বাইজেন্টাইন আয়া সোফিয়া জাদুঘরকে মসজিদে রূপান্তর করেন এরদোয়ান।

আরও পড়ুন

রাজনৈতিক বিশ্লেষক সেরেন করকমাজ বলেন, ‘দেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সমস্যা মোকাবিলায় সুনির্দিষ্ট নীতি গ্রহণ করতে না পেরে, জনতুষ্টিবাদী জাতীয়তাবাদের রাজনীতিতে সমাধান খুঁজছেন এরদোয়ান। তিনি তুরস্কের জাতীয়তাবাদী ও ইসলামি রাজনীতিকে শক্তিশালী করছেন এবং বিরোধী নেতাদের লক্ষ্যবস্তু করছেন।’

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসস্তূপ থেকে নতুন জাতি হিসেবে জন্ম নেওয়ার পর ১৯২৩ সালে গ্রহণ করা নামটি পরিবর্তনের প্রতীকী মূল্য আছে। সিকার্ডি বলেন, বৈশ্বিকভাবে নামটির ব্যবহার ইতিহাসে তুর্কি প্রজাতন্ত্রের জাতির জনক মুস্তফা কামাল আতাতুর্কের পাশে এরদোয়ানের অবস্থানকে পোক্ত করবে।