নাভালনি এগিয়ে, পুতিন কোথায়?

রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও তাঁর রাজনৈতিক বিরোধী অ্যালেক্সি নাভালনি
ছবি: এএফপি ও রয়টার্স

রাশিয়ায় বিরোধী রাজনীতিক হিসেবে অনেক দিন ধরেই একটি নামই আলোচনায় আছে। তা হলো অ্যালেক্সি নাভালনি। মাঝখানে তাঁকে বিষপ্রয়োগে হত্যার চেষ্টাও হয়েছে। কিন্তু দেশে ফিরেই আবার জাতীয় আলোচনার তুঙ্গে নাভালনি। এগিয়ে যাচ্ছেন রাজনৈতিকভাবে। আর তাতে কপালে ভাঁজ বাড়ছে প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের।

জার্মানি থেকে গত জানুয়ারিতে দেশে ফেরার পরপরই গ্রেপ্তার হন নাভালনি। আগের এক মামলায় দণ্ড মওকুফের শর্ত ভঙ্গ করার অভিযোগে তাঁকে প্রথমে গ্রেপ্তার ও পরে ফেব্রুয়ারির শুরতে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এর সঙ্গে আছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের এক অভিজ্ঞ যোদ্ধাকে অসম্মানসূচক মন্তব্য করার অভিযোগ। তাতে তাঁকে জরিমানাও করা হয়েছে। সব মিলিয়ে আগামী কয়েক মাস কারাগারে অন্তরীণ অবস্থাতেই থাকতে হবে নাভালনিকে।

তবে এসব পন্থায় জাতীয় রাজনীতি থেকে দূরে সরানো যাচ্ছে না পুতিনের একমাত্র রাজনৈতিক শত্রুকে। গ্রেপ্তার হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই ভ্লাদিমির পুতিনের দুর্নীতি নিয়ে এক ভিডিওচিত্র প্রকাশ করে নাভালনির দুর্নীতিবিরোধী ফাউন্ডেশন। ওই ভিডিওচিত্রে দেখানো হয়েছে, দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত শতকোটি ডলারের বেশি ব্যয় করে কৃষ্ণসাগর অঞ্চলে প্রাসাদোপম স্থাপনা নির্মাণ করেছেন পুতিন। নিউজউইক ম্যাগাজিনের তথ্য বলছে, গত এক মাসে এই ভিডিওচিত্র শুধু ইউটিউবে দেখা হয়েছে ১১ কোটির বেশিবার। বলা হচ্ছে, নাভালনির গ্রেপ্তার ও কারাদণ্ডের ঘটনায় মস্কোসহ রাশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে হওয়া গণবিক্ষোভে ইন্ধন জুগিয়েছে এটি। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি ও বার্তা সংস্থা রয়টার্সের তথ্য অনুযায়ী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যাপক কড়াকড়ি ও কঠোর দমননীতি উপেক্ষা করে এ বিক্ষোভে হাজার হাজার রুশ নাগরিক অংশগ্রহণ করেন এবং ১০ হাজারের বেশি বিক্ষোভকারীকে এখনো পর্যন্ত আটক করা হয়েছে।

নাভালনিকে গ্রেপ্তার ও কারাদণ্ড দেওয়ার মাধ্যমে অতি পরিচিত কৌশলে রাজনৈতিক বিরোধিতা সামাল দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। তবে তা বুমেরাং হয়েছে বলা যায়। কারণ, তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে ইন্টারনেটের দুনিয়ায় ব্যাপক আলোচনায় রয়েছেন নাভালনি, বিশেষ করে রাশিয়ায়। রুশ ভাষার প্রকাশনা সংস্থা ওপেন মিডিয়ার সাম্প্রতিক এক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গত ১৭ জানুয়ারি থেকে ১৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অ্যালেক্সি নাভালনির নাম উচ্চারিত হয়েছে প্রায় ১ কোটি ১০ লাখ বার। এ সময়ে পুতিনের নাম উচ্চারিত হওয়ার তুলনায় এটি প্রায় ১৩ লাখ বার বেশি। এমনকি গত বছরের পুরোটা সময়জুড়ে নাভালনির নাম সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মোট যতবার উচ্চারিত হয়েছিল, তার তুলনায় এটি ১ কোটি ৮০ লাখ বার বেশি। অথচ গত বছর নাভালনির তুলনায় এ ক্ষেত্রে বিপুল ব্যবধানে এগিয়ে ছিলেন পুতিন। এবার তিনিই পড়েছেন পিছিয়ে।

নাভালনিকে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে রাশিয়ায় ব্যাপক বিক্ষোভ হয়েছে। হাজার হাজার রুশ নাগরিক এতে অংশ নেয়। বিক্ষোভ ঘিরে ধরপাকড়ও হয়েছে বেশ
ছবি: এএফপি

পুতিনের দুর্নীতি–সংক্রান্ত ভিডিও চিত্র প্রকাশ করেও ভালো সুবিধা পেয়েছেন নাভালনি। রাশিয়ার অন্যতম স্বাধীন ও নিরপেক্ষ জরিপকারী প্রতিষ্ঠান লেভাদা সেন্টারের হিসাব অনুযায়ী, মোট রুশ নাগরিকদের ৩৬ শতাংশ এ ভিডিও চিত্র দেখেছেন বা এর বিষয়বস্তু সম্পর্কে জানেন। আর ৩০ শতাংশ রুশ এই ভিডিও সম্পর্কে জানেন। এ থেকেই ধারণা করা যায় যে নাভালনির তৈরি পুতিনের দুর্নীতির ভিডিও চিত্র রুশদের কতটা আলোড়িত করেছে।

অবশ্য পুতিনও বসে নেই। নাভালনিকে কারাগারে আটকে রাখা ও জরিমানা করার কাজটি তাঁর সরকার সুচারুভাবেই করেছে। এখন শুরু হয়েছে অন্য কৌশল। পুতিন যত দিন ক্ষমতায় আছেন, তত দিন ধরেই রাশিয়াকে সাবেক সোভিয়েত আমলের শৌর্য ফিরিয়ে দেওয়ার কথা আকারে-ইঙ্গিতে বুঝিয়ে আসছেন। আর সে আমলে রাজনৈতিক বিরোধীদের সাধারণ যে তকমা দেওয়া হতো, তা হলো ‘রাষ্ট্রের শত্রু’। ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট বলছে, এবারও নাভালনিকে রাষ্ট্রের শত্রু ও পশ্চিমা বিদেশি শক্তির চর হিসেবে প্রতিভাত করার চেষ্টা চালাচ্ছে পুতিনের সরকার। ইন্টারনেটের দুনিয়ায় নাভালনির ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা ঠেকাতে রাষ্ট্রমালিকানাধীন গণমাধ্যম ও টেলিভিশন চ্যানেলগুলোকে ব্যবহার করা শুরু হয়েছে পুরোদমে। যদিও রাশিয়ায় টেলিভিশন চ্যানেলের প্রভাব তুলনামূলক বয়স্ক নাগরিকদের ওপরই বেশি। তরুণ ও সচেতন জনগোষ্ঠী বরং মুক্ত ইন্টারনেটের দুনিয়ার প্রতি আকৃষ্ট। ফলে নাভালনি কিছুটা বাড়তি সুবিধা পাচ্ছেনই।

অ্যালেক্সি নাভালনি
ফাইল ছবি

লন্ডনের কিংস কলেজের তথ্যযুদ্ধ ও ইন্টারনেট–বিষয়ক বিশেষজ্ঞ গ্রেগরি আসমোলভের মতে, নাভালনির বিষয়ে রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমে ‘প্রোপাগান্ডা’ ছড়ানোর মাধ্যমে তাঁর বিষয়ে সাধারণ মানুষের সমর্থনকে ‘অবৈধ’ প্রমাণ করার চেষ্টা চলছে। এর মূল উদ্দেশ্য বিভক্তি ও ঘৃণা ছড়ানো এবং সাধারণ মানুষকে এটি মনে করানো যে নাভালনি সত্যিই একজন বিদেশি চর ও রাষ্ট্রের শত্রু। এ ধরনের সরকারি নীতি সব সময়ই দমনের মাত্রা বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকে।

রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন
ছবি: রয়টার্স

চিন্তক প্রতিষ্ঠান মস্কো কারনেগি সেন্টারের জ্যেষ্ঠ ফেলো আলেকজান্ডার বাউমভ মনে করেন,অ্যালেক্সি নাভালনি ও তাঁর দল অনলাইন দুনিয়ায় আলোড়ন তোলা ও গণমাধ্যমের দৃষ্টি আকর্ষণে অত্যন্ত সফল হয়েছে। বিশেষ করে তাদের তৈরি কনটেন্ট দেখার সংখ্যার দিক থেকে আগের রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। তবে এ বিষয়টিকে কাজে লাগিয়ে মাঠ পর্যায়ে পুতিনবিরোধী আন্দোলন আরও জোরদার করা কিছুটা কঠিন।

কারণ, রাশিয়ায় একটি পূর্ণাঙ্গ পুলিশি রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তুলেছেন সাবেক এই কেজিবি কর্মকর্তা, যার সর্বাগ্রে আছে দমন-নিপীড়ন।

এত কিছুর পরও নাভালনি অবশ্য আশা ছাড়ছেন না। গত মে মাসেই দ্য নিউইয়র্ক টাইমসকে দেওয়া এক জুম সাক্ষাৎকারে তিনি বলে দিয়েছেন, ‘পুতিন নিজের পাগলামির পুরোটা একা কখনোই সামলাতে পারবেন না। পরিস্থিতি তাঁর নিয়ন্ত্রণের, সামর্থ্যের বাইরে চলে যাচ্ছে। যেখানে ব্যথা অনুভব হবে, সেখানেই আমরা আঘাত করে যাব।’

অ্যালেক্সি নাভালনি কথা রাখছেন। আঘাত তিনি করেই যাচ্ছেন। তাতে ভ্লাদিমির পুতিন কতটুকু টলেন, সেটিই এখন দেখার।