পশ্চিমারা থামাতে চায় পুতিনকে, কিন্তু কীভাবে

  • কয়েক মাস উদ্বেগের পর গত বৃহস্পতিবার ইউক্রেনে হামলা শুরু করে রাশিয়া

  • রাজধানী কিয়েভের কাছে চলে এসেছেন রাশিয়ার সেনারা, নিয়ন্ত্রণে কয়েকটি শহর

  • যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপ এখন উত্তর খুঁজছে পুতিনকে থামানো যাবে কি না, গেলে কীভাবে

ফাইল ছবি

ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভে গুলি, বোমার বিস্ফোরণের সঙ্গে শোনা যাচ্ছে রুশ সেনাদের বুটের শব্দ। ইউক্রেনজুড়ে চাপা আতঙ্ক। নানা হুমকি-ধমকি, চোখ রাঙানি-নিষেধাজ্ঞা কোনো কিছুতেই থামানো যাচ্ছে না রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে। ইউক্রেনের বাতাসে এখন বারুদ পোড়া গন্ধ। এ সংঘাত কোথায় গিয়ে থামবে, তা সময়ের হাতে ছেড়ে দিতে হবে। হাজারো মানুষের মৃত্যু দেখছে বিশ্ব। নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে রুশ প্রেসিডেন্ট ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ওপর। এ অবস্থায় বিশ্বের সংবাদ সংস্থাগুলো উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছে, কীভাবে থামানো যাবে রাশিয়া ও পুতিনকে। পশ্চিমারা কি পারবে থামাতে? আদৌ কি পুতিন থামবেন?

গত বৃহস্পতিবার রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের নির্দেশে ইউক্রেনে সামরিক অভিযান শুরু হয়। এক দিন পরই রাজধানী কিয়েভের উত্তরাঞ্চলে ঢুকে পড়েন রুশ সেনারা। এ মুহূর্তে তাঁরা রাজধানী কিয়েভের দিকে অগ্রসর হচ্ছেন। কিয়েভ থেকে তাঁরা আর মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরে। রাশিয়ার সেনাদের ঠেকাতে ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে ইউক্রেনের সেনাবাহিনী। সাধারণ বাসিন্দাদের হাতেও তুলে দেওয়া হয়েছে ১৮ হাজার মেশিনগান। সাবেক একজন প্রেসিডেন্টও হাতে তুলে নিয়েছেন অস্ত্র। এমন অবস্থায় দেশ ছেড়ে পালাচ্ছেন ইউক্রেনের নাগরিকেরা। যুদ্ধের আজ পঞ্চম দিন। তবে পুতিন কিন্তু শুরু থেকেই বলে আসছেন, তাঁর লক্ষ্য ইউক্রেন দখল করা নয়, নাগরিকদের রক্ষা করা। তিনি বারবার সতর্ক করে বলেছেন যে কোনো দেশ যদি রাশিয়ার কর্মকাণ্ডে হস্তক্ষেপ করার চেষ্টা করে, তবে ‘তারা কখনো দেখেনি এমন পরিণতি’ ভোগ করবে।

বিশেষজ্ঞরা বিশ্বাস করেন যে এ সামরিক পদক্ষেপে মস্কোর সম্ভাব্য উদ্দেশ্য হলো, ইউক্রেনের রাজনৈতিক নেতৃত্বে পরিবর্তন আনা এবং কিয়েভে রাশিয়াপন্থী সরকার বা শাসনব্যবস্থা নিয়ে আসা।

ইউরেশিয়া গ্রুপের গ্লোবাল ম্যাক্রো রিসার্চ-এর পরিচালক হেনরি রোম গত বৃহস্পতিবার বলেন, ‘পুতিনের বক্তব্য এবং হামলার প্রাথমিক ধরনের ওপর ভিত্তি করে এটা বলা যায় যে আমরা “গুরুতর” পরিস্থিতিতে আছি। রাশিয়া ইউক্রেনজুড়ে বড় ধরনের হামলা চালিয়ে এবং সামরিক উপায়ে কিয়েভ সরকারকে উৎখাত করার লক্ষ্যেই তা করেছে। পুতিনের ইউক্রেন দখল না করার দাবি সত্ত্বেও এটি সত্য যে রাশিয়ান বাহিনী কিছু অঞ্চল দখল করে নিজেদের করে নেবে।’

রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাত নিয়ে বিশ্বব্যাপী আর্থিক বাজারেও প্রভাব পড়েছে। বেড়েছে বিশ্বব্যাপী তেলের দামও। এর মধ্য রাশিয়ার ওপর নানা নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে আমেরিকাসহ কয়েকটি দেশ। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এ নিষেধাজ্ঞা কি যথেষ্ট?

ফাইল ছবি

নিষেধাজ্ঞাই কি যথেষ্ট?

বৃহস্পতিবারে আমেরিকা ও ইউরোপীয় কর্মকর্তারা নিষেধাজ্ঞা আরোপের প্রতিশ্রুতি দিয়ে রাশিয়াকে আক্রমণ শুরু করা থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করেছিলেন। এ সপ্তাহের শুরুর দিকে তাঁরা পূর্ব ইউক্রেনের দুই এলাকাকে রাশিয়ার স্বীকৃতি দেওয়ার পর দেশটির ব্যক্তি, আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিলেন।

আক্রমণ শুরুর পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন রাশিয়ার অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলতে পরে এ জন্য আরও ব্যবস্থা নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন এবং তা করেছেনও। নিষেধাজ্ঞাগুলো পুতিনকে আটকানোর জন্য যথেষ্ট কি না, তা অনিশ্চিত। কারণ, ২০১৪ সালে ক্রিমিয়াকে স্বাধীন করার পর রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞার পদক্ষেপে কিন্তু থামেননি পুতিন বা বলা যায়, থামানো যায়নি পুতিনকে। নিষেধাজ্ঞা ব্যর্থ হয়েছে ওই সময়।

ইউরোপের ব্লুবে অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের নীতিনির্ধারক টিমোথি অ্যাশ বলেন, ‘পুতিন ইউরোপজুড়ে একটি নতুন ‘লোহার পর্দা’ তৈরি করতে চাইছেন। এ কারণে আমরা সবাই কম নিরাপদে থাকব।’

পশ্চিমা বিশ্বের কাছে আহ্বান জানিয়ে ইউক্রেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিমিত্রো কুলেবা টুইটে অস্ত্র, আর্থিক ও মানবিক সহায়তার আহ্বান জানান। একটি পৃথক টুইটে পুতিনকে ইউক্রেনের আরও ক্ষতি করতে না দেওয়ার জন্য বিশ্বের কাছে অনুরোধ করেন কুলেবা। তিনি বলেন, বিশ্ব পুতিনকে থামাতে পারে এবং অবশ্যই তা করতে পারে। কাজ করার সময় এখন। কিন্তু কীভাবে তা হবে, এর কোনো সমাধান বা সিদ্ধান্তে আসতে পারেনি পশ্চিমা বিশ্ব।

ফাইল ছবি: রয়টার্স

ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের জেষ্ঠ্য গবেষক ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির তুলনা করেন। বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘সম্ভব হলে ইউক্রেনের বাইরেও হামলা করতে পারে রাশিয়া।’

নিষেধাজ্ঞা মোকাবিলায় রাশিয়া গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে পাবলিক ও বেসরকারি খাতের ঋণের পরিমাণ কমিয়ে এনেছে। এর সঙ্গে ‘যুদ্ধ তহবিল’ গড়ে তুলেছে। আর এসব উদ্যোগের ফলে দেশটির অর্থনীতিকে সারা বছর না হোক আগামী বেশ কয়েক মাস বেশ চাঙ্গাই থাকবে। এর অর্থ হলো ইউক্রেন সমস্যা নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, আমেরিকা, যুক্তরাজ্য, জাপান ও কানাডা—রাশিয়ার ওপর যে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে, তা রুশ অর্থনীতিকে অস্থিতিশীলতায় তেমন কোনো প্রভাবই ফেলতে পারবে না।

এখন প্রশ্ন হতে পারে, রাশিয়ার অর্থনীতিকে বিপাকে ফেলার কোনো উপায়ই নেই? উত্তর, আছে। ইরানের ওপর নিষেধাজ্ঞা যেভাবে জারি করা হয়েছিল, সেভাবে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে রাশিয়াকে আর্থিক লেনদেনের বার্তা আদান-প্রদানকারী আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান সুইফট পেমেন্ট নেটওয়ার্ক থেকে বের করে দেওয়া যায়, একই সঙ্গে রুশ তেল ও গ্যাস ক্রয়ের ওপরও যদি নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়, তাহলেই রাশিয়া কিছু বেকায়দায় পড়তে পারে।

আরও পড়ুন

তবে ইউরোপিয়ান সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল পলিটিক্যাল ইকোনমির প্রধান হোসাক লি-মাকিয়ামা বলেন, ইউরোপ যখন নিজেকে রাশিয়ার সঙ্গে আরও বেশি সম্পৃক্ত করেতে চেয়েছে, রাশিয়া তখন নিজেকে ইউরোপের থেকে বিচ্ছিন্ন করতে ব্যস্ত ছিল। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের দেশগুলোর কাছে সব মিলিয়ে ৩০০ বিলিয়ন ইউরো মূল্যমানের রুশ সম্পদের মালিকানা রয়েছে। তাই রাশিয়ার বিরুদ্ধে যদি অর্থনৈতিক যুদ্ধ শুরু হয়, তাহলে ওই বিপুল পরিমাণ সম্পদও জব্দ হওয়ার ঝুঁকিতে পড়বে।

লি-মাকিয়ামা বলেন, ‘আমি বলছি না রাশিয়াকে সুইফট সিস্টেম থেকে বের করে দেওয়ার চিন্তা অসম্ভব কিছু। কিন্তু এটি অন্যতম একটি অপশন। এর ফলে আপনি শত্রুর পাশাপাশি নিজের পায়েও কুড়াল মারবেন।’

আবার সুইফট থেকে রাশিয়াকে বিচ্ছিন্ন করলে বিপদ আছে অন্য দেশগুলোরও। কারণ, এর প্রভাব শুধু রাশিয়ায় সীমাবদ্ধ থাকবে না। ক্ষতির মুখে পড়বে অন্য দেশও। রাশিয়া থেকে তেল বা গ্যাসের ক্রেতা দেশগুলো ঝুঁকিতে পড়বে। কারণ, ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রধান তেল ও জ্বালানি সরবরাহকারী রাশিয়া। আর এ কারণে রাশিয়ার সাবেক অর্থমন্ত্রী অ্যালেক্সি কুদরিন বলেছেন, সুইফট থেকে রাশিয়াকে নিষিদ্ধ করা হলে দেশটির অর্থনীতি ৫ শতাংশ কমতে পারে।

সুইফট থেকে বিচ্ছিন্ন করলে ইউরোপে গ্যাসের ঘাটতিও দেখা দিতে পারে। কারণ, তখন লেনদেন বন্ধ হবে। আর রাশিয়ার গ্যাসের ওপর ইউরোপের কয়েকটি দেশ নির্ভরশীল।

ছবি: রয়টার্স

পশ্চিমারা পুতিনকে থামাতে কী কী করতে পারে, তা নিয়ে নানা প্রশ্ন আছে। ইউক্রেনকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইইউ সামরিক সহায়তা দেবে কি না, আর দিলেও তা কেমন হবে, তা স্পষ্ট নয়। আসলে মার্কিন এবং ইইউর সামরিক সহায়তার স্বরূপটি কেমন হবে তা–ও অজানা।

ইউরোপের অন্য দেশ রাশিয়াকে বৈশ্বিক আর্থিকব্যবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য নানা নিষেধাজ্ঞা দিচ্ছে এবং দেবে। এসব নিষেধাজ্ঞার সুদূরপ্রসারী প্রভাব কেমন হবে এবং তা রুশ অর্থনীতিকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে কি না, তা আসছে দিনগুলোতে জানা যাবে।

টিমোথি অ্যাশ বলেন, ‘ধরে নেওয়া যায় ইইউ এবং যুক্তরাজ্যও একই ব্যবস্থার পথে হাঁটবে। রাশিয়ান ক্রিয়াকলাপের তীব্রতার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা আশা করি, পশ্চিমা নীতিনির্ধারকেরা তাঁদের সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতির পরিকল্পনার বাইরে যাবেন, যা সুইফট থেকে রাশিয়াকে বহিষ্কার করে। নর্ড স্ট্রিম ২ (জার্মানির সঙ্গে গ্যাস পাইপলাইন) অনির্দিষ্টকালের জন্য সাইডলাইন করা হবে।’

পুতিন কি এখানেই থামবেন

ইউক্রেনের সঙ্গে সমস্যার শুরুটা ন্যাটোর সদস্য হওয়া নিয়ে। রাশিয়া নিজেদের নিরাপত্তার স্বার্থেই ইউক্রেনের ন্যাটো সদস্য হওয়া মানবে না। সদস্য হলে সীমান্তে ন্যাটো বাহিনীর সদস্যরা থাকবেন, যা রাশিয়ার নিরাপত্তার জন্য হুমকি।

যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহৃত গুলির খোসা দিয়ে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের প্রতিকৃতি তৈরি করেছেন ইউক্রেনের শিল্পী দারিয়া মার্কেনকো। প্রতিবাদী এই শিল্পকর্মের নাম দিয়েছেন, ‘যুদ্ধের মুখ’
ফাইল ছবি: রয়টার্স

পশ্চিমারা বলে থাকে, নিরাপত্তার নামে দেশ দখলের চেষ্টা রাশিয়ার পুরোনো একটি ‘খেলা’। ২০০৮ সালে জর্জিয়ার শাসকের বিরুদ্ধে স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ আনে রাশিয়া। সে দেশে গণহত্যার হাত থেকে ওসেটিয়ানদের রক্ষা করতে অস্ত্র হাতে নামেন রুশ সেনারা। দক্ষিণ ওসেটিয়া নিয়ে শুরু হয় সংঘাত। অঞ্চলটির দখল ছিল রুশপন্থী বিচ্ছিন্নতাবাদীদের হাতে। কয়েক দিনের যুদ্ধে পরাজয় হয় একসময়ের সোভিয়েত অন্তর্ভুক্ত দেশ জর্জিয়ার। সাউথ ওসেটিয়া ও আবাকাজি প্রদেশকে স্বাধীন বলে ঘোষণা করে রাশিয়া। এর পর থেকেই সেখানে সেনা মোতায়েন করে রেখেছে রাশিয়া। এরপর ২০১৪ সালে ক্রিমিয়াকেও নিজেদের অংশ বলে দাবি করে রাশিয়া। যুদ্ধের পর ক্রিমিয়াকে স্বাধীন করে দেয়। ইউক্রেনকে আলোচনার টেবিলে আনতে পুতিন যেসব শর্ত রেখেছেন, তার মধ্যে অন্যতম হলো, ক্রিমিয়াকে রাশিয়ার অংশ বলে স্বীকার করতে হবে কিয়েভকে।

এদিকে পশ্চিমারা বলে আসছে, সোভিয়েত ইউনিয়ন গড়তে এক অনবদ্য ছক কষেছে রুশ সেনাবাহিনী। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কিছু সাবেক সেনাসদস্যর সেই ছক ফাঁস করেছে আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে। আশপাশের দেশ দখলের সেই পরিকল্পনার ধাপ আছে তিনটি। এক. বিদ্রোহীদের অধিকৃত অঞ্চলকে স্বাধীন হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া। দুই. স্বাধীন স্বীকৃতি দেওয়া অঞ্চলগুলোর নিরাপত্তার স্বার্থে সেনা পাঠানো। তিন. ওই অঞ্চলে গণভোটের আয়োজন করা, সেই ভোটের মাধ্যমে অঞ্চলটিকে রাশিয়ার অংশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা। এ ছকেই সোভিয়েত ইউনিয়ন পুনরুদ্ধারের স্বপ্ন দেখে পুতিনের রাশিয়া। পশ্চিমা দেশগুলো যথাযথ ব্যবস্থা না নিলে রাশিয়া যে এখানেই থামবে না বলেই মনে করেন পশ্চিমা বিশ্লেষকেরা।

  • গার্ডিয়ান, রয়টার্স, বিবিসি এবং সিএনবিসি অবলম্বনে