পুতিন-এরদোয়ানের ঘনিষ্ঠতার নেপথ্য কারণ

তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান রাশিয়ার অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে নাক গলান না। রাশিয়াও তুরস্কের কাছে অস্ত্র বিক্রি করতে পেরে খুশি। ভূরাজনীতির কৌশলী খেলায় দুই নেতা অনেকটাই কাছাকাছি চলে এসেছেন।

২০১৯ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর আঙ্কারায় বৈঠক শেষে হাত মেলান রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন (বাঁয়ে) ও তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান
ছবি : রয়টার্স

ভূরাজনীতির কৌশলী খেলায় পশ্চিমা বিশ্বকে টেক্কা দিতে হলে শত্রুতা ভুলে বন্ধুত্বের বিকল্প নেই। এ কথা ভালোভাবেই বুঝেছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান। এখন দুজন তাই কাছাকাছি। বিষয়টি নিয়ে ভ্রু কুঁচকাতে শুরু করেছে পশ্চিমা ও ইউরোপ বিশ্ব। ব্রিটিশ গণমাধ্যম ‘দ্য ইকোনমিস্ট’–এর বিশ্লেষণে উঠে এসেছে অস্বাভাবিক বন্ধুত্বের নেপথ্যের কারণগুলো।

ইকোনমিস্ট বলছে, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে ক্ষমতাচ্যুত করার চেষ্টার অভিযোগ রয়েছে মার্কিন নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট ন্যাটোর বিরুদ্ধে। এ অভিযোগ ক্রেমলিনের। পুতিনের কট্টর সমালোচক ও বিরোধী অ্যালেক্সি নাভালনিকে ‘মার্কিন এজেন্ট’ বলেও আখ্যা দেওয়া হয়েছে। শুধু ন্যাটো জোট নয়, ক্রেমলিনের ক্ষোভ রয়েছে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের বিরুদ্ধেও। কারণ, নাভালনিকে বিষ প্রয়োগে হত্যাচেষ্টার ঘটনায় নিন্দা জানিয়েছে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন (ইইউ)। তাই ক্রেমলিনের চোখে ইইউ অবিশ্বস্ত সহযোগী। তবে ইইউ সদস্যপ্রার্থী ও ন্যাটো জোটভুক্ত একটি দেশের ওপর খুশি পুতিন। দেশটি তুরস্ক।

তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান রাশিয়ার অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে নাক গলান না। নাভালনির প্রতি ক্রেমলিনের আচরণ বা এ নিয়ে রাশিয়ার বিক্ষোভ থেকে শত শত লোকজনকে গ্রেপ্তার বিষয়ে টুঁ শব্দ করেননি এরদোয়ান। তাঁর এ নীরবতা পুতিনকে খুশি করেছে।

বর্তমান প্রেক্ষাপটে পুতিন পশ্চিমাদের মোকাবিলায় তুরস্ককে কাছে টেনে নিচ্ছেন। আশা করছেন, তিনি ন্যাটোর বিরুদ্ধে একে ব্যবহার করতে পারবেন। অন্যদিকে, এরদোয়ান নিজের প্রভাব বাড়াতে পাশে পাচ্ছেন রাশিয়াকে।

ইকোনমিস্ট-এর দৃষ্টিতে দুই নেতার মধ্যে গড়ে ওঠা এই সম্পর্ক অনেকটাই স্রোতের বিপরীত বা অস্বাভাবিক। কারণ, অনেক আগে থেকেই দুটি দেশের মধ্যে গভীর ঐতিহাসিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলমান। তাঁদের স্বার্থের সংঘাত নানা কারণে প্রবল হয়ে ওঠে। অনেক ক্ষেত্রে তা সংঘর্ষে রূপ নিতেও বাধে না। শক্তিধর এই দুটি দেশের প্রধান এমন একটি বন্ধন গড়ে তুলেছেন, যা আঞ্চলিক রাজনীতির মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে। এই সম্পর্ক তুরস্কের পশ্চিমা মিত্রদের জন্য উদ্ভট এক সমস্যা সৃষ্টি করছে।

ঐতিহাসিকভাবে রাশিয়া ও তুরস্ক এক ডজনের বেশি যুদ্ধে জড়িয়েছে। যেসব জায়গায় দুই দেশের স্বার্থ জড়িত সেখানে পরস্পরকে আঘাত করেছে তারা। লিবিয়া ও সিরিয়া যুদ্ধ তারই প্রমাণ। গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসেও তারা পরস্পর মুখোমুখি হয়েছিল।

সিরিয়ায় সংঘর্ষ কমাতেও হাত মেলান এরদোয়ান ও পুতিন
ছবি : রয়টার্স

মুসলিম–অধ্যুষিত আজারবাইজানের পক্ষে দাঁড়িয়ে যায় তুরস্ক আর রাশিয়া পক্ষ নেয় আর্মেনিয়ার। নাগোরনো-কারাবাখ নিয়ে আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের যুদ্ধের নেপথ্যে ছিল এ দুটি দেশ। গত বছরের নভেম্বরে দৃশ্যপট বদলে যায়। ভ্লাদিমির পুতিন নাগোরনো-কারাবাখ অঞ্চলে পুরোপুরি সংঘর্ষ থামাতে একটি চুক্তি নিয়ে কথা বলেছেন। এ চুক্তিতে রাশিয়া, আর্মেনিয়া ও আজারবাইজান—তিন পক্ষই সম্মত হয়।

পুতিন ও এরদোয়ান দুজনেই বুঝেছেন পরাশক্তির মধ্যে ভারসাম্য যতটা না গুরুত্বপূর্ণ, তার চেয়ে এই শক্তি ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত থাকাটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ
আন্দ্রে কুর্তোনোভ, রাশিয়ান ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স কাউন্সিলের প্রধান

ইকোনমিস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়, আর্মেনিয়ার পক্ষে থাকা রাশিয়ার ট্যাংকে যখন তুরস্কের ড্রোন আঘাত হানছিল, তখন উল্টো ঘটনা দেখল বিশ্ব। পুতিন প্রশংসা করলেন এরদোয়ানের। বাড়ালেন ব্যবসার হাত। গত বছরের অক্টোবর থেকেই পুতিনের সুর পাল্টাতে শুরু করেছিল। বিদেশি বিশেষজ্ঞদের সামনে এরদোয়ানের প্রশংসা করে বলেছিলেন, ‘এ ধরনের একজন সহযোগীর সঙ্গে কাজ করা নিরাপদ ও আনন্দের বিষয়।’

অপর দিকে এরদোয়ান পুতিনের প্রশংসাবাক্যকে স্যালুট ঠুকে তাঁদের এস-৪০০ মিসাইল সিস্টেম পরীক্ষা করা শুরু করলেন। মাঝখান থেকে তুরস্কে ব্যবসা হারাল যুক্তরাষ্ট্র। রাশিয়া ওই সুযোগে তুরস্কের কাছে তাদের ওই ক্ষেপণাস্ত্র বিক্রি করে ফেলল।

নেপথ্যের এই লেনদেন কাহিনির পরই নভেম্বরে নাগোরনো-কারাবাখের পুরো যুদ্ধের দৃশ্যপট বদলে গেল। দুই পক্ষই যুদ্ধ থামিয়ে দিতে সম্মত হলো। নেমে পড়ল দর-কষাকষিতে। এতে রাশিয়া নাগারনো–কারাবাখে সেনা হাজির করার এবং তুরস্ক দক্ষিণ ককেশাস অঞ্চলে অর্থনৈতিক ক্ষমতা বাড়ানোর সুযোগ পেয়ে গেল। রাশিয়া ও তুরস্কের এই চুক্তি বৈশ্বিক ভূরাজনীতির ক্ষেত্রে একটি বড় ধাক্কা হয়ে এসেছে।

রাশিয়ান ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স কাউন্সিলের প্রধান আন্দ্রে কুর্তোনোভ বলেন, ‘পুতিন ও এরদোয়ান দুজনেই বুঝেছেন পরাশক্তির মধ্যে ভারসাম্য যতটা না গুরুত্বপূর্ণ, তার চেয়ে এই শক্তি ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত থাকাটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ।’


মার্কিন প্রভাব কমাতেই কাছাকাছি

ইকোনমিস্ট বলেছে, যুক্তরাষ্ট্রের হাতে অধিক ক্ষমতাশালী সেনাবাহিনী থাকলেও সিরিয়ার যুদ্ধে তাদের জড়িত হওয়ার অনীহা রাশিয়া ও তুরস্ককে ওই অঞ্চলের দায়িত্ব নিতে পথ দেখায়। দুটি দেশই ক্ষমতার প্রদর্শনীতে আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ায়ও দ্বন্দ্ব বাড়িয়ে তোলে। পুতিন মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনেই তাঁর লক্ষ্যের কথাটি বলে দিয়েছেন। তাঁদের মিশন, আমেরিকার নতুন আধিপত্যকে সীমাবদ্ধ করা।

মার্কিন প্রভাব কমাতে রাশিয়া বলয়ে ঢুকে পড়েছেন এরদোয়ান
ছবি : রয়টার্স

রাশিয়া ও তুরস্ক পশ্চিমা শক্তির প্রভাব কমানোর জন্য আগেও যৌথ উদ্যোগ নিয়েছে। বলশেভিক বিপ্লবের পরবর্তী সময়ে ও অটোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর কামাল আতাতুর্ক লেনিনকে বন্ধু হিসেবে নিয়েছিলেন। রাশিয়া তখন তুরস্ককে গ্রিক ও ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়তে যুদ্ধাস্ত্র দিয়েছিল। বিনিময়ে তুর্কিরা বলশেভিক অঞ্চলে তেলের নিয়ন্ত্রণ দিয়েছিল রাশিয়ানদের। ১৯২১ সালে আতাতুর্ক ও লেনিনের ওই চুক্তিতে তুরস্কের উত্তর–পূর্বের সীমান্ত নির্ধারিত হয়। গত বছরের নাগারনো–কারাবাখ চুক্তিটাকেও ঐতিহাসিক ওই চুক্তির প্রতিচ্ছবি হিসেবেই দেখা যায়।

পুতিনের সঙ্গে এরদোয়ানের এমন ব্যক্তিগত সম্পর্ক রয়েছে, যা অনেক পশ্চিমা নেতার সঙ্গে নেই। নিজ দেশেও দুজনের শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। তাই তাঁরা নিজেরা যে সিদ্ধান্ত নেন, তা বাস্তবায়নের ক্ষমতা রাখেন
এমরে আরসেন, ইস্তাম্বুলের মারমারা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাশিয়াবিষয়ক বিশেষজ্ঞ

বর্তমান প্রেক্ষাপটে পুতিন পশ্চিমাদের মোকাবিলায় তুরস্ককে কাছে টেনে নিচ্ছেন। আশা করছেন, তিনি ন্যাটোর বিরুদ্ধে একে ব্যবহার করতে পারবেন। অন্যদিকে, এরদোয়ান নিজের প্রভাব বাড়াতে পাশে পাচ্ছেন রাশিয়াকে। সম্পর্ক বন্ধুত্বের পথে নিতে ২০১৬ সাল থেকেই উদ্যোগ নেন পুতিন। ওই সময়ে তুরস্কে এরদোয়ানকে সরাতে বিশেষ অভ্যুত্থান হয়েছিল। তবে টিকে যান এরদোয়ান। অভ্যুত্থান ব্যর্থ করে দেওয়ার পর তুরস্কের প্রেসিডেন্টের প্রশংসা করেন পুতিন। তিনি বলেন, ‘লোকটাকে পছন্দ করুন না–করুন, তিনি ঐক্য তৈরির ক্ষেত্রে যথেষ্ট দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন।’ অনেক পশ্চিমা দেশ ওই সময় এরদোয়ানকে সমর্থন দিতে দেরি করে। এরপর এরদোয়ান রাশিয়া সফরও করেন। সেখানে গ্যাসপাইপলাইন বসানোর চুক্তি করেন। এ ছাড়া রাশিয়ার সহযোগিতায় তুরস্কে পারমাণবিক স্থাপনা তৈরির কাজ চালিয়ে যেতেও সম্মত হন।

ইস্তাম্বুলের মারমারা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাশিয়াবিষয়ক বিশেষজ্ঞ এমরে আরসেন বলেন, ‘তুরস্কের জঙ্গি বিমান ঘাটতি ছিল। রাশিয়ার সঙ্গে চুক্তির বিষয়টি তাদের সম্পর্ক ঘুরে দাঁড়ানোর মোড় হয়ে যায়। ন্যাটো যখন তুরস্ককে সাহায্য করতে রাজি হয়নি তখন তুরস্ক বুঝেছিল রাশিয়ার সঙ্গে চুক্তি করতে হবে।’

২০১৬ সালের পর থেকেই পুতিনের সঙ্গে সরাসরি সাক্ষাৎ বেড়েছে এরদোয়ানের। সিরিয়ায় একসময় উভয় পক্ষ মুখোমুখি থাকলেও এখন তারা সহযোগী। তুরস্ক এখন কেবল রাশিয়ার অনুমতি সাপেক্ষেই সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলে সামরিক অভিযান চালায়। এরদোয়ানের ঘনিষ্ঠজনেরা এখন পশ্চিমাবিমুখ। তাঁরা এখন চীন ও রাশিয়ার দিকে ঝুঁকছেন।

সম্পর্ক উন্নত করেছে অস্ত্র ও ব্যবসা

রাশিয়ার সঙ্গে নতুন সম্পর্ক তৈরির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে তুরস্কের ‘এস-৪০০ এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম’ কেনার সিদ্ধান্তটি। দুই বছর আগে এরদোয়ান এই চুক্তিকে দেশটির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি হিসেবে ঘোষণা দেন। এ সিস্টেম কিনতে অবশ্য তুরস্ককে চড়া দাম দিতে হয়েছে। এর জন্য তুরস্ক হার্ডওয়্যারে আড়াই বিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ করেছে। আমেরিকার এফ-৩৫ প্রোগ্রাম থেকে বাদ দিতে গিয়ে ৯ বিলিয়ন ডলার ক্ষতি হয়েছে। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের কোপানলে পড়তে হয়েছে তাদের।

রাশিয়ার এস ৪০০ ক্ষেপনাস্ত্র
ছবি : রয়টার্স

ইকোনমিস্ট বলছে, ২০১৬ সালের অভ্যুত্থানের সময় যে ধরনের নিরাপত্তাঝুঁকি তৈরি হয়েছিল, তার মোকাবিলায় অস্ত্র ও প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম কিনতে মরিয়া ছিলেন এরদোয়ান। অনেকেই ধারণা করেন, ওই অভ্যুত্থানে আমেরিকার হাত ছিল। গুঞ্জন রয়েছে, রাশিয়ার সামরিক গোয়েন্দা সূত্র থেকে এরদোয়ানকে জীবনের ঝুঁকি সম্পর্কে অবহিত করা হয়েছিল।

অস্ত্র কেনা ছাড়াও দুই দেশের সম্পর্ক তৈরির ক্ষেত্রে বাণিজ্য ও বিনিয়োগও বড় ভূমিকা রাখছে। রাশিয়া মূলত তাদের বিদ্যুৎ রপ্তানি করে থাকে। তুরস্কের রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি ১৩ দশমিক ৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। মারমারা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক বেহলুল ওজকান বলেন, ‘আমরা ব্যবসায়িক সম্পর্কের বিষয়টি খাটো করে দেখতে পারি না। তুরস্কের নির্মাণশিল্প বড় টেন্ডার পাচ্ছে। রাশিয়া তাদের জন্য বড় বাজার। ইতিমধ্যে ৪০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার প্রকল্প শেষ করেছে তুরস্কের কোম্পানিগুলো।’

দুই দেশের সম্পর্ক আরও গাঢ় মূলত দুই দেশের সংগ্রামরত অর্থনীতির কারণে। তুরস্কের মুদ্রাস্ফীতি ও বেকারত্ব সমস্যা ২০১৮ সাল থেকে বেড়েছে। চার বছর ধরে তুরস্কের মুদ্রা লিরার মূল্য ডলারে বিপরীতে অর্ধেক কমে গেছে। রাশিয়ার অর্থনীতিও কয়েক বছর ধরে ধুঁকছে। পুতিন ও এরদোয়ান দুজন বুঝেছেন তাঁদের বাইরের শত্রুরা চারপাশে ঘিরে রেখেছে। ঘরের ঝামেলা থেকে নজর হটাতে তাই তাদের বাইরে আগ্রাসনের কৌশলের আশ্রয় নিতে হয়েছে।

দুই নেতার উচ্চাভিলাষ

পুতিন ও এরদোয়ান দুজনকেই উচ্চাভিলাষী নেতা বলে মনে করা হয়। তাঁদের কাছাকাছি আসার ক্ষেত্রে দুই দেশের সীমান্ত পরিস্থিতির বিষয়টিও ভূমিকা রেখেছে। তুরস্ক ও রাশিয়া দুই দেশই ইউরোপ থেকে বিচ্ছিন্ন। তুরস্কের ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে যুক্ত হওয়ার প্রচেষ্টা করে যাচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে। কিন্তু সফল হতে পারছে না। এ ছাড়া দুই স্বৈরশাসকই সাম্রাজ্য বাড়ানোর দিকে মনোযোগী। পুতিন তার প্রমাণ রেখেছেন।

সোভিয়েত সাম্রাজ্যের পুনর্গঠনের চেষ্টা করছেন তিনি। তিনি জর্জিয়া ও ইউক্রেনের ওপর যুদ্ধ চাপিয়েছেন। এরদোয়ানও তাঁর দেশের অটোমান অতীতকে ফিরিয়ে আনতে পারে। তাঁর আক্রমণাত্মক বৈদেশিক নীতিমালা তারই প্রমাণ দেয়।

সম্পর্ক কৌশলগত

বিশেষজ্ঞ এমরে আরসেন বলেন, ‘পুতিনের সঙ্গে এরদোয়ানের এমন ব্যক্তিগত সম্পর্ক রয়েছে, যা অনেক পশ্চিমা নেতার সঙ্গে নেই। নিজ দেশেও দুজনের শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। তাই তাঁরা নিজেরা যে সিদ্ধান্ত নেন, তা বাস্তবায়নের ক্ষমতা রাখেন।’

গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে দুই নেতা প্রায় যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে চলে গিয়েছিলেন
ছবি : রয়টার্স

এরদোয়ান জানেন, আমেরিকার সঙ্গে চুক্তি বাতিলের খেসারত তাঁকে দিতে হতে পারে। জনমত এবং কংগ্রেস এ ক্ষেত্রে যেকোনো পদক্ষেপ নিতে পারে। অবশ্য, পুতিনের এসব দুশ্চিন্তা নেই। তাঁর বর্তমান সমস্যা অ্যালেক্সি নাভালনি। নাভালনির কারাদণ্ড ঘিরে পশ্চিমা বিশ্বে তাঁর সমালোচনা বাড়ছে। তবে তা ক্ষমতা হাতের মুঠো থেকে বের করে নেওয়ার মতো নয়। অন্যদিকে এরদোয়ান জানেন, তাঁর সঙ্গী–সাথিরা সবাই তাঁকে ভালোভাবে না। প্রতিপক্ষ, আদালত ও গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করলেও তাঁর সমর্থন কমছে। গত স্থানীয় নির্বাচনে ইস্তাম্বুলের নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে তার দল।

তবে ইকোনমিস্ট বলছে, তুরস্ক ও রাশিয়া এখনো সত্যিকারের বন্ধুত্ব থেকে অনেক দূরে। বিলকেন্ট ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর রাশিয়ার স্টাডিজের প্রধান অনুর ইজসি বলেন, ‘আমরা কৌশলগত অংশীদারত্বের কথা বলছি না। আমি মনে করি না যে পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে তুরস্কের পুরো প্রাতিষ্ঠানিক সম্পর্ক ভেঙে ফেলার ঝুঁকি নেওয়ার মতো বিলাসিতা রয়েছে।’

বর্তমানে তুরস্ক ক্রমশ পশ্চিমা জোট থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। রাশিয়ার সঙ্গে অংশীদারত্ব অতিসাম্প্রতিক এবং তা খুব গভীর নয়। এটি যেকোনো সময় ঘুরে যেতে পারে। তুরস্ক যেন পশ্চিমাদের কাছ থেকে অনেক দূরে চলে গিয়ে পুতিনের বাহুতে চিরস্থায়ী বসে পড়তে না পারে, সেটা ঠেকানোই মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের জন্য এখন চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠতে পারে।