পুতিনের ভাড়াটে সেনা কারা

ইউক্রেন সীমান্তে রাশিয়ার সামরিক যানের কাছে সশস্ত্র যোদ্ধারা
ছবি: রয়টার্স

ইউক্রেন যুদ্ধ ঘিরে আলোচনায় এসেছে ‘কুখ্যাত’ রুশ মার্সেনারি বা ভাড়াটে সেনার দল ‘দ্য ওয়াগনার’ গ্রুপ। এ গ্রুপের নৃশংসতাই একে অন্য ভাড়াটে সেনাদের থেকে আলাদা করে চিনিয়েছে। ২০১০ সালের পর থেকে রাশিয়া বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে আবার নিজেদের অবস্থান নতুন করে জানান দিতে শুরু করে। এর পেছনে রুশ মার্সেনারি বা ভাড়াটে সেনার দল দ্য ওয়াগনার গ্রুপের ভূমিকার কথা বলে আসছেন বিশ্লেষকেরা। যেসব দেশে রাশিয়া ছায়াযুদ্ধ বা প্রক্সি ওয়ারে জড়িয়েছে, সেখানে ওয়াগনারের মতো সশস্ত্র গ্রুপের উপস্থিতি দেখা গেছে। ব্রিটিশ সাময়িকী ‘দ্য ইকোনমিস্ট’–এর এক বিশ্লেষণে বিশেষ এই ভাড়াটে সৈন্য দলের বিস্তারিত উঠে এসেছে।

‘দ্য গার্ডিয়ান’–এর সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইউক্রেনের দনবাস অঞ্চলে নতুন করে শুরু করা অভিযানে ২০ হাজার ভাড়াটে যোদ্ধা মোতায়েন করেছে রাশিয়া। সিরিয়া, লিবিয়াসহ বিভিন্ন দেশ থেকে তাঁদের সেখানে জড়ো করা হয়েছে। তবে কোনো ধরনের ভারী অস্ত্রশস্ত্র ও সাঁজোয়া যান ছাড়াই তাঁদের যুদ্ধে পাঠানো হয়েছে। ইউরোপীয় এক কর্মকর্তার বরাতে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। ওই কর্মকর্তা বলেন, এসব ভাড়াটে সেনা মোতায়েন করেছে ওয়াগনার গ্রুপ। ইউক্রেনের প্রতিরোধের বিরুদ্ধে তাঁদের গণহারে ব্যবহার করা হচ্ছে। তাঁরা মূলত পদাতিক।

ইউক্রেনে যুদ্ধ করতে পদমর্যাদা ও অভিজ্ঞতা বিবেচনায় সিরিয়ার সাবেক এসব সেনাকে মাসে ৬০০ থেকে ৩ হাজার ডলার পর্যন্ত বেতনের প্রস্তাব দেওয়া হয়।

ওয়াগনার লিবিয়ায় যুদ্ধরত অধিকাংশ সেনাকে ইউক্রেনে নিয়ে গেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। লিবিয়ার যোদ্ধাদের ইউক্রেনে পাঠাতে মস্কো-সমর্থিত লিবিয়ার যুদ্ধবাজ খলিফা হাফতারের সঙ্গে রাশিয়া একটি চুক্তি করেছে। ইউক্রেনের সামরিক গোয়েন্দা বিভাগ এমন দাবি করেছে।

পূর্ব ইউক্রেনের যতদূর সম্ভব দখলে নিতে রাশিয়ার প্রচেষ্টা সফল করতে এসব ভাড়াটে যোদ্ধাদের ব্যবহার করা হচ্ছে। পশ্চিমা প্রতিরক্ষা কর্মকর্তাদের ভাষ্য, বিজয় ঘোষণার মতো কিছু অর্জনের জন্য ক্রেমলিন তাড়াহুড়া করছে। আর এ কাজে ক্রেমলিনের অব্যর্থ এক অস্ত্র এই ওয়াগনার গ্রুপ।

ওয়াগনার গ্রুপকে ক্রেমলিনের প্রণোদনাপ্রাপ্ত সশস্ত্র সংগঠন হিসেবে বর্ণনা করা হলেও মস্কো বরাবরই তা অস্বীকার করে এসেছে। এর কারণ, ওয়াগনার গ্রুপ ব্যক্তিমালিকানায় পরিচালিত একটি সংগঠন এবং রাশিয়ার সংবিধানে এ রকম কোনো সংগঠনকে জাতীয় নিরাপত্তা ও জাতীয় স্বার্থের জন্য ব্যবহার করার কোনো আইনি কাঠামো নেই।

রাশিয়ার নিরাপত্তা কিংবা নিজস্ব আঞ্চলিক আধিপত্য বিস্তারের ক্ষেত্রে সরকারি বাহিনীকেই ব্যবহার করার কথা বলা হয়েছে। সংবিধানে না থাকলেও সম্প্রতি অনেকবার রাশিয়ান পার্লামেন্টে প্রাইভেট মিলিটারি সিকিউরিটি কন্ট্রাকটিং কোম্পানি বা ওয়াগনার গ্রুপের মতো সশস্ত্র বেসামরিক সংগঠনগুলোকে একটি আইনি ভিত্তির ওপর দাঁড় করানোর জন্য চেষ্টা করা হয়েছে, যদিও সেই চেষ্টা সফলতার মুখ দেখেনি।

দ্য ইকোনমিস্ট বলছে, রুশ আগ্রাসনের মুখে পড়ে বিপর্যস্ত ইউক্রেন। কিয়েভের দখল নেওয়ার রাশিয়ার ইচ্ছায় বাদ সেধেছে ইউক্রেনের সেনাবাহিনী এবং তাদের যুদ্ধের কৌশল। সে কারণে কিয়েভ থেকে লক্ষ্য সরিয়ে ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চল দনবাসের দিকে এগোচ্ছেন রুশ সেনারা। সেখানকার ইউক্রেনীয় সেনাদের আত্মসমর্পণে বাধ্য করতে মাঠে নামানো হয়েছে ওয়াগনার গ্রুপের ভাড়াটে সেনাদের। তারা পুতিনের নিজস্ব সেনা নামেও পরিচিত। তবে ওয়াগনার গ্রুপের কুখ্যাতি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে রয়েছে। এর সদস্যদের বিরুদ্ধে ধর্ষণ, ডাকাতি, খুন ও যুদ্ধাপরাধে যুক্ত থাকার অভিযোগ রয়েছে।

পশ্চিমা দেশগুলোর অভিযোগ, রাশিয়ার বিভিন্ন গোপন মিশন ও উদ্ধার অভিযানের দায়িত্ব দেওয়া আছে এই বাহিনীর ওপর। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ইতিমধ্যে ওয়াগনার বাহিনীর বিরুদ্ধে ইউক্রেন, সিরিয়া, লিবিয়া, মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র, সুদান ও মোজাম্বিকে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ এনেছে। পূর্ব ইউক্রেনেও রুশপন্থী বিভিন্ন বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীকে অস্ত্র সরবরাহ এবং সামরিক প্রশিক্ষণের জন্য এই বাহিনীকে কাজে লাগানোর অভিযোগ রয়েছে।

ওয়াগনার যেভাবে এল

‘ওয়াগনার’ নামটি নেওয়া হয়েছে অ্যাডলফ হিটলারের প্রিয় সুরকার ওয়াগনারের নাম অনুসারে। ওয়াগনারের প্রতিষ্ঠাতা ও নেতা দিমিত্রি উটকিন। তিনি রুশ গোয়েন্দা বিভাগের একজন অভিজ্ঞ কর্মী ছিলেন। চেচেন যুদ্ধে লড়াই করার পরে অভিজাত স্পেৎসনাজ বা বিশেষ বাহিনী ইউনিটের কমান্ড হিসেবেও কাজ করেছেন উটকিন।

তিনি রুশ সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলেন। ‘দ্য গ্রু’ নামে পরিচিত গোয়েন্দা দপ্তরের কাছে ওয়াগনারের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রও তৈরি হয়। লিবিয়া, সিরিয়া ও ভেনেজুয়েলার মতো দেশে রুশ সামরিক বাহিনীর জাহাজে করে ওয়াগনারের কর্মীদের আনা–নেওয়া শুরু হয়। রুশ সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকেই তাদের সরঞ্জাম ও রসদ সরবরাহ করা হয়। লিবিয়া থেকে উদ্ধার হওয়া নথিতে দেখা যায়, সামরিক বাহিনীর ট্যাংক, উন্নত রাডার ও শত শত কালাশনিকভ রাইফেল কেনার তালিকা ওয়াগনারের সেনাদের কাছে ছিল। এসব সরঞ্জাম কেবল রুশ সেনাবাহিনীর জন্য সরবরাহ করা হয়ে থাকে।

দ্য ইকোনমিস্ট জানায়, ওয়াগনার কর্মীরা প্রায়ই প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যুক্ত একটি বিশেষ ডেস্ক থেকে সরবরাহ করা পাসপোর্ট ব্যবহার করেন। ২০১৮ সালে যুক্তরাজ্যে সাবেক রুশ গুপ্তচর সের্গেই স্ক্রিপালকে হত্যাচেষ্টায় জড়িত দুই ব্যক্তির পাসপোর্ট সরবরাহ করা হয় এই ডেস্ক থেকেই। ২০২০ সালে বেলারুশ সরকার যখন হুট করে ৩৩ জন রুশ নাগরিককে গ্রেপ্তার করেছিল, তখন পুতিন নিজ উদ্যোগে তাদের ছাড়ানোর ব্যবস্থা করেছিলেন। এই ৩৩ জন সম্ভবত ওয়াগনার গ্রুপের সদস্য ছিলেন। কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্নার্ড কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক কিম্বার্লি মার্টেন বলেন, ‘এগুলো বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা ছিল না।’

পুতিনের বিরুদ্ধে অভিযোগ, সিরিয়ার আন্দোলনকারীদের দমন করতেও তিনি এই ওয়াগনার বাহিনীকে কাজে লাগিয়েছিলেন। একসময় ওয়াগনার বাহিনী এতটাই বিপজ্জনক হয়ে ওঠে যে রুশ সরকারও তাঁদের অর্থ দিতে অস্বীকার করে। এর পরে দৃশ্যপটে আসেন পুতিনের এক বন্ধু। এই গোষ্ঠী নিয়ন্ত্রণে পুতিন নিযুক্ত করেন তাঁর বন্ধু ইয়েভজেনি প্রিগোজিনকে। এ বাহিনীর সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে ভ্লাদিমির পুতিনের দিকেও আঙুল তোলা যায়। তবে পুতিনের একটি বড় সুবিধা হচ্ছে, এসব ভাড়াটে সেনার কথা অস্বীকার করা। তিনি তা–ই করে আসছেন। অনেক ক্ষেত্রে ভাড়াটে সেনারা বিচ্ছিন্নতাবাদী যোদ্ধা হিসেবে ভালো ফল এনে দেন।

লিবিয়ার একটি সশস্ত্র গোষ্ঠীর নেতা খলিফা হাফতারের অনুসারী এক যোদ্ধা বসে রয়েছেন
ছবি: রয়টার্স

অনেক বিশ্লেষকের মতে, ক্রেমলিনের সঙ্গে ওয়াগনার বাহিনীর যোগসূত্র নিছকই কল্পনা। তবে বর্তমানে ইউক্রেনের যে পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে, তাতে সেখানে ওয়াগনার গ্রুপের উপস্থিতি অস্বীকার করতে পারেন না পুতিন। এই ভাড়াটে সেনাদের কাছ থেকে যে সেবা তিনি পেতে পারেন, তা নিজস্ব সেনাবাহিনীর কাছ থেকে আশা করা দুষ্কর।

কারণ, সেনাবাহিনীর সদস্য মারা গেলে তাঁর পরিবার এ নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারে। কিন্তু ভাড়াটে সেনার ক্ষেত্রে নিয়োগ অস্বীকার করলেও চলে। রাশিয়ার আইন অনুযায়ী, এ ধরনের ভাড়াটে সেনা ব্যবহারের কোনো সুযোগ নেই। তবে ২০১৮ সালে পুতিন এ ধরনের সেনার অস্তিত্ব স্বীকার করেন। তাঁদের কার্যকলাপ রাশিয়ার বাইরে রয়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি। পুতিন তখন বলেন, তাঁদের বিশ্বের যে কোনো জায়গায় কাজ করার এবং তাঁদের ব্যবসায়িক স্বার্থ প্রচার করার অধিকার রয়েছে।

ওয়াগনারের পেছনে কারা

পুতিন–ঘনিষ্ঠ রাশিয়ার অভিজাত ধনকুবের ইয়েভজেনি প্রিগোজিন এই ওয়াগনার বাহিনীর মূল পৃষ্ঠপোষক। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, ক্রেমলিনের বিশেষ বিশেষ দায়িত্ব তাঁকে দিলে তিনি তা সমাধান করে দেন। প্রিগোজিনকে যুবক বয়সে সোভিয়েত কারাগারে যেতে হয়েছিল। সেখান থেকে মুক্তি পেয়ে তিনি সেন্ট পিটার্সবার্গে একটি হটডগের দোকান খোলেন। এরপর শুরু করেন রেস্তোরাঁ ব্যবসা। তাঁকে কেউ কেউ ‘পুতিনের রাঁধুনি’ বলে থাকেন। রেস্তোরাঁ ব্যবসা শুরুর পর তিনি এতে নানা বৈচিত্র্য যোগ করেন, যা দেশটির অভিজাত শ্রেণির নজরে আসে। পুতিন যখন ২০০০ সালে প্রথম প্রেসিডেন্ট হন, তখন থেকেই প্রিগোজিনের রেস্তোরাঁয় বিশেষ অতিথিদের আনাগোনা শুরু হয়। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ পর্যন্ত নেভা নদীতে ভাসমান প্রিগোজিনের মালিকানাধীন রেস্তোরাঁ ‘নিউ আইল্যান্ড’–এ খাবার খেয়েছেন। এরপর থেকেই সশস্ত্র বাহিনীর নানা কাজ পেতে শুরু করেন প্রিগোজিন।

পুতিনের ঘনিষ্ঠ হওয়ায় পরে আরও গুরুতর মিশনের দায়িত্ব পড়ে প্রিগোজিনের ওপরে। ওয়াগনারের দায়িত্ব নেওয়ার পাশাপাশি ইন্টারনেটভিত্তিক বিভিন্ন কর্মসূচি পরিচালনা শুরু করেন। এর মধ্যে ইন্টারনেট রিসার্চ এজেন্সির নামটি পরিচিত হয়ে উঠেছে। ২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে হস্তক্ষেপ ও অনলাইনে বিভ্রান্তি ছড়ানোর জন্য মার্কিন কৌঁসুলি রবার্ট মুলার প্রিগোজিনের ওই প্রতিষ্ঠানকে অভিযুক্ত করেছিলেন। অভিযোগ রয়েছে, ইউক্রেনে হামলা শুরুর পরপরই প্রিগোজিনকে ক্রেমলিনে তলব করা হয়। এর পরপরই ওয়াগনার বাহিনী সক্রিয় হয়ে ওঠে। এর আগে বিশেষ অভিযান চালানোর জন্য এই বাহিনীকে পূর্ব আফ্রিকায় মোতায়েন করেছিল ক্রেমলিন। রাশিয়ার পক্ষ থেকে কখনো এসব অভিযোগ স্বীকার করা হয়নি।

ইউক্রেনে ওয়াগনার বাহিনীর অস্তিত্ব নিয়ে বহু জল্পনা থাকলেও ২০১৪ সালে দনবাস অঞ্চলে তাদের কার্যকলাপ প্রথম প্রকাশ্যে আসে। ধারণা করা হয়, প্রাথমিকভাবে কয়েক শ অভিজ্ঞ সেনাকে সেখানে পাঠানো হয়। দনবাসের বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতারা ক্রেমলিনের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করলে, তাঁদের শাস্তির ব্যবস্থা করত এ বাহিনী। তবে হত্যাকাণ্ডের দায় ইউক্রেনের সামরিক বাহিনীর ওপরে গিয়ে পড়ত।

যেভাবে কাজে লাগানো হয় এই যোদ্ধাদের

ওয়াগনারের ভাড়াটে সেনাদের শুধু যুদ্ধ নয়, নানা কাজে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। প্রয়োজনের ভিত্তিতে বিভিন্ন দেশে তাদের নিয়োগ করা হয়। এরই মধ্যে সিরিয়া, লিবিয়া, মালি এবং সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিকসহ অনেক দেশে সক্রিয় রয়েছে গ্রুপটি।

সুদান ও ভেনেজুয়েলার মতো দেশে পুতিনের সমর্থনকারী সরকার বসানোর জন্যও এই গ্রুপ কাজ করে থাকে। প্রায় ১০ হাজার সেনা ওয়াগনারের হয়ে কাজ করছেন বলে ধারণা করা হয়। যাঁদের বেশির ভাগেরই রুশ সেনাবাহিনীর হয়ে যুদ্ধের অভিজ্ঞতা রয়েছে। এর নিয়োগদাতারা বলেন, ওয়াগনার গ্রুপে নিয়োগ পেতে হলে বিশেষ সামরিক দক্ষতা থাকতে হয়। তবে কোনো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের রেকর্ড থাকা যাবে না।

ওয়াগনারে একবার নাম লেখাতে পারলে বেতনও অনেক ভালো। আফ্রিকায় কর্মরত ওয়াগনারের সদস্যরা প্রতি মাসে চার হাজার মার্কিন ডলারের বেশি বেতন পেয়ে থাকেন।

ওয়াগনারের ভাড়াটে সেনারা মূলত রাশিয়ার স্বার্থসংশ্লিষ্ট অঞ্চলে তাদের কার্যক্রম চালায়। তবে তাদের আয়ের আরও নানা পথ রয়েছে। মালি বা মধ্য আফ্রিকা অঞ্চলে এর কার্যক্রম পরিচালনার জন্য স্থানীয় সরকারই ওয়াগনারকে অর্থ জোগান দিয়ে থাকে। এখানে দৃশ্যপটে আসেন এ গ্রুপের পৃষ্ঠপোষক ব্যবসায়ী ইয়েভজেনি প্রিগোজিন। তাঁর ব্যবসাসংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো সোনা বা হীরার খনির বিনিময়ে চুক্তি করে।

সিরিয়া বা মালি থেকে প্রতি মাসে এক কোটি মার্কিন ডলারের বেশি ওয়াগনারের কাছে যায় বলে ধারণা করেন বিশ্লেষকেরা।

ইউক্রেনে কতটা সুবিধা করতে পারবে ভাড়াটে সেনারা

ইতিমধ্যে ইউক্রেনের পূর্ব ও দক্ষিণাঞ্চল দখলের পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছেন রুশ সেনারা। ১ লাখ ৯০ হাজার সেনা লড়াই করছেন মাঠে। নিয়মিত নির্দিষ্ট লক্ষ্যে বোমা হামলা করা হচ্ছে। এত বড় যুদ্ধক্ষেত্রে কয়েক হাজার ভাড়াটে সেনা রাশিয়ার বড় লক্ষ্য অর্জনের ফলাফলে তেমন কোনো প্রভাব ফেলবেন না বলেই বিশেষজ্ঞদের মত। তবে এসব সেনার নিষ্ঠুরতা ইউক্রেনকে শঙ্কিত করে তুলতে পারে। এর আগে ওয়াগনারের ভাড়াটে সেনা হিসেবে যাঁদের নিয়োগ দেওয়া হতো, সবার অভিজ্ঞতা যাচাই করা হতো।

লিবিয়ার জামজাম এলাকায় টহল দিচ্ছে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা
ছবি: রয়টার্স

কিন্তু ইউক্রেনে ভাড়াটে সেনা নিয়োগে যাচাই–বাছাই করা হচ্ছে না। কম অভিজ্ঞ বা অতীতের কুখ্যাতি ও সন্দেহভাজন কার্যক্রম থাকলেও তাঁরা নিয়োগ পেয়ে যাচ্ছেন।

ভাড়াটে সেনাদের নজরদারি করা রুশ সাংবাদিক ইলিয়া রোজডেস্টভেনস্কি বলেন, ইউক্রেনে ভাড়াটে সেনা নিয়োগের ক্ষেত্রে কোনো বাছবিচার করা হচ্ছে না। সবাইকে গণহারে নেওয়া হচ্ছে।

মাঝে একবার পুতিনের বন্ধু প্রিগোজিনের সঙ্গে রুশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোইগুসহ কয়েকজন সামরিক কর্মকর্তার সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হয়। ২০১৮ সালে মার্কিন বিমান হামলায় পূর্ব সিরিয়ার দেইর আল-জোরের কাছে প্রায় ২০০ ভাড়াটে সেনা নিহত হন। এ হামলা ঠেকাতে রুশ সেনাবাহিনীর অনীহার অভিযোগ ওঠে। তবে ক্রেমলিনের সঙ্গে প্রিগোজিনের ঘনিষ্ঠতার কারণে এ ধরনের বিপত্তি কাটিয়ে উঠেছে গ্রুপটি। কারণ, প্রিগোজিনের ব্যবসার সঙ্গে ওয়াগনারের সফলতা জড়িত। ২০১৪ সাল থেকে দনবাসে প্রেসিডেন্ট পুতিনের লক্ষ্য পূরণে এ গোষ্ঠী কাজ করছে। সিরিয়ায় ইসলামিক স্টেটের কাছ থেকে পালমিরা শহর পুনরুদ্ধার এবং বাশার আল-আসাদকে ক্ষমতায় রাখতে রাশিয়ার সশস্ত্র বাহিনীকে সাহায্য করার ক্ষেত্রে মূল ভূমিকা পালন করেছে ওয়াগনার।

কিন্তু এ গ্রুপের ব্যর্থতাও উল্লেখ করার মতো। ২০১৯ সালে উত্তর মোজাম্বিকে জিহাদিদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ওয়াগনারের সাত সেনা নিহত হন। তখন দ্রুত পালিয়ে আসে এ গ্রুপটি। লিবিয়ায় এ গ্রুপের নৃশংসতার বিষয়টি যুদ্ধাপরাধের পর্যায়ে পড়ে।

জাতিসংঘের প্রতিবেদনে মালিতেও এ বাহিনীর নৃশংসতার বিষয়টি আলোচিত।
ইউক্রেনের নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযোগ, হামলা শুরুর পর থেকেই প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিসহ অন্যান্য কর্মকর্তাদের হত্যার জন্য ভাড়াটে সেনাদের নিয়োগ দেয় রাশিয়া। তবে বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, এ ধরনের মিশনের জন্য তাঁদের ব্যবহার করা অসম্ভব। এখন পর্যন্ত ইউক্রেনে এ বাহিনীর প্রভাব খুব বেশি চোখে পড়েনি; বরং এসব সেনা এখন রুশ বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে থাকা দোনেৎস্ক ও লুহানস্কে কর্মকাণ্ড চালাতে পারেন। তাঁরা বিচ্ছিন্নতাবাদীদের শক্তিশালী করতে কাজ করছেন।

এর আগে ২৮ মার্চ যুক্তরাজ্যের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানায়, ওয়াগনারের জ্যেষ্ঠ নেতাসহ পূর্ব ইউক্রেনে এক হাজারেরও বেশি ভাড়াটে সেনা মোতায়েন করা হতে পারে। রুশ সাংবাদিক ইলিয়া বারাবানভ বলেন, ইউক্রেনে ওয়াগনারের যেসব যোদ্ধা গেছেন, তাঁরা অনেকটাই নতুন। তাঁদের বলা হচ্ছে, ‘রাশিয়ান লিগ’–এর সদস্য। তাঁদের প্রতি মাসে ২ লাখ রুবল বেতন দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। তাঁরা রাশিয়ার সেনা সদস্যদের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি বেতন পাচ্ছেন।

রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সোইগু প্রেসিডেন্ট পুতিনের কাছে দাবি করেছিলেন, মধ্যপ্রাচ্য থেকে ১৬ হাজারের বেশি স্বেচ্ছাসেবী ইউক্রেন যুদ্ধে যোগ দিতে চান। আফ্রিকা থেকেও অনেকে এই যুদ্ধে আসতে চান। যদিও এখন পর্যন্ত ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্রে তাঁদের তেমন চোখে পড়েনি। অনেক ক্ষেত্রে এসব ভাড়াটে সেনাকে যুদ্ধের চেয়ে অন্য কাজে জড়িয়ে পড়তে দেখা যায়। সিরিয়ায় ওয়াগনারের ভাড়াটে সেনাদের অনেকেই চুরি ও মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েছেন বলে বিশ্লেষকদের ধারণা।

দ্য ইকোনমিস্ট অবলম্বনে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন মো. মিন্টু হোসেন