শুধু দুপক্ষ নয়, খেলছে রাশিয়া–তুরস্ক–ইরানও

গোলার আঘাতে বিধ্বস্ত ভবনের ধ্বংসস্তূপ থেকে হতাহতদের উদ্ধার তৎপরতা। এ সময় এক ব্যক্তির লাশ বের করে আনেন উদ্ধারকর্মীরা। গতকাল আজারবাইজানের গানজা শহরে
ছবি: রয়টার্স

দুই সপ্তাহ ধরে নাগোরনো-কারাবাখ অঞ্চলে উত্তেজনা চলছে। মুখোমুখি অবস্থানে আজারবাইজান ও আর্মেনিয়া। তবে এই যুদ্ধের আগুন কিন্তু এক দিনে জ্বলেনি। ২৬ বছর ধরে এই আগুনে ঘি ঢেলেছে নানা পক্ষ। এভাবেই নাগোরনো-কারাবাখে শুরু হয়েছে বুলেট-বোমার রাজত্ব।

যুক্তরাজ্যের সংবাদমাধ্যম বিবিসির তথ্যমতে, আজারবাইজান ও আর্মেনিয়া একসময় সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত ছিল। নাগোরনো-কারাবাখ নিয়ে এই দুটি দেশের মধ্যে প্রথম যুদ্ধ শুরু হয় গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকে। সেই যুদ্ধে প্রাথমিকভাবে আজারবাইজানের বেশ কিছু এলাকা দখল করে নিয়েছিল আর্মেনিয়া। যুদ্ধে প্রায় ৩০ হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল, বাস্তুচ্যুত হয়েছিল আজারবাইজানের ৬ লাখ মানুষ। পরে ১৯৯৪ সালের যুদ্ধবিরতির মধ্য দিয়ে ওই সংঘাতের যবনিকা টানা হয়। কিন্তু আর্মেনিয়ার কাছে ভূখণ্ড হারানোর বিষয়টি এখনো ভুলতে পারেনি আজারবাইজান। তারই জের এখনকার সংঘাত, রক্তপাত। সবচেয়ে বড় কথা, করোনা মহামারির মধ্যে এই প্রথম যুদ্ধের দামামা বেজে উঠল বিশ্বে।

সংঘাতের পটভূমি

আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার এই যুদ্ধের কারণ হিসেবে ভূখণ্ড নিয়ে দ্বন্দ্ব যতটা দায়ী, ঠিক ততটাই দায়ী নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যের ভিন্নতা। এ-সংক্রান্ত বিরোধ শুরু হয়েছিল সোভিয়েত আমলেই। ভক্স ডট কমে প্রকাশিত এক নিবন্ধে বলা হয়েছে, ১৯২১ সালে সোভিয়েত নেতা জোসেফ স্তালিন আজারবাইজানের কাছে নাগোরনো-কারাবাখ অঞ্চল হস্তান্তর করেছিলেন। এর দুই বছরের মাথায় একে স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের মর্যাদা দেওয়া হয়। সমস্যা হলো, ওই সময় নাগোরনো-কারাবাখের মোট জনসংখ্যার ৯০ শতাংশ ছিল আর্মেনীয় এবং তাঁদের বেশির ভাগই ছিলেন খ্রিষ্টান। অথচ আজারবাইজান মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ। সমস্যার শুরু তখন থেকেই। দিন দিন তা শুধু বেড়েছে।

সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন যখন বিলুপ্তির পথে, তখন দুই দেশই নাগোরনো-কারাবাখে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় ব্যস্ত হয়ে ওঠে। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর আজারবাইজান ও আর্মেনিয়া স্বাধীন দেশ হিসেবে আবির্ভূত হয়। এরপরই দেশ দুটি জড়িয়ে পড়ে যুদ্ধে। যদিও ১৯৮৮ সাল থেকেই তাদের মধ্যে উত্তেজনা চলছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর সেই উত্তেজনা লাগামছাড়া হয়ে সরাসরি যুদ্ধের রূপ নেয়। এই যুদ্ধে অবশ্য সরাসরি প্রতিপক্ষ ছিল আজারবাইজান ও নাগোরনো-কারাবাখের স্থানীয় আর্মেনীয় জাতিগোষ্ঠী। সে যুদ্ধের আপাত সমাপ্তি ঘটে মধ্যস্থতা চুক্তির মাধ্যমে। এরপর সেখানকার প্রায় ২০ শতাংশ এলাকা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয় আর্মেনিয়া।

রাশিয়ার প্রত্যক্ষ মধ্যস্থতায় হওয়া এই যুদ্ধবিরতি সেই থেকে কার্যকরই ছিল। কিন্তু গত মাসের ২৭ তারিখ তা ভেঙে পড়ে। এর পেছনে যেমন আছে আঞ্চলিক রাজনীতি ও অস্ত্র ব্যবসা, তেমনি আছে ২৬ বছর আগের ‘অপমান’। বার্তা সংস্থা এএফপির তথ্যমতে, এবারের এই সংঘাতে এরই মধ্যে সাড়ে চার শতাধিক মানুষ হারিয়েছে, আহত হয়েছে অনেকে। ঘরছাড়া হয়েছে হাজারো মানুষ। এবারের সংঘাতের জন্য দুই দেশই পরস্পরকে দোষারোপ করছে।

আজারবাইজান-আর্মেনিয়ার অবস্থা

২৬ বছর আগের যুদ্ধে আজারবাইজান কোণঠাসা হয়ে পড়লেও এবার পরিস্থিতি ভিন্ন। এতদিনে অর্থনৈতিক ও সামরিক—দুই ক্ষেত্রেই আর্মেনিয়াকে পেছনে ফেলেছে আজারবাইজান। যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যম নিউইয়র্ক টাইমস-এর এক নিবন্ধে বলা হয়েছে, তেল-গ্যাসের মতো প্রাকৃতিক সম্পদে আজারবাইজান সমৃদ্ধ। এর বাণিজ্যিক সুবিধা নিয়েই তেল রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে দেশটি।

অর্থনৈতিক এই জোয়ার সামরিক খাতেও এগিয়ে দিয়েছে আজারবাইজানকে। আর্মেনিয়ার তুলনায় সামরিক খাতে আজারবাইজানের খরচ কয়েক গুণ বেশি। ট্যাংক, যুদ্ধবিমান, আর্টিলারি—সবকিছুতেই প্রতিপক্ষের চেয়ে এগিয়ে দেশটি। সব মিলিয়ে দক্ষিণ ককেশাস অঞ্চলে আজারবাইজানকে ডিঙিয়ে যাওয়া আর্মেনিয়ার জন্য এখন কঠিন। অবশ্য তারপরও নাগোরনো-কারবাখে ছেড়ে কথা বলছে না আর্মেনিয়া।

তুরস্ক, রাশিয়া ও ইরানের খেলা

দুই দেশের যুদ্ধে ‘ছায়াসঙ্গী’ হয়েছে আরও তিন দেশ। এএফপির খবরে বলা হয়েছে, তুরস্ক সরাসরি আজারবাইজানের পক্ষ নিয়েছে। এর পেছনে আঞ্চলিক রাজনীতিতে তুরস্কের প্রভাব বিস্তার করার বাসনা বড় ভূমিকা রেখেছে। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ অভিযোগ করেছেন, আজারবাইজানের সমর্থনে নাকি সিরিয়ার যোদ্ধাদের বিক্ষুব্ধ এলাকায় পাঠিয়েছে রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের সরকার। যদিও আজারবাইজান ও তুরস্ক—দুই পক্ষই এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে। আর্মেনিয়াও অভিযোগ করেছে, গত ২৯ সেপ্টেম্বর আজারবাইজান থেকে উড্ডয়ন করা তুরস্কের এফ-১৬ যুদ্ধবিমান আর্মেনিয়ার একটি যুদ্ধবিমানকে ভূপাতিত করেছে। এই অভিযোগও অস্বীকার করেছে তুরস্ক।

ওয়াশিংটন পোস্ট-এর এক নিবন্ধে বলা হয়েছে, আর্মেনিয়া ও আজারবাইজান—অনেকটা দুই পক্ষেই রয়েছে রাশিয়া। তবে আর্মেনিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বেশি। দেশটিতে রাশিয়ার সামরিক ঘাঁটি রয়েছে। এ ছাড়া দেশটি রুশ অস্ত্রেরও ক্রেতা। অন্যদিকে আজারবাইজানের কাছেও অস্ত্র বিক্রি করে ভ্লাদিমির পুতিনের দেশ। ফলে দুই ক্রেতার মধ্যে হওয়া যুদ্ধে পক্ষাবলম্বন নিয়ে সমস্যায় পড়েছে মস্কো। বিশ্লেষকেরা বলছেন, আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার যুদ্ধ শেষতক রাশিয়া ও তুরস্কের ‘ছায়াযুদ্ধে’ পরিণত হতে পারে। ঠিক যেমনটা সিরিয়া ও লিবিয়ায় হচ্ছে।

অন্যদিকে ইরানের সীমান্ত কারাবাখ অঞ্চল লাগোয়া। তবে ধর্মনিরপেক্ষ আজারবাইজানের সঙ্গে দেশটির ঠিক বনে না। অবশ্য আর্মেনিয়াকে গোপনে সহায়তা দেওয়ার কথা অস্বীকার করেছে ইরান।

নাগোরনো-কারাবাখ ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের চূড়ান্ত অনুপস্থিতি পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলেছে। এই অঞ্চলে সংঘাত নিরসনের আহ্বানের মধ্যেই দেশটির ভূমিকা বরাবরই সীমিত। ঐতিহাসিকভাবেই দক্ষিণ ককেশাস এলাকায় রাশিয়ার প্রভাব বেশি। যুক্তরাষ্ট্রও ওই অঞ্চলে প্রভাব বাড়ানোর চেষ্টা করেনি। যুক্তরাজ্যের সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে কারনেগি ইউরোপের জ্যেষ্ঠ ফেলো থমাস ডি ভাল বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র এই ইস্যু থেকে নিজেদের সরিয়ে নিয়েছে।

যুদ্ধবিরতি সত্ত্বেও সংঘাত

রাশিয়ার মধ্যস্থতায় শনিবার স্থানীয় সময় দুপুর থেকে যুদ্ধবিরতি শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এর আগে থেকেই আজারবাইজান ও আর্মেনিয়া পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধবিরতির শর্ত লঙ্ঘনের অভিযোগ করতে শুরু করে। সর্বশেষ আজারবাইজান অভিযোগ করেছে, শনিবার দিবাগত রাতে দেশটির দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর গানজায় গোলা নিক্ষেপ করেছে আর্মেনিয়া। এতে সাতজন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ৩৩ জন।

এক প্রত্যক্ষদর্শী এএফপিকে বলেছেন, বিকট বিস্ফোরণের শব্দে রাতে তাঁর ঘুম ভেঙে যায়। এতে কয়েকটি বাড়ি পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে নয়টি ভবন।