সান্না যেন শাণ দেওয়া এক কন্যা

সান্না মারিন
সান্না মারিন

সান্না মারিন কেবল দেশেরই নন, সারা বিশ্বেরই সর্বকনিষ্ঠ প্রধানমন্ত্রী। বয়স কম হলেও তাঁর অর্জনে কমতি নেই। পেরিয়ে এসেছেন নানা চড়াই–উতরাই। রাজনীতির অঙ্গনে ভাবমূর্তি আর কারিশমায় সান্না যেন বুদ্ধিমত্তায় শাণ দেওয়া এক কন্যা।

খুব সাধারণ পরিবার থেকে উঠে এসেছেন সান্না। আর দশটি শিশুর মতো স্বাভাবিক ছিল না তাঁর বেড়ে ওঠা। অল্প বয়সে তাঁর মা-বাবার বিচ্ছেদ ঘটে। মায়ের কাছেই বেড়ে ওঠা। চরম আর্থিক সংকট ছিল পরিবারে। এতটাই যে মাত্র ১৫ বছর বয়সে একটি বেকারিতে কাজ নেন। স্কুলে পড়াশোনার পাশাপাশি হাত খরচের জন্য ম্যাগাজিন বিক্রি করে বেড়াতেন তিনি।

আরও ভয়ানক পারিবারিক সংকটের মুখোমুখি হতে হয়েছে সান্নাকে। তাঁর মা একজন সমকামী। মায়ের এই ভিন্নতার জন্য ছোটবেলা থেকেই কঠিন বাস্তবতার শিকার হতে হয়েছে তাঁকে। যেন সব সময়ই একটা ‘কলঙ্কের’ বোঝা বয়ে বেড়াতে হয়েছে। পরিবার নিয়ে কখনোই গর্ব করে কথা বলতে পারেননি। সব সময় ‘হীনম্মন্যতাবোধ’ কাজ করেছে। এটা এমন বিষয় ছিল, যা নিয়ে আসলেই প্রকাশ্যে কথা বলতে পারেননি তিনি।

সান্নার এই কঠিন সময়ে সারাক্ষণ মেয়ের পাশে ছিলেন সেই মা। তিনি মেয়েকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন—তিনি যা চান, তা করার অধিকার তাঁর আছে।

পারিবারিক এই বৈচিত্র্যতাই ঋদ্ধ করেছে সান্নাকে। সমতা, নিরপেক্ষতা ও মানবাধিকারের মতো বিষয়গুলো তিনি পরিবার থেকেই শিখেছেন।

সান্নাই তাঁর পরিবারের একমাত্র সদস্য, যিনি স্কুলজীবন শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডিতে পা রেখেছেন। ২০ বছর বয়সে রাজনীতিতে তাঁর হাতেখড়ি। মাত্র দুই বছরের মাথায় রাজধানী হেলসিংকির উত্তরে টামপিরি শহরের কাউন্সিলর পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। তবে হেরে যান। কিন্তু পরবর্তী পাঁচ বছরের মধ্যে তিনি শুধু জিতেই ক্ষান্ত হননি, কাউন্সিলরদের নেতা বনেও যান। তখন তাঁর বয়স ২৭ বছর।

কাউন্সিলর নির্বাচিত হওয়ার পর দেশটির মধ্য–বামপন্থী দল সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টিতে (এসডিপি) তাঁর দ্রুত উন্নতি হতে থাকে। ২০১৫ সালে এমপি নির্বাচিত হন। দলে বামপন্থী হিসেবেই তাঁর পরিচিতি।

দলের শীর্ষে পৌঁছাটা ছিল সান্নার জন্য অনিবার্য। একজন যোগ্য নেতা হিসেবে তিনি দ্রুত দলের শীর্ষ নেতা অ্যান্তি রিনের মনোযোগ আকর্ষণ করেন। তাঁর ডেপুটি হওয়ার পাশাপাশি খুব কাছের পাত্রে পরিণত হন সান্না।

গত শীতেই নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হন অ্যান্তি রিন। তাঁর রক্ত জমাট বেঁধে যায়। তিনি তাঁর কার্যক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন। অথচ সেই সময় তাঁর দল ছিল নির্বাচনী প্রচারণার তুঙ্গে। এটাই সুযোগ এনে দেয় সান্নাকে।

পরবর্তী সময়ে অ্যান্তি রিন সুস্থ হয়ে ওঠেন। তাঁর দলও নির্বাচনে জয়লাভ করে। সান্নাকে নতুন মন্ত্রিসভায় পরিবহন ও যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু মোটেও সুখকর হলো না তাঁর প্রথম যাত্রা। ডাক ধর্মঘটের মুখে দায়িত্ব নেওয়ার কয়েক মাসের মাথায় পদত্যাগ করতে বাধ্য হলেন সান্নার সরকারপ্রধান অ্যান্তি রিন।

এটাই শাপেবর হলো সান্নার জন্য। দলের আস্থা ভোটে জিতে যান তিনি। অ্যান্তি রিনের উত্তরসূরি হিসেবে দায়িত্ব নিলেন। হয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু চলমান সংকটে তিনিও টিকতে পারবেন কি না, সেই প্রশ্নও ইতিমধ্যে উঠেছে। তবে তা পাত্তা দেন না সান্না। বললেন, ‘আমি আমার বয়স বা লিঙ্গ নিয়ে কখনোই ভাবি না। বরং যে কারণে আমি রাজনীতিতে এসেছি এবং যেসব কারণে আমরা ভোটারদের আস্থা অর্জন করেছি, সেসব নিয়েই ভাবছি।’ তাঁর মতে, জোটের শরিক দলগুলোর ও ভোটারদের আস্থা অর্জনই হবে তাঁর প্রথম ও প্রধান কাজ।

কিন্তু সান্না এমন সময়ে সরকারপ্রধানের দায়িত্ব নিতে যাচ্ছেন, যখন দেশটিতে আরও ধর্মঘটের হুমকি দেওয়া হচ্ছে। এটা হলে দেশটির বড় কিছু কোম্পানির উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাবে। অধিকন্তু, জনপ্রিয় ট্রু ফিনস পার্টি নির্বাচনে প্রায় ২৫ শতাংশ ভোট পেয়েছে। পক্ষান্তরে এসডিপি ও তার জোটের শরিক দলগুলোর ভোট কমেছে।

সান্না ফিনল্যান্ডের তৃতীয় নারী প্রধানমন্ত্রী। এর আগে ২০০৩ সালে প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হন অ্যানেলি জাত্তিমাকি। তবে তিনি মাত্র দুমাসের একটু বেশি ক্ষমতায় টিকতে পেরেছিলেন। আর দ্বিতীয় নারী প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ম্যারি কিভিনিয়েমি। ২০১০ সালে নির্বাচিত এই প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতায় ছিলেন মাত্র এক বছর।

কিন্তু সান্নার অভিযানটা পূর্বসূরিদের চেয়ে দীর্ঘ হতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে। চার বছরের জন্য ক্ষমতায় এসেছে তাঁর জোট সরকার। মেয়াদের মাত্র ছয় মাস গেছে। এখনো সাড়ে তিন বছর বাকি। তাই প্রত্যাশা করাই যায়, সান্নার অভিযানটি হবে অন্যদের থেকে দীর্ঘ। তথ্যসূত্র: বিবিসি ও এএফপি