যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের ‘ইরান প্রকল্প’ এবার সফল হবে না

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মো. বায়েজিদ সরোয়ার, নিরাপত্তা বিশ্লেষক

ইতিহাস বলছে, ১৯৪৮, ’৫৮, ’৬৭ ও ’৭৩ সালে আরব দেশগুলোর সঙ্গে যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন পরাশক্তি ইসরায়েলকে সাহায্য করেছিল। যে কারণে আরব দেশগুলোর পরাজয় ঘটেছিল। সামরিক সক্ষমতার তুলনামূলক বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, বিশ্বে ইরানের অবস্থান ১৪তম আর ইসরায়েল ১৭তম। সৈন্যসংখ্যার দিক দিয়ে ইরান ইসরায়েলের চেয়ে অনেক গুণ বড়। তবে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতায় ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী প্রযুক্তিগত উৎকর্ষে অনেক এগিয়ে রয়েছে। ইসরায়েল এবার দেড় হাজার মাইল দূর থেকে ইরানে বিমান হামলা বেশি দিন চালাতে পারবে না। তবে তার আরেকটি শক্তি যুক্তরাষ্ট্র এরই মধ্যে ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালিয়ে ব্যাপক ক্ষতিসাধন করেছে বলে দাবি করেছে। সে ক্ষেত্রে ইসরায়েল-যুক্তরাষ্ট্র যৌথভাবে ক্রমাগত বিমান হামলা চালালে ইরানের অবকাঠামোগত দিক থেকে ব্যাপক ক্ষতি হবে, তা নিসন্দেহে বলা যায়।

১৯৫৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র ইরানের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ মোসাদ্দেককে উৎখাতের জন্য এজেন্ট না পাঠালে (অপারেশন আয়াক্স) ইরান হয়তো গণতন্ত্রের পথেই এখন থাকত। লেখক স্টিফেন কিনজার তাঁর ‘অল দ্য শাহ’জ মেন’ বইতে এমনটাই লিখেছেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে নতুন করে ইরান আক্রমণের বিষয়ে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন।

ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি
ফাইল ছবি: রয়টার্স

কেন জানি মনে হচ্ছে, ইরানে নিজেদের পছন্দমতো ব্যক্তিদের ক্ষমতায় বসানোর পাশাপাশি দেশটাকে হাতের মুঠোয় নিয়ে মধ্যপ্রাচ্য কবজা করতে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের ‘ইরান প্রকল্প’ এবার সফলতার মুখ দেখবে না। কারণ, ২০০৩ সালের ইরাক আক্রমণের সময় বিশ্ব পরিস্থিতি এবং বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতি এক নয়।

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে ফিলিস্তিনের গাজায় প্রতিদিন হামলা চালাচ্ছে বর্বব ইসরায়েলি প্রতিক্ষা বাহিনী (আইডিএফ)। এখন পর্যন্ত ইসরায়েলের হামলায় গাজায় অন্তত ৫৫ হাজার ৭০৬ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, যাঁদের বেশির ভাগই নারী ও শিশু। লাখ লাখ মানুষ চিরতরে পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন। ঘরছাড়া হয়েছে কয়েক লাখ মানুষ। ইসরায়েলি বাহিনী এই সময়ে গাজার ১৫ হাজারের বেশি শিশুকে হত্যা করেছে।

যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের দ্বারা ইরানের রেজিম বা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির আশীর্বাদপুষ্ট বর্তমান সরকারের পরিবর্তন হলে দেশটিতে চরম বিশৃঙ্খলা তৈরি হবে। তাই ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের আশীর্বাদপুষ্ট নতুন নেতৃত্বের আশা এবার অন্তত পূরণ হবে না। ইসরায়েলের অযৌক্তিক হামলার কারণে ইরানের জনগণের মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনা বেড়ে যাচ্ছে বলে তাদের সাম্প্রতিক প্রতিক্রিয়ায় মনে হচ্ছে
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মো. বায়েজিদ সরোয়ার, নিরাপত্তা বিশ্লেষক

গাজায় গণহত্যার দায়ে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি বিশ্ববাসীর সমর্থন অনেকটা কমে গেছে। খোদ যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিনিয়ত গাজায় গণহত্যা বন্ধে বিক্ষোভ হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকেরাও গাজা যুদ্ধের তীব্র সমালোচনা করে প্রকাশ্যে বক্তব্য দিচ্ছেন। তবে বাস্তবতা হলো, প্রথমবারের মতো ইসরায়েলের হার্টল্যান্ডে ইরানের হামলায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতিতে ইসরায়েলি জনগণের মনোবল ভেঙে গেছে বলে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রচারিত হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও ইরানের হামলার ভিডিও ব্যাপকভাবে ছড়িয়েছে। তাই ইসরায়েলের ‘অজেয় ভাবমূর্তি’ এখন আর নেই বললেই চলে।

ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর একটি অনুষ্ঠানে দেশটির সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি। ইমাম আলী একাডেমি, তেহরান, ইরান
ছবি: ইরানের সর্বোচ্চ নেতার ওয়েবসাইট

ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় যুক্তরাষ্ট্রের হামলার জবাবে ইরান যে পালটা ব্যবস্থা নিতে পারে, তা হলো সরাসরি সামরিক প্রতিরোধ করতে পারে, প্রক্সি বাহিনীর মাধ্যমে হামলা করতে পারে, হরমুজ প্রণালি বন্ধ করে দিতে পারে এবং বিশ্বব্যাপী সাইবার হামলা চালাতে পারে। তবে ইরান সম্ভবত সরাসরি আক্রমণ না করে অপ্রত্যক্ষ যুদ্ধ ও আঞ্চলিক উত্তেজনা ছড়িয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের মিত্রদের চাপে ফেলতে পারে। যদিও এরই মধ্যে ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীরা যুক্তরাষ্ট্রের জাহাজে হামলার হুমকি দিয়েছে।

আমার মতে, ইসরায়েল চাইবে ক্রমাগত বিমান হামলা করে ইরানকে পর্যুদস্ত করে তুলতে। কিন্তু তাতেও যদি তারা পুরোপুরি সফল না হয়, তাহলে দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধ ছাড়া তাদের বিকল্প নেই। যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় ইসরায়েল যদি ইরানের বিরুদ্ধে দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধে লিপ্ত হয়, তাহলে সেই যুদ্ধে ইরান প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হবে বলে আমার ধারণা। কারণ, ইরান ৪০ বছর ধরে সামরিক শক্তি ও কৌশলগত দিক থেকে নিজেদের অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে।

ইরানের কোম শহরের কাছে ফর্দো ভূগর্ভস্থ পারমাণবিক স্থাপনায় যুক্তরাষ্ট্রের হামলার পরের দৃশ্য
ছবি: রয়টার্স

তবে দেশটির অবকাঠামোগত দুর্বলতা থাকায় স্থলযুদ্ধে ইরান ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে। ভূরাজনৈতিক কৌশলগত দিক বিবেচনায় ইরান একটা সুবিধাজনক অবস্থানে আছে, তা হলো যেহেতু ইরানের সঙ্গে রাশিয়া, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের বিশাল সীমান্ত আছে, তাই যুদ্ধের সময় পার্শ্ববর্তী দেশগুলো থেকে ইরান সাহায্যও পেতে পারে। শুধু তা–ই নয়, সেই যুদ্ধ দীর্ঘদিন ধরে হতে পারে। তবে সবকিছু নির্ভর করছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের কূটনৈতিক দূরদর্শিতার ওপর।

ইরানে যুক্তরাষ্ট্র স্থল অভিযান চালালে তা ব্যর্থ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তখন ইরান যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ভিয়েতনাম যুদ্ধের চেয়েও বড় ফাঁদ হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে। তাহলে সেই যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের অসংখ্য সেনার প্রাণহানি ঘটবে; যদিও যুদ্ধ সেদিকে যাবে বলে আমার মনে হয় না
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মো. বায়েজিদ সরোয়ার, নিরাপত্তা বিশ্লেষক

ভুলে গেলে চলবে না, ইরানের সবচেয়ে বড় শক্তি হলো জনগণের জাতীয়তাবাদী চেতনা। দেশটির বেশির ভাগ জনগণ ইসরায়েলি আগ্রাসনের পর ইরানের সার্বভৌমত্বের সঙ্গে আছে। তবে জনগণের অভ্যুত্থানে ১৯৭৯ সালে ক্ষমতাচ্যুত মোহাম্মদ রেজা শাহ পাহলভির অনুসারীরা এবং ২০২২ সালে মাসা আমিনির মৃত্যুর পর গণতন্ত্রকামী আন্দোলনকারীরা ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি ও তাঁর সমর্থনপুষ্ট বর্তমান সরকারের বিরোধিতা করলেও তারা দলীয় ও সাংগঠনিকভাবে সংগঠিত নন। তাই ইরান দেশের ভেতরে রাজনৈতিক প্রতিরোধের সম্মুখীন হবে বলে মনে হয় না।

যুক্তরাষ্ট্রের হামলার প্রতিবাদে ইরানে বিক্ষোভ। তেহরান, ইরান, ২২ জুন ২০২৫
ছবি: রয়টার্স

এবার আসি রেজিম চেঞ্জ নিয়ে। এটা নিয়ে বিশ্বব্যাপী ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। আমরা সবাই জানি, ইরানের শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভি ১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লব ক্ষমতাচ্যুত হয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন ইরানের শেষ শাহ। তাঁর ছেলে রেজা পাহলভি যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাসিত জীবন যাপন করেন। তিনি বর্তমানে ইসরায়েলে প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর সঙ্গে বৈঠক করছেন বলে গণমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে। তবে ইরানের জনগণের কাছে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা নেই বললেই চলে। আমার ধারণা, রেজা পাহলভিকে ইরানের ক্ষমতায় বসাতে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের যে ‘ইরান প্রকল্প’, তা এবার সফল হবে না। যদিও এই প্রকল্প বাস্তবায়নে অর্থের লোভে ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের কিছু ইরানি এজেন্ট কাজ করে ইরানের শীর্ষ স্থানীয় সামরিক কর্মকর্তা ও পরমাণুবিজ্ঞানীদের হত্যা করতে সমর্থ হয়েছে। তারপরও অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির আস্থাভাজন ইরানের শাসকদের ক্ষমতা থেকে সরিয়ে রেজা পাহলভিকে বসাতে দেশটির সাধারণ জনগণের সমর্থন তারা পাবে বলে মনে হচ্ছে না।

ইসরায়েলের বিমান হামলায় তেহরানে বিধ্বস্ত একটি ভবন
ছবি: এএফপি

যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের দ্বারা ইরানের রেজিম বা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির আশীর্বাদপুষ্ট বর্তমান সরকারের পরিবর্তন হলে দেশটিতে চরম বিশৃঙ্খলা তৈরি হবে। তাই ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের আশীর্বাদপুষ্ট নতুন নেতৃত্বের আশা এবার অন্তত পূরণ হবে না। ইসরায়েলের অযৌক্তিক হামলার কারণে ইরানের জনগণের মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনা বেড়ে যাচ্ছে বলে তাদের সাম্প্রতিক প্রতিক্রিয়ায় মনে হচ্ছে।

পরিশেষে মনে হচ্ছে, মার্কিন হামলার পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে ইরান যদি মধ্যপ্রাচ্যে বিমানঘাঁটিতে ব্যাপকভাবে হামলা করে, তখন হয়তো যুক্তরাষ্ট্র সর্বাত্মকভাবে এই যুদ্ধে জড়াতে পারে। এমনকি ইরানে যুক্তরাষ্ট্র স্থল অভিযান চালালে তা ব্যর্থ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তখন ইরান যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ভিয়েতনাম যুদ্ধের চেয়েও বড় ফাঁদ হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে। তাহলে সেই যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের অসংখ্য সেনার প্রাণহানি ঘটবে; যদিও যুদ্ধ সেদিকে যাবে বলে আমার মনে হয় না।

ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের সর্বাত্মক হামলায় ইরানের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ইরান কত দিন টিকে থাকতে পারবে, সে প্রশ্ন উঠেছে। যুদ্ধ, কৌশল, প্রতিরোধ, ক্ষয়ক্ষতি, বিকল্প নেতৃত্ব ও সমাধান জানতে নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) মো. বায়েজিদ সরোয়ারের সঙ্গে কথা বলেছেন প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি বায়েজিদ আহমেদ