ভারতের নতুন সংসদ ভবনে ‘অখণ্ড ভারতের’ এই মানচিত্র বসানো হয়েছে
ছবি: এএনআই

‘অখণ্ড ভারতের’ মানচিত্র নিয়ে নেপালে বিতর্ক নতুন গতি পেয়েছে। রাজধানী কাঠমান্ডু শহরের মেয়র বলেন্দ্র শাহ গতকাল বৃহস্পতিবার তাঁর দপ্তরে ‘অখণ্ড নেপালের’ একটি মানচিত্র রেখেছেন। নেপালের এই প্রাচীন মানচিত্র দেখিয়েছে, ভারতের সামান্য কিছু অংশ আসলে নেপালের মধ্যে পড়ে। বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক এতটাই তীব্র হয়েছে যে দেশের প্রধানমন্ত্রী পুষ্পকমল দহল প্রচন্ড বুধবার নেপালের সংসদে এক বিবৃতিতে বলেছেন, বিষয়টি নিয়ে ভারত সরকারের সঙ্গে তাঁর আগেই কথা হয়েছে। ভারতের তরফে জানানো হয়েছে, এটি একটি সাংস্কৃতিক মানচিত্র, রাজনৈতিক নয়।

এই বিতর্কে গতকাল নতুন মাত্রা যোগ করেন কাঠমান্ডুর মেয়র বলেন্দ্র শাহ। বর্তমানে দক্ষিণ ভারত সফররত বলেন্দ্র শাহ তাঁর দপ্তরের কর্মীদের ফোন করে ‘অখণ্ড নেপালের’ একটি মানচিত্র তাঁর অফিসে রাখার নির্দেশ দেন। অতীতে পশ্চিমবঙ্গে নেপালের উপদূতাবাসে নিযুক্ত সে দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মী প্রথম আলোকে এ তথ্য জানিয়ে বলেন, বিষয়টি নেপালে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই কর্মী বলেন, নেপালের বিরোধী দলের নেতারা ভারতের সংসদে রাখা মানচিত্রের তীব্র বিরোধিতা করেছেন। এই বিতর্ক আরও জোরালো হয়েছে কারণ প্রধানমন্ত্রী তাঁর বিবৃতিতে বলেছেন যে তিনি বিষয়টি আগেই জানতেন। বিরোধীদের প্রশ্ন, কেন তিনি আগে বিষয়টি প্রকাশ্যে আনেননি বা বিরোধিতা করেননি। ওই কর্মীর বক্তব্য, বিষয়টি ইতিমধ্যেই অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বিতর্কে পরিণত হয়েছে। এটি আরও জোরালো হবে বলেই ধারণা করা হচ্ছে।

গত ২৮ মে নয়াদিল্লিতে ভারতের নতুন সংসদ ভবন উদ্বোধন করা হয়। সেখানে ম্যুরালের মাধ্যমে অখণ্ড ভারতের যে মানচিত্র আঁকা হয়েছে, তাতে রয়েছে আফগানিস্তান, পাকিস্তান, নেপাল, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা ও মিয়ানমার। ভারতের সংসদবিষয়ক মন্ত্রী প্রহ্লাদ যোশি ম্যুরালটিকে ‘অখণ্ড ভারত’ হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন।

ম্যুরালটি নিয়ে প্রতিবেশী দেশগুলোতে আলোচনার মধ্যে চলতি সপ্তাহে এক সংবাদ সম্মেলনে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর বলেন, ‘এটা কোনো রাজনৈতিক বিষয় নয়। এটি একটি সাংস্কৃতিক মানচিত্র, রাজনৈতিক নয়। নেপালের মতো বন্ধুরাষ্ট্র ভারতের ব্যাখ্যা বুঝতে পেরেছে। যদিও পাকিস্তানের কথা আমরা ভুলে যেতে পারি, কারণ তাদের পক্ষে আমাদের এই ব্যাখ্যা বোঝা সম্ভব নয়।’

নেপাল সরকারিভাবে ভারতের এই ব্যাখ্যা যে মেনে নিয়েছে, তার প্রমাণ গত বুধবার সে দেশের সংসদে প্রধানমন্ত্রীর বিবৃতি। তাতে তিনি বলেছিলেন, ‘ভারতের তরফে আমাকে বলা হয়েছে যে এটি একটি সাংস্কৃতিক মানচিত্র, রাজনৈতিক নয়। এ বিষয়ে আরও গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে।’

ম্যুরালে নেপালের লুম্বিনীকে অখণ্ড ভারতের অঙ্গ হিসেবে দেখানো হয়েছে। গৌতম বুদ্ধের জন্মস্থান লুম্বিনী নেপালিদের কাছে এক পবিত্র স্থান ও দেশের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এটা তাদের এক অনন্য সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। দেশের পর্যটন মানচিত্রে অন্যতম প্রধান আকর্ষণও। এই বিতর্কে নতুন মাত্রা গতকাল যোগ করেছেন কাঠমান্ডুর প্রভাবশালী মেয়র বলেন্দ্র শাহ, নিজের দপ্তরে ‘অখণ্ড নেপালের’ মানচিত্র লাগাতে বলেন। তাঁর দপ্তরের এক কর্মী নেপালের সংবাদপত্র কাঠমান্ডু পোস্টকে বলেছেন, ‘আমাদেরও নেপালের গর্বের ইতিহাস স্মরণে রাখতে হবে।’

নেপালের ঐতিহাসিকদের বক্তব্য, প্রাচীনকালে নেপাল পূর্বে তিস্তা থেকে পশ্চিমে পাঞ্জাব এবং পাকিস্তানের মধ্যে বিস্তৃত ছিল। এসব এলাকা এখন ভারতীয় ভূখণ্ডের ভেতরে পড়েছে। যাঁরা বৃহত্তর নেপালের জন্য প্রচারণা চালাচ্ছেন, তাঁরা নেপালি রাজ্য এবং ব্রিটিশ-ভারতের মধ্যে অ্যাংলো-নেপালি যুদ্ধের পরে ১৮১৬ সালে স্বাক্ষরিত সুগৌলি চুক্তির আগে নেপালের নিয়ন্ত্রণে থাকা জমি ফিরিয়ে আনার জন্য সে দেশের সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করছেন।

যুদ্ধের পরে, ১৮১৬ সালেই নেপাল এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মধ্যে সুগৌলি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যা নেপালের ভূখণ্ডকে মেচি-মহাকালীতে সীমাবদ্ধ করে। চুক্তির পরবর্তী সময়ে, নেপাল মেচি নদী থেকে পূর্বে সিকিম-জলপাইগুড়ি-তিস্তা এবং মহাকালী নদী থেকে পশ্চিমে শতদ্রু পর্যন্ত ভূমি ব্রিটিশদের হস্তান্তর করে। সুগৌলি চুক্তির সময় নেপালের মোট ভূমির পরিমাণ ছিল আজকের নেপালের থেকে অনেকটাই বেশি। সংসদে প্রাচীনকালে ভারতের বিস্তার দেখাতে গিয়ে ভারতের স্বাধীনতার ৭৫তম বছরে বিজেপি–শাসিত কেন্দ্র সরকারকে এখন তাদের কাজের নানা ব্যাখ্যা বিভিন্ন প্রতিবেশী রাষ্ট্রকে দিতে হচ্ছে।

‘অখণ্ড ভারতের’ ধারণা রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) বহুদিনের। ভারতে অনেক সময় হিন্দুত্ববাদে বিশ্বাসী কর্মী এবং নেতাদের ঘরে এই মানচিত্র এবং এই মানচিত্রসংবলিত ক্যালেন্ডার দেখতে পাওয়া যায়। যদিও অতীতে, অখণ্ড ভারতের এই কল্পনাকে, হিন্দুত্ববাদীরা কী চোখে দেখেন, তার উত্তরে আরএসএসের ঘনিষ্ঠ হিন্দুত্ববাদী পত্রিকার এক সম্পাদক এই প্রতিবেদককে বলেছিলেন, ‘এটা নেহাতই এখন এক কল্পনা। এটা এখন আর বাস্তবায়িত হওয়া সম্ভব নয়। যদিও এটা স্মরণে রাখা প্রয়োজন যে অখণ্ডিত ভারতের বিস্তার কত দূর পর্যন্ত ছিল। মহাভারতেও এ সম্পর্কে নির্দিষ্টভাবে বলা হয়েছে।’ ওই সম্পাদকের ভাষ্য, বিষয়টিকে সরকারি বা আনুষ্ঠানিক স্তরে সামনে নিয়ে আসার কোনো পরিকল্পনা বিজেপি বা ভারত সরকারের নেই।

আরও পড়ুন

‘অখণ্ড ভারতের’ মানচিত্রটি অশোকের রাজত্বকালের

কিন্তু এরপরেও বিতর্ক শুরু হয়েছে, কারণ সংসদ ভবন কোনো অনানুষ্ঠানিক বা বেসরকারি স্থান নয়। সেটি পুরোপুরি ভারত সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন একটি সরকারি জায়গা। সেটি বিজেপি বা আরএসএসের দপ্তর নয়, সেটি ভারতের মানুষের আনুষ্ঠানিক মতবিনিময়ের প্রধান স্থান। সেই জায়গায় কীভাবে এই মানচিত্র স্থান পেল, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠবেই।

মানচিত্রে বাংলাদেশকে অংশ করায় এর নিন্দা ও প্রতিবাদ জানায় ঢাকায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। এই প্রেক্ষাপটে বিষয়টি সম্পর্কে ভারতের বক্তব্য জানতে চেয়েছিল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। জবাবে ভারতের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এতে আসলে সম্রাট অশোকের রাজত্বকাল বোঝানো হয়েছে।

আরও পড়ুন

‘অখণ্ড ভারত’ মানচিত্র নিয়ে ঢাকায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া