সর্বকালের সেরা বিজ্ঞানী কারা? এমন প্রশ্নের উত্তরে সাধারণত আলবার্ট আইনস্টাইন, আইজ্যাক নিউটনসহ অনেক বড় বড় বিজ্ঞানীদের নাম শোনা যায়। এ বিজ্ঞানীরা যে গুরুত্বপূর্ণ সব আবিষ্কার করেছেন এবং বিশ্বকে বদলে দিতে ভূমিকা রেখেছেন, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তবে নারী বিজ্ঞানীরা অনেকটা আলোচনার বাইরে থেকে যান। অথচ বহু আগে থেকেই নারীরা বিজ্ঞানে অবদান রেখে চলেছেন। তাঁদের আবিষ্কার বিশ্বকে পাল্টে দিতে সহায়ক ভূমিকা ছিল। ডিসকভার ম্যাগাজিনে এমন ১০ জন নারী বিজ্ঞানীর তালিকা দেওয়া হয়েছে। তাঁদের সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক।
ইংরেজ গণিতবিদ ও লেখিকা অ্যাডা লাভলেসের জন্ম ১৮১৫ সালে। তাঁর পুরো নাম অগাস্টা অ্যাডা বায়রন। তিনি মূলত চার্লস ব্যাবেজের তৈরি কম্পিউটার ‘অ্যানালিটিক্যাল ইঞ্জিন’ নিয়ে কাজ করেছেন। লাভলেসকে প্রথম কম্পিউটার প্রোগ্রামার হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আধুনিক কম্পিউটার আবিষ্কারের অনেক আগেই তিনি কাজটি করেছেন। চার্লস ব্যাবেজের প্রস্তাবিত অ্যানালিটিক্যাল ইঞ্জিন সম্পর্কে তাঁর দেওয়া নোটগুলোকে প্রথম কম্পিউটার অ্যালগরিদম হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। অ্যাডা লাভলেসের কোনো আনুষ্ঠানিক ডিগ্রি ছিল না। ওই যুগে নারীদের শিক্ষা লাভের পথ বেশ কঠিন ছিল। তবে প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও তিনি গণিত ও বিজ্ঞানে ব্যক্তিগতভাবে শিক্ষা নিয়েছিলেন।
মেরি কুরি ছিলেন একজন পোলিশ-ফরাসি পদার্থবিজ্ঞানী ও রসায়নবিদ। তেজস্ক্রিয়তার ওপর গবেষণায় তিনি অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন। কুরির অন্যতম সাফল্য ছিল একটি ভ্রাম্যমাণ এক্স-রে ইউনিট আবিষ্কার করা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ওই এক্স–রে ইউনিটটি ব্যবহার করা হয়েছিল। স্বামী পিয়েরে কুরির সঙ্গে মিলে তেজস্ক্রিয় উপাদান পোলোনিয়াম ও রেডিয়াম আবিষ্কার করেছিলেন মেরি কুরি। তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ বিচ্ছিন্ন করার কৌশলও উদ্ভাবন করেছিলেন তিনি। ১৯০৩ সালে কুরি প্রথম নারী হিসেবে নোবেল পুরস্কার পান। পদার্থবিদ্যায় অবদানের জন্য ওই পুরস্কার পেয়েছিলেন তিনি। পরে তিনি রসায়নে অবদান রাখার জন্যও নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। দুবার নোবেল পুরস্কার পাওয়া প্রথম ব্যক্তি তিনি। মেরি কুরির কাজের মধ্য দিয়ে অস্ত্রোপচার ও পারমাণবিক পদার্থবিদ্যার ক্ষেত্রে এক্স-রে নিয়ে গবেষণার ভিত্তি তৈরি হয়। তিনি টিউমারের চিকিৎসার জন্য রেডিয়ামের ব্যবহারকেও সমর্থন জানান।
ভারতের প্রথম নারী উদ্ভিদবিজ্ঞানী জানকী অম্মল। তিনি উদ্ভিদবিজ্ঞান ও কোষবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছিলেন। জানকী অম্মল মাদ্রাজ ও যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনা করেছেন। উইমেনস ক্রিশ্চিয়ান কলেজে শিক্ষকতা ও গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সুগারকেন ব্রিডিং ইনস্টিটিউটে কাজ করাসহ তিনি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন। ইংল্যান্ডেও কাজ করেছেন এ নারী। পরে বোটানিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার পুনর্গঠনের কাজে নেতৃত্ব দিতে ভারতে ফিরে আসেন। ১৯৮৪ সালে মৃত্যুর আগপর্যন্ত তিনি জেনেটিকস ও উদ্ভিদ প্রজননে ব্যাপক অবদান রেখেছিলেন।
জানকী অম্মলের বৈজ্ঞানিক সাফল্য ছিল যুগান্তকারী। সাইটোজেনেটিকস, ঔষধি ও নৃতাত্ত্বিক উদ্ভিদবিদ্যার ওপর তাঁর বিস্তৃত গবেষণা তাঁকে একজন নিবেদিতপ্রাণ এবং বহুমুখী বিজ্ঞানী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছিল। বিজ্ঞানে অবদানের জন্য তিনি সম্মানজনক ফেলোশিপ ও পদ্মশ্রীর মতো পুরস্কার পেয়েছিলেন।
চিয়েন-শিউং উ-এর জন্ম চীনে। তিনি সেখানকার নানকিংয়ে অবস্থিত ন্যাশনাল সেন্ট্রাল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিজ্ঞান বিষয়ে পড়াশোনা করেন। ম্যানহাটান প্রকল্পে ভূমিকার জন্য ব্যাপক সমাদৃত তিনি। তিনিই প্রথম বিজ্ঞানী যিনি এনরিকো ফার্মির তেজস্ক্রিয় বিটা ক্ষয়ের তত্ত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত করেছিলেন। পরে তা পরিমার্জনও করেছিলেন তিনি। ‘উ এক্সপেরিমেন্ট’-এর জন্যও তিনি পরিচিত, যা পদার্থবিদ্যায় সমতার তত্ত্বকে উল্টে দিয়েছিল। এই আবিষ্কারের কারণে তাঁর পুরুষ সহকর্মীদের নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল। তবে এ কাজের ক্ষেত্রে উ-এর যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল, তা উপেক্ষা করা হয়েছিল। চিয়েন-শিউং উ ১৯৭৫ সালে জাতীয় বিজ্ঞান পদক ও ১৯৭৮ সালে উলফ পুরস্কার পান। উলফ পুরস্কার পাওয়া প্রথম নারী তিনি। তিনি আমেরিকান ফিজিক্যাল সোসাইটির প্রথম নারী সভাপতিও ছিলেন।
ক্যাথেরিন জনসন ছিলেন একজন ব্যতিক্রমী মার্কিন গণিতবিদ। তিনি মার্কিন মহাকাশ সংস্থা নাসায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। তিনি বর্ণ ও লৈঙ্গিক প্রতিবন্ধকতাগুলো অতিক্রম করতে পেরেছিলেন। ক্যাথেরিন নাসায় কাজ করা প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ নারী। বুধ গ্রহে অভিযান, চাঁদে অ্যাপোলো-১১ অভিযানসহ গুরুত্বপূর্ণ মার্কিন মহাকাশ অভিযানে তাঁর অবদান ছিল। ক্যাথেরিন জনসন ২০১৫ সালে প্রেসিডেনশিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম পুরস্কার পেয়েছিলেন। ‘হিডেন ফিগারস’ নামক চলচ্চিত্রে তাঁর অবদানের কথা তুলে ধরা হয়েছে। ক্যাথেরিন জনসন ২০২০ সালে ১০১ বছর বয়সে মারা যান।
রোজালিন্ড ফ্রাঙ্কলিন একজন ব্রিটিশ রসায়নবিদ। ডিএনএর ডাবল হেলিক্স কাঠামো আবিষ্কারের জন্য তিনি সর্বাধিক পরিচিত। তবে জেমস ওয়াটসন ও ফ্রান্সিস ক্রিক তাঁর অবদান ব্যবহার করে ডিএনএর গঠন সম্পর্কে তাঁদের নিজস্ব গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য প্রকাশ করেছিলেন। এ ক্ষেত্রে তাঁরা রোজালিন্ডকে সম্পূর্ণ কৃতিত্ব দেননি।
বছরের পর বছর ধরে এক্স-রে বিকিরণের সংস্পর্শে থাকার পর ৩৭ বছর বয়সে ডিম্বাশয়ের ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান রোজালিন্ড। এর মধ্য দিয়ে তাঁর যুগান্তকারী কর্মজীবনের অকাল সমাপ্তি ঘটে। রোজালিন্ডের মৃত্যুর চার বছর পর ১৯৬২ সালে তাঁর পুরুষ সহকর্মীরা নোবেল পুরস্কার পান। কারও কারও ধারণা, রোজালিন্ড বেঁচে থাকলেও হয়তো পুরস্কার পেতেন না, কমিটি হয়তো তাঁকে উপেক্ষা করত।
জ্যোতির্বিজ্ঞানী ভেরা রুবিন ছায়াপথের ঘূর্ণন হার নিয়ে যুগান্তকারী কাজ করেছেন। তাঁর অবদানকে বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারগুলোর মধ্যে একটি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অনেকের মতে, এই কাজকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া উচিত ছিল। অনেক প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন ভেরা রুবিন। পরে ওই বিশ্ববিদ্যালয়েই তিনি গবেষক ও অধ্যাপক হিসেবে কাজ করেছেন। সহকর্মী কেন্ট ফোর্ডের সঙ্গে মিলে তিনি তাঁর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারটি করেছেন। তাঁরা দেখতে পান যে ছায়াপথের বাইরের অংশের নক্ষত্রগুলো কেন্দ্রে থাকা নক্ষত্রের মতো দ্রুতগতিতে চলে। পুরো কর্মজীবনে রুবিন বিজ্ঞানে অবদান রাখা নারীদের পক্ষে সোচ্চার ছিলেন। প্রায়ই তিনি লিঙ্গবৈষম্যের বিরুদ্ধে কথা বলতেন এবং নারী বিজ্ঞানীদের দিকনির্দেশনা দিতে তিনি কাজ করতেন।
ভেরা কখনো নোবেল পুরস্কার পাননি। জ্যোতির্বিদ্যায় অবদানের জন্য জাতীয় বিজ্ঞান পদকসহ বেশ কিছু পুরস্কার পেয়েছেন। তাঁর কাজগুলো বিশ্বব্যাপী জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও পদার্থবিদদের অনুপ্রাণিত করে যাচ্ছে।
পৃথিবীর আকারের গাণিতিক মডেল তৈরির কাজ করেছেন গ্ল্যাডিস ওয়েস্ট। তাঁর এ কাজকে গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম (জিপিএস) প্রযুক্তির ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ভার্জিনিয়া স্টেট কলেজ থেকে গণিতে পড়াশোনা করেছেন গ্ল্যাডিস। এরপর তিনি ওয়েস্ট মার্কিন নৌবাহিনীতে যোগ দেন। সেখানে কৃত্রিম উপগ্রহ পরিমাপ ও মহাকর্ষীয় বৈশিষ্ট্য নিয়ে তাঁর গবেষণাধর্মী কাজগুলো জিপিএসের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। SEASAT ও GEOSAT-এর মতো প্রকল্পগুলোতে তাঁর উদ্ভাবনী কাজগুলো পৃথিবীপৃষ্ঠের যথাযথ মডেল তৈরিতে সহায়ক, যা জিপিএসকে নির্ভুল করার জন্য অপরিহার্য। ২০১৮ সালে গ্ল্যাডিস ওয়েস্টকে মার্কিন বিমানবাহিনীর স্পেস অ্যান্ড মিসাইল পাইওনিয়ারস হল অব ফেমে ভূষিত করা হয়। এটি মার্কিন বিমানবাহিনীর মহাকাশবিষয়ক কমান্ডের সর্বোচ্চ সম্মাননা।
ভাইরাসসংক্রান্ত বিশেষজ্ঞ ফ্লসি ওং–স্তালের কাজগুলো এইচআইভি/এইডস–এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। তিনি ১৯৪৭ সালে চীনে জন্মগ্রহণ করেন। পরে তাঁর পরিবার যুক্তরাষ্ট্রে চলে যায়। সেখানেই পড়াশোনা করেছেন ওং–স্তাল। তিনি লস অ্যাঞ্জেলেসের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যাকটেরিওলজি এবং মলিকুলার বায়োলজির ওপর ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন। ওং–স্তালই প্রথম বিজ্ঞানী, যিনি এইচআইভির ক্লোন করেছিলেন এবং এর জিনের একটি নকশা তৈরি করেছিলেন। এর মধ্য দিয়ে ভাইরাসটি নিয়ে পরীক্ষা শুরু হয়। তাঁর গবেষণার বদৌলতেই এইচআইভি শনাক্তে প্রথম পরীক্ষা পদ্ধতির সূচনা হয়। পরবর্তী সময় এইচআইভি বিস্তার ঠেকাতেও তাঁর গবেষণা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। পরে সান ডিয়েগোর ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি ভাইরোলজি ও জিন থেরাপি বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ চালিয়ে যান। ওই সময়ে তিনি শীর্ষস্থানীয় নারী বিজ্ঞানীদের একজন হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেন। চিকিৎসাবিজ্ঞান ও জনস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে ওং-স্তালের অবদানগুলো অনস্বীকার্য। ২০২০ সালের জুলাই মাসে এ বিজ্ঞানীর মৃত্যু হয়।
জিন সম্পাদনার পদ্ধতি সিআরআইএসপিআর উদ্ভাবন করেন জেনিফার ডাউডনা। এটি একটি যুগান্তকারী উদ্ভাবন। ১৯৬৪ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারিতে তিনি ওয়াশিংটন ডিসিতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বড় হয়েছেন হাওয়াইয়ের হিলোতে। তিনি ক্যালিফোর্নিয়ার পোমোনা কলেজ থেকে বায়োকেমিস্ট্রিতে ব্যাচেলর অব আর্টস ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর তিনি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক করেন। তিনি বায়োলজিক্যাল কেমিস্ট্রি ও মলিকুলার ফার্মাকোলজিতে পিএইচডি করেছেন।
ডাউডনা ফরাসি বিজ্ঞানী ইমানুয়েল শারপঁসিয়ের সঙ্গে যৌথভাবে সিআরআইএসপিআর/সিএএস-নাইন নামে জিন সম্পাদনার পদ্ধতি আবিষ্কারের জন্য বেশি সমাদৃত। এই পদ্ধতি বিজ্ঞানীদের অভূতপূর্ব নির্ভুলতা, দক্ষতা ও নমনীয়তার সঙ্গে ডিএনএ সিকোয়েন্স সম্পাদনা করার সুযোগ করে দেয়, যা জেনেটিক গবেষণা ও থেরাপিতে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করে। নিজেদের এ কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ ডাউডনা ও শারপঁসিয়ে ২০২০ সালে রসায়নে নোবেল পুরস্কার পান।