ছাদখোলা গাড়িতে হাসছিলেন প্রেসিডেন্ট কেনেডি, হঠাৎ আততায়ীর গুলি

জন এফ কেনেডি যখন ক্ষমতায় আসেন, তখন বিশ্বরাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার নিয়ে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের মুখোমুখি ছিল যুক্তরাষ্ট্র। তাঁর দায়িত্ব গ্রহণের পরের বছরই ‘কিউবা ক্ষেপণাস্ত্র সংকট’ তৈরি হয়। যে সংকট সামলে বিশ্বকে একটি পারমাণবিক যুদ্ধের হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন এই মার্কিন প্রেসিডেন্ট। কিন্তু পরের বছরই আততায়ীর গুলিতে নিহত হন তিনি। আড়াই বছরের কিছু বেশি সময় তিনি দেশ শাসন করেছেন। এত অল্প সময়েও তিনি যতটা জনপ্রিয়তা পেয়েছেন, তা খুব কম মার্কিন প্রেসিডেন্টের ভাগ্যে জুটেছে। জন এফ কেনেডিকে নিয়ে প্রথম আলোর আজকের আয়োজন।

১৯৬৩ সালের ২২ নভেম্বর ডালাসের লাভ ফিল্ড বিমানবন্দরে পৌঁছানোর পর প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি ও তাঁর স্ত্রী জ্যাকুলিন কেনেডি
ছবি: জেএফকে লাইব্রেরির ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া

৬২ বছর আগে, নভেম্বরের এক রৌদ্রোজ্জ্বল সকাল। একপশলা বৃষ্টির পর আকাশ ঝকঝক করছে। যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস অঙ্গরাজ্যের ডালাস শহরে সাজসাজ রব। শহরের বাসিন্দারা সকাল থেকে সেজেগুজে সড়কের দুই পাশে জড়ো হচ্ছেন। কিছুক্ষণের মধ্যে প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডির মোটর শোভাযাত্রা শুরু হবে। সঙ্গে ফার্স্ট লেডি জ্যাকুলিন কেনেডিও থাকবেন। এই দম্পতি তখন দেশে ও দেশের বাইরে তুমুল জনপ্রিয়। সবাই নিজের চোখে তাঁদের দেখতে উদ্‌গ্রীব।

দিনটি ছিল ১৯৬৩ সালের ২২ নভেম্বর (শুক্রবার)। আগের দিন প্রেসিডেন্ট কেনেডি স্ত্রীকে নিয়ে টেক্সাসের হিউস্টনে এসেছেন। স্থানীয় সময় বেলা ১১টার দিকে প্রেসিডেন্ট ও ফার্স্ট লেডিকে নিয়ে ১৩ মিনিটের সংক্ষিপ্ত যাত্রা শেষে এয়ারফোর্স ওয়ান ডালাসের লাভ ফিল্ড বিমানবন্দরে পৌঁছায়। পরবর্তী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে সামনে রেখে এটি ছিল তাঁদের রাজনৈতিক সফর। যদিও তখনো কেনেডি পরবর্তী নির্বাচনের জন্য নিজের প্রার্থিতা ঘোষণা করেননি। কিন্তু সেপ্টেম্বরের পরই তিনি নির্বাচন ঘিরে প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছিলেন।

বিমানবন্দরে কেনেডি দম্পতিকে স্বাগত জানানোর আনুষ্ঠানিকতা শেষে বেলা ১১টা ৪০ মিনিটের দিকে সেখান থেকে মোটর শোভাযাত্রা শুরু হয়।

ছাদখোলা গাড়ি

একটি কালো রঙের লিমোজিনে করে মোটর শোভাযাত্রায় অংশ নেন প্রেসিডেন্ট কেনেডি। সেটি ছিল লিংকন মডেলের একটি কনভার্টেবল বা ছাদখোলা গাড়ি। পাশে বসা গোলাপি রঙের পোশাকে স্ত্রী জ্যাকুলিন কেনেডি। গাড়িতে তাঁদের আগের আসনে বসে ছিলেন টেক্সাসের গভর্নর জন কনালি ও তাঁর স্ত্রী নেলি। শোনা যায়, সেদিন কেনেডি নিজেই নাকি নিরাপত্তা ভয় উপেক্ষা করে গাড়ির ছাদখোলা রাখতে বলেছিলেন।

সড়কের দুই পাশে হাজার হাজার মানুষ কেনেডি দম্পতিকে দেখে হাত নাড়ছিলেন, খুশিতে চিৎকার করছিলেন। প্রেসিডেন্ট ও ফার্স্ট লেডিও হাসিমুখে কখনো কখনো হাত নেড়ে জনতার অভিবাদনের জবাব দিচ্ছিলেন

শহরের বিভিন্ন পথ পেরিয়ে মোটর শোভাযাত্রা ডিলি প্লাজার দিকে এগোচ্ছিল। ঘড়ির কাঁটা তখন দুপুর সাড়ে ১২টা ছুঁই ছুঁই।

ডিলি প্লাজার মেইন স্ট্রিট থেকে মোড় নিয়ে টেক্সাস স্কুল বুক ডিপোজিটরির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় হঠাৎ গুলির শব্দ…মাথা কাত করে স্ত্রীর গায়ে ঢলে পড়েন প্রেসিডেন্ট কেনেডি।

পরে প্রেসিডেন্টের ঘাড়ে ও মাথায় গুলির ক্ষতচিহ্ন দেখতে পাওয়া যায়। গভর্নর কনালির পিঠেও গুলি লাগে।

গুলিবিদ্ধ প্রেসিডেন্টকে নিয়ে গাড়িটি দ্রুতবেগে কাছের পার্কল্যান্ড মেমোরিয়াল হাসপাতালে ছুটে যায়। কিন্তু চিকিৎসকদের বেশি কিছু করার ছিল না। গুলিবিদ্ধ হওয়ার আধা ঘণ্টা পর প্রেসিডেন্ট কেনেডিকে মৃত ঘোষণা করা হয়। গুরুতর আহত হলেও প্রাণে বেঁচে যান কনালি।

আততায়ীর গুলিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি নিহত হয়েছেন—খবর শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়; বরং সারা বিশ্বের জন্য বিশাল এক ‘শক ওয়েভ’ হয়ে এসেছিল।

হত্যাকারী লি হার্ভি অসওয়াল্ড

একটি উঁচু ভবন থেকে প্রেসিডেন্ট কেনেডিকে লক্ষ্য করে গুলি চালিয়েছিলেন আততায়ী।

ঘটনার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই এ হত্যার রহস্য উদ্‌ঘাটনের দাবি করে পুলিশ। গ্রেপ্তার করা হয় ২৪ বছর বয়সী সাবেক মেরিন সেনা লি হার্ভি অসওয়াল্ডকে। তাঁর বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ আনা হয়। কিন্তু ঠিক কী ঘটেছিল, সে সম্পর্কে অসওয়াল্ডের বক্তব্য কেউ জানার সুযোগ পায়নি।

জন এফ কেনেডির হত্যাকারী সন্দেহে গ্রেপ্তার লি হার্ভি অসওয়াল্ড
ফাইল ছবি: রয়টার্স

কারণ, পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার দুই দিন পরই একটি নৈশক্লাবের মালিক জ্যাক রুবি ডালাসের পুলিশ সদর দপ্তরে ঢুকে সেখানকার বেজমেন্টে একেবারে সামনে থেকে গুলি করে অসওয়াল্ডকে হত্যা করেন।

ওই সময় পুলিশ অসওয়াল্ডকে আদালতে নিয়ে যাচ্ছিল, টেলিভিশনে সরাসরি তা দেখানো হচ্ছিল। সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ রুবিকে গ্রেপ্তার করে। পরে বিচারে তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। এ রায়ের বিরুদ্ধে রুবি আপিল করেন, আপিলে তাঁর সাজা বাতিল হয় এবং নতুন করে বিচার শুরু হয়।

বিচার চলাকালে রুবি অসুস্থ হয়ে পড়েন, তাঁর ক্যানসার ধরা পড়ে। বিচার কার্যক্রম শেষ হওয়ার আগেই রুবি মারা যান (১৯৬৭ সালের ৩ জানুয়ারি)।

অসওয়াল্ড নিহত হওয়ায় কেনেডি হত্যাকাণ্ড ঘিরে রহস্য আরও ঘনীভূত হয়। হত্যাকাণ্ড ঘিরে অনেক ধরনের ষড়যন্ত্রতত্ত্ব চালু হয়।

ষড়যন্ত্রতত্ত্ব

২০২২ সালে কেনেডি হত্যাকাণ্ড নিয়ে বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের মতো একটি দেশের প্রেসিডেন্টকে হত্যা করা হলো, আর সন্দেহভাজন হত্যাকারী ধরা পড়ার পর পুলিশ হেফাজতে থাকা অবস্থায় দুই দিনের মাথায় তাঁকেও একেবারে সামনে থেকে গুলি করে মারা হলো—বিষয়টি বহু মানুষের কাছে একেবার অবিশ্বাস্য বলে মনে হয়েছে।

সন্দেহভাজন হত্যাকারী অসওয়াল্ডকে ঘিরেও ছিল অনেক প্রশ্ন। কেনেডি হত্যাকাণ্ড নিয়ে দ্রুত অনেক ষড়যন্ত্রতত্ত্ব ছড়াতে থাকে। কারণও ছিল। প্রথমত, প্রেসিডেন্ট কেনেডি ছিলেন অসম্ভব জনপ্রিয়। দ্বিতীয়ত, এ হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে স্নায়ুযুদ্ধের উত্তেজনা যখন চরমে, ঠিক তখন। কেনেডি হত্যার পর যেকোনো সময় পারমাণবিক যুদ্ধ শুরুর আশঙ্কা করা হচ্ছিল।

কেনেডি হত্যারহস্য উদ্‌ঘাটনে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের নিয়োগ করা কমিশন তদন্তের পর বলেছিল, অসওয়াল্ড একাই এ কাজ করেছেন। তাঁর সঙ্গে কেউ ছিলেন না। এ হত্যাকাণ্ডের পেছনে বড় কোনো ষড়যন্ত্রের কথা কমিশন নাকচ করে দেয়।

কিন্তু সে সময় কমিশন অনেক প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেনি।

লি হার্ভি অসওয়াল্ড কেনেডি হত্যাকাণ্ডের আগে বেশ কিছু সময় সোভিয়েত ইউনিয়নে কাটিয়েছিলেন। বলা হয়, তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের পক্ষাবলম্বন করেছিলেন। তবে কেনেডি হত্যাকাণ্ডের আগের বছর তিনি যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে আসেন।

কোনো কোনো ষড়যন্ত্রতত্ত্বে দাবি করা হয়, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও কিউবার পক্ষ হয়ে এ কাজ করেছেন অসওয়াল্ড।

আরেকটি ষড়যন্ত্রতত্ত্বে দাবি করা হয়, এর পেছনে মার্কিন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর হাত ছিল।

এমনকি কেউ কেউ তো কেনেডি হত্যাকাণ্ডের পেছনে তাঁর ভাইস প্রেসিডেন্ট লিন্ডন বি জনসনের হাত থাকা নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করেন। তিনিই নাকি প্রেসিডেন্টকে সরিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্রে ছিলেন।

এয়ারফোর্স ওয়ান প্রেসিডেন্ট কেনেডির মৃতদেহ নিয়ে আকাশে ওড়ার আগেই ভিড়ে ভরা কেবিনের ভেতর চিন্তিত মুখে যুক্তরাষ্ট্রের ৩৬তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিচ্ছেন লিন্ডন বি জনসন। ২২ নভেম্বর ১৯৬৩
ছবি: জেএফকে লাইব্রেরির ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া

২২ নভেম্বর প্রেসিডেন্ট কেনেডির মৃতদেহ লাভ ফিল্ড বিমানবন্দর নিয়ে এসে এয়ারফোর্স ওয়ানে রাখা হয়। এয়ারফোর্স ওয়ান প্রেসিডেন্টের মৃতদেহ নিয়ে আকাশে ওড়ার আগেই ভিড়ে ভরা কেবিনের ভেতর চিন্তিত মুখে যুক্তরাষ্ট্রের ৩৬তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন লিন্ডন বি জনসন।

জনসনকে শপথ পড়ান মার্কিন ডিস্ট্রিক্ট আদালতের বিচারক সারাহ হিউজ। সেদিন বেলা ২টা ৩৮ মিনিটে শপথ অনুষ্ঠিত হয়।

সিআইএ এবং এফবিআই (মার্কিন কেন্দ্রীয় তদন্ত ব্যুরো) আগে থেকে এ রকম একটি হুমকির ব্যাপারে কতটা জানত, তা নিয়েও অনেক প্রশ্ন আছে।

অনেকের বিশ্বাস, কেনেডির ওপর গুলি চালিয়েছিলেন একজন নয়, দুজন বন্দুকধারী।

প্রত্যক্ষদর্শীর স্বীকারোক্তি

২২ নভেম্বর জন এফ কেনেডি গুলিবিদ্ধ হওয়ার সময় তাঁর কাছ থেকে মাত্র কয়েক ফুট দূরে অবস্থান করছিলেন মার্কিন গোয়েন্দা পল ল্যান্ডিস (সিক্রেট সার্ভিস এজেন্ট)। কেনেডির লিমোজিনের পেছনের গাড়িতেই তিনি ছিলেন।

২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে দ্য নিউইয়র্ক টাইমসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ল্যান্ডিস কেনেডি হত্যাকাণ্ড নিয়ে ওয়ারেন কমিশনের দেওয়া ‘একক বুলেট তত্ত্ব’কে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন।

ওয়ারেন কমিশনের ওই তত্ত্বে বলা হয়, একটি গুলিই প্রেসিডেন্ট কেনেডির মাথা ও ঘাড়ে আঘাত করে বেরিয়ে গভর্নর কনালির পিঠ, কবজি ও ঊরুতে আঘাত করে। গুলি কনালির পিঠ দিয়ে প্রবেশ করে তাঁর ফুসফুসে আঘাত করেছিল। একটি গুলি কীভাবে সাতটি ক্ষত তৈরি করে, তা নিয়ে এখনো বিশ্বাসযোগ্য কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি।

হত্যাকাণ্ডের তদন্তে থাকা ওয়ারেন কমিশন কখনোই ল্যান্ডিসের সাক্ষাৎকার নেয়নি। ল্যান্ডিস নিজেও কখনো এ বিষয়ে সামনে এসে মুখ খোলেননি। প্রায় ৬০ বছর চুপ থাকার পর ৮৮ বছর বয়সী পল ল্যান্ডিস তাঁর স্মৃতিচারণামূলক বই নিয়ে প্রথম বিষয়টি সামনে আনেন।

কেনেডি হত্যাকাণ্ড নিয়ে ২০২৩ সালের অক্টোবরে প্রকাশ পায় ল্যান্ডিসের বই ‘দ্য ফাইনাল উইটনেস’। বলা হয়, পল ল্যান্ডিস তাঁর বইয়ে ১৯৬৩ সালের ২২ নভেম্বরের ঘটনার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য বিবরণ দিয়েছেন। তবে ল্যান্ডিস বইয়ে লিখেছেন, তিনি কেনেডি হত্যা নিয়ে ষড়যন্ত্রতত্ত্ব প্রচার করতে চান না।

কেমন ছিলেন প্রেসিডেন্ট কেনেডি

জন এফ কেনেডির পুরো নাম জন ফিটজেরাল্ড কেনেডি। তিনি জেএফকে নামেও পরিচিত ছিলেন। ১৯৬১ সালের ২০ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের ৩৫তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি শপথ নেন। সে সময় তাঁর বয়স ছিল ৪৩ বছর। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সর্বকনিষ্ঠ নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট।

জনপ্রিয়তার শিখরে থাকা অবস্থায় আততায়ীর গুলিতে নিহত হন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি
ছবি: ন্যাশনাল আর্কাইভ

অভিজাত ও মার্কিন রাজনীতিতে প্রভাবশালী পরিবার থেকে উঠে আসা জন এফ কেনেডি কেমন প্রেসিডেন্ট ছিলেন? তাঁকে ঘিরে প্রচলিত ধারণাগুলোর কতটুকু সত্য আর কতটুকু কল্পনা। এসব নিয়ে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে অনেক প্রতিবেদন প্রকাশ পেয়েছে।

এসব প্রতিবেদনে বলা হয়, কেনেডির গুণমুগ্ধদের কাছে তিনি ছিলেন অনেক গুণের অধিকারী একজন ক্যারিশমাটিক নেতা।

কেনেডি যুক্তরাষ্ট্রকে ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিভীষিকা থেকে বাঁচিয়েছেন। বর্ণবাদে বিভক্ত যুক্তরাষ্ট্রকে একসুতায় গাঁথতে কাজ করেছেন। ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারির হোতা রিচার্ড নিক্সনকে ১৯৬০ সালের নির্বাচনে পরাজিত করেছেন।

তবে নিন্দুকের কাছে কেনেডি ‘প্লেবয়’; যিনি হলিউড তারকা মেরিলিন মনরোর সঙ্গে গোপন প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়েছিলেন। তিনি ভিয়েতনাম যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের সংশ্লিষ্টতাকে দীর্ঘায়িত করেছেন। নাগরিক অধিকারকে তিনি রাজনৈতিক সমস্যা নয়; বরং নৈতিক সংকটের দৃষ্টি থেকে দেখে সমস্যার প্রকৃত কারণ অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন।

এসব নিন্দুক মনে করেন, কেনেডির মৃত্যু তাঁকে ট্যাবলয়েড পত্রিকার রসালো শিরোনাম হওয়ার যাতনা থেকে রক্ষা করেছে। হলিউড তারকা মনরো বা মাফিয়া জুডিথ ক্যাম্পবেলের সঙ্গে দহরম-মহরম তাঁকে এমন অবস্থায় ফেলতেই পারত।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, কেনেডি তাঁর আড়াই বছরের শাসনামলে নাগরিক অধিকার নিয়ে নানা কাজ করলেও ওই বয়সে বড় ধরনের কোনো সামাজিক পরিবর্তন চাননি। কারণ, তাঁর মনে ভয় ছিল, ওই বয়সে এত বড় কাজ করতে গেলে তাঁর দল ডেমোক্রেটিক পার্টি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

কেনেডি হত্যাকাণ্ডের গোপন নথি প্রকাশ

কেনেডি হত্যার পর প্রেসিডেন্ট লিন্ডন বি জনসন এ হত্যাকাণ্ড তদন্তে একটি কমিশন গঠন করেন। কমিশনের প্রধান করা হয় সুপ্রিম কোর্টের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি আর্ল ওয়ারেনকে।

১৯৬৪ সালে কমিশন এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে অসওয়াল্ড একাই কেনেডিকে হত্যা করেছেন। তাঁর সঙ্গে আর কারও জড়িত থাকার বিশ্বাসযোগ্য কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

১৯৯২ সালের ‘জেএফকে রেকর্ডস অ্যাক্ট’ নামের একটি আইনের অধীন ২০১৭ সালের মধ্যে প্রেসিডেন্ট কেনেডি হত্যাকাণ্ড নিয়ে সব গোপন নথি প্রকাশ করার কথা ছিল।

সে অনুযায়ী কয়েক বছর ধরে কয়েক দফায় হাজার হাজার পৃষ্ঠার গোপন নথি প্রকাশ করা হয়।

সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি
ছবি রয়টার্স

এ বছর মার্চেও কেনেডির গুপ্তহত্যা নিয়ে দুই হাজারের বেশি গোপন নথি প্রকাশ করেছে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন।

কেনেডি নিহত হওয়ার পর মার্কিন সরকার এ হত্যাকাণ্ড নিয়ে যে ব্যাখ্যা দিয়েছিল, তা যে সঠিক নয়, নতুন প্রকাশিত নথিতে এর পক্ষে তেমন প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

তবে স্নায়ুযুদ্ধ চলাকালে এ হত্যাকাণ্ড নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র যেসব গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করেছিল, প্রকাশিত নথি নতুন করে তাতে আলো ফেলেছে। এসব নথিতে কেনেডির হত্যাকারী সম্পর্কে বিস্তারিত গোয়েন্দা প্রতিবেদন পাওয়া গেছে।

যদিও কেনেডি হত্যাকাণ্ডের পর ছয় দশকের বেশি পেরিয়ে গেছে, এখনো বেশির ভাগ মার্কিন এ হত্যাকাণ্ড নিয়ে সরকারি বয়ানে বিশ্বাস করেন না।

এ নিয়ে ২০২৩ সালে একটি জরিপ চালায় জরিপকারী প্রতিষ্ঠান গ্যালাপ। তাতে উঠে আসে, ওয়ারেন কমিশনের উপসংহার সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছেন ৬৫ শতাংশ মার্কিন।

মার্চে প্রকাশিত নতুন নথিতে ওয়ারেন কমিশনের টানা উপসংহার ছাড়া তেমন নতুন কিছু সামনে আসেনি।

তবে নতুন প্রকাশিত নথির মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়া গেছে, কেনেডিকে হত্যার আগে মেক্সিকো সিটিতে অবস্থিত তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন ও কিউবার দূতাবাসে গিয়েছিলেন অসওয়াল্ড।

একটি নথিতে কিছু গোয়েন্দা প্রতিবেদন রয়েছে। সেসব প্রতিবেদনে অসওয়াল্ড কখন সোভিয়েত ইউনিয়নে গিয়েছিলেন, সে সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য রয়েছে।

সেই নথি অনুযায়ী, চাকরি ও মার্কিন নাগরিকত্ব ছেড়ে ১৯৫৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নে পাড়ি জমান অসওয়াল্ড। তিন বছর পর ১৯৬২ সালে আবার তিনি যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে আসেন।

ওই নথিতে সোভিয়েত গোয়েন্দা সংস্থা কেজিবির নিকোনভ নামে একজন গুপ্তচরের নাম রয়েছে। তিনি সোভিয়েত গোয়েন্দা সংস্থায় থাকা নথিপত্র পর্যালোচনা করে দেখেছেন, অসওয়াল্ড কখনো কেজিবির গুপ্তচর ছিলেন কি না।

মার্কিন সরকারের নজরদারিবিষয়ক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, অসওয়াল্ড যুক্তরাষ্ট্রে আবার ফিরে আসার পর তাঁর গতিবিধি নিবিড়ভাবে নজরদারি করেছিল মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। গত শতকের নব্বইয়ের দশকের একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, অসওয়াল্ড গুলি চালানোর ক্ষেত্রে তেমন দক্ষ ছিলেন না বলে ধারণা করা হয়।

ট্রাম্প প্রথম মেয়াদে প্রেসিডেন্ট থাকাকালে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, এ হত্যাকাণ্ড–সম্পর্কিত সব নথি প্রকাশ করা হবে। কিন্তু সিআইএ ও এফবিআইয়ের অনুরোধে শেষ পর্যন্ত প্রকাশ করতে পেরেছিলেন মাত্র ২ হাজার ৮০০টি নথি।

ট্রাম্পের পর জো বাইডেনের প্রশাসন আরও প্রায় ১৭ হাজার নথি প্রকাশ করে।

ডালাসের লাভ ফিল্ড বিমানবন্দরে এয়ারফোর্স ওয়ানে প্রেসিডেন্ট কেনেডির মৃতদেহ তোলা হচ্ছে। পাশেই জ্যাকুলিন কেনেডিকে দেখা যাচ্ছে
ছবি: জেএফকে লাইব্রেরির ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া

যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে বহু প্রেসিডেন্ট ক্ষমতায় এসেছেন, আবার চলেও গেছেন। খুব কমসংখ্যক প্রেসিডেন্টকেই মানুষ মনে রেখেছেন। মনে রাখা প্রেসিডেন্টদের তালিকায় বেশ ওপরের দিকেই ঠাঁই করে নিয়েছেন ৩৫তম প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি। তাঁকে নিয়ে লেখা হয়েছে অনেক বই, বানানো হয়েছে চলচ্চিত্র। এরপরও যেন তাঁকে নিয়ে জানার তৃষ্ণা মানুষের শেষ হয় না। বেঁচে থাকতে যতটা জনপ্রিয় ছিলেন, মৃত্যুর পর জনপ্রিয়তা যেন আরও বেড়েছে। এখনো বহু মার্কিন শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন তাঁদের এই প্রিয় প্রেসিডেন্টকে।

(তথ্যসূত্র: বিবিসি, আল–জাজিরা, নিউইয়র্ক টাইমস, জেএফকে লাইব্রেরি ডট ওআরজি)