বিশ্বজুড়ে চলছে যুদ্ধ, সহিংসতা আর অস্থিরতা। এরপরও কিছু দেশ এখনো শান্তি, নিরাপত্তা আর স্বস্তির ঠিকানা হয়ে আছে। সেসব দেশে নেই বড় ধরনের সংঘাত, অপরাধের হার তুলনামূলক কম, মানুষজনও উপভোগ করছে নিরাপদ জীবনযাপন। ভ্রমণের জন্য এমন দেশই যে কারও জন্য উপযুক্ত।
ইনস্টিটিউট ফর ইকোনমিকস অ্যান্ড পিস (আইইপি) সম্প্রতি গ্লোবাল পিস ইনডেক্স (জিপিআই) প্রকাশ করেছে। মোট ১৬৩টি স্বাধীন রাষ্ট্র ও অঞ্চলকে কয়েকটি মানদণ্ডে মূল্যায়ন করে চলতি বছর বিশ্বের সবচেয়ে শান্তিপূর্ণ দেশের তালিকা করা হয়েছে। সামাজিক নিরাপত্তা, চলমান অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক সংঘাত এবং সামরিকীকরণের মাত্রার ভিত্তিতে এই তালিকা করা হয়েছে।
২০২৫ সালের এই প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘বিশ্ব এখন সহিংস সংঘাতের সংকটে আছে। ২০২৩ সালে বিশ্বজুড়ে ৫৯টি রাষ্ট্রভিত্তিক সংঘাত ছিল—যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সর্বোচ্চ।’
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শান্তি টিকিয়ে রাখার মূল উপাদান হলো পজিটিভ পিস—অর্থাৎ এমন মনোভাব, প্রতিষ্ঠান ও কাঠামো, যা সমাজে স্থিতিশীলতা আনে। এটি উচ্চ জিডিপি প্রবৃদ্ধি, কম সুদের হার, সামাজিক কল্যাণ ও সংকট মোকাবিলায় সহায়ক।
এবার দেখে নেওয়া যাক—বৈশ্বিক শান্তিপূর্ণ সূচকে কোন কোন দেশ শান্তিপূর্ণ দেশগুলোর শীর্ষ দশে জায়গা করে নিয়েছে।
বিশ্বের সবচেয়ে শান্তিপূর্ণ দেশ হিসেবে আবারও শীর্ষে জায়গা করে নিয়েছে উত্তর ইউরোপের নর্ডিক দেশ আইসল্যান্ড। আগ্নেয়গিরি, উষ্ণ প্রস্রবণ আর অনন্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দেশটি এ বছরের গ্লোবাল পিস ইনডেক্সে প্রথম স্থানে উঠে এসেছে।
শুধু শান্তিপূর্ণ দেশ নয়, ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্টেও তৃতীয় স্থানে আছে আইসল্যান্ড। তাই, উত্তর গোলার্ধে সবচেয়ে আকর্ষণীয় ভ্রমণগন্তব্য হিসেবেও গুরুত্ব পাচ্ছে দেশটি।
একসময় অভ্যন্তরীণ সংঘাতের কারণে জর্জরিত আয়ারল্যান্ড এখন বিশ্বের সবচেয়ে নিরাপদ দেশগুলোর মধ্যে একটি। সামরিকীকরণ হ্রাস আর চলমান সংঘাত কমানোর ক্ষেত্রে শীর্ষে আছে দেশটি। আর এ কারণেই সবচেয়ে শান্তিপূর্ণ দেশের তালিকার দুই নম্বরে আছে আয়ারল্যান্ডের নাম।
কিলডারের বাসিন্দা ও কিলকিয়া ক্যাসেলের অভিজ্ঞতা বিভাগের পরিচালক জ্যাক ফিটসিমন্স বলেন, ‘এখানে মানুষ একে অপরের খেয়াল রাখে। এটা এমন জায়গা, যেখানে আপনি কোনো অচেনা মানুষের কাছে সাহায্য চাইলে সে নিজের সাধ্যমতো আপনাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসবে।’
ফিটসিমন্স বলেন, ‘এখানে জীবন অনেকটা ধীর লয়ে চলে। আর মানুষ এখনো আলাপচারিতা ও গল্প বলাকে গুরুত্ব দেয়। সেই মানবিক সংযোগই আসলে সবচেয়ে বেশি নজরে পড়ে।’
মনোমুগ্ধকর প্রাকৃতিক দৃশ্যের কারণে নিউজিল্যান্ড সুপরিচিত। এ বছর নিউজিল্যান্ড নিরাপত্তা ও সুরক্ষার ক্ষেত্রে উন্নতি এবং বিক্ষোভ ও সন্ত্রাসবাদ-সংক্রান্ত প্রভাব হ্রাস পাওয়ায় র্যাংকিংয়ে দুই ধাপ এগিয়ে এসে তৃতীয় স্থানে পৌঁছেছে।
প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপদেশ হিসেবে নিউজিল্যান্ডের ভৌগোলিক অবস্থান দেশটিকে বাইরের সংঘাত থেকে স্বাভাবিক সুরক্ষা দেয়। দেশটির রিলোকেশন প্রতিষ্ঠান গ্রিনার প্যাস্টার্সের ক্লায়েন্ট এক্সপেরিয়েন্স পরিচালক মিশা ম্যানিক্স-ওপি বলেন, এখানে এমন এক পরিবেশ আছে, যেখানে বাচ্চারা হেঁটে স্কুলে যায়, মানুষ দরজা তালাবদ্ধ না করেই নিশ্চিন্ত থাকে এবং গাড়ি রাস্তায় নষ্ট হলে অন্য চালকেরা সাহায্যের জন্য থেমে যায়।
গ্লোবাল পিস ইনডেক্সে এ বছর অস্ট্রিয়া এক ধাপ পিছিয়ে চতুর্থ স্থানে নেমে এসেছে। তবে সব ক্ষেত্রেই দেশটি এখনো উচ্চ অবস্থানে আছে। আয়ারল্যান্ডের মতোই অস্ট্রিয়া সাংবিধানিকভাবে নির্ধারিত নিরপেক্ষতার নীতি অনুসরণ করে।
স্পা-হোটেল ইয়াগডহফের মালিক আরমিন ফুর্টশেলার বলেন, ‘অস্ট্রিয়ার দীর্ঘ দশকজুড়ে চলা নিরপেক্ষতার নীতির অর্থ হলো, দেশটি সংঘাতে নয়, বরং নিজের জনগণের জন্য বিনিয়োগ করে।’
গ্লোবাল পিস ইনডেক্সের শান্তিপূর্ণ দেশের তালিকায় ৫ নম্বরে আছে সুইজারল্যান্ড। এটি এমন একটি দেশ যেখানে সমাজে উচ্চমাত্রার নিরাপত্তা বিদ্যমান, রাজনৈতিকভাবে স্থিতিশীল এবং আন্তর্জাতিক সংঘাত কার্যত নেই বললেই চলে।
আশ্চর্যজনক মাত্রার সামরিকীকরণ র্যাংকিংয়ের শীর্ষস্থান দখল করতে বড় বাধা দেশটির। তবু অধিকাংশ সূচকে সুইজারল্যান্ড একটি সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে আছে। যেখানে ভাষাগত ও ধর্মীয় বৈচিত্র্যকে সাদরে গ্রহণ করা হয়।
এশিয়ার একমাত্র দেশ সিঙ্গাপুর গ্লোবাল পিস ইনডেক্সের শীর্ষ দশের মধ্যে আছে। দেশটির অবস্থান ষষ্ঠ। নিরাপত্তা ও সুরক্ষার ক্ষেত্রে দেশটির র্যাংকিং ওপরে। তবে বিশ্বের সর্বোচ্চ মাথাপিছু সামরিক ব্যয়ের দেশ এটি।
গ্লোবাল পিস ইনডেক্স প্রথমবার ২০০৮ সালে চালু করা হয়। তখন সিঙ্গাপুর ২২তম স্থানে ছিল। ২০১৯ সালে দেশটি শীর্ষ ১০–এ প্রবেশ করে।
সিঙ্গাপুরের এই উত্থানের কারণ হিসেবে ইনস্টিটিউট ফর ইকোনমিকস অ্যান্ড পিস বলছে, সিঙ্গাপুর সমাজে নিরাপত্তা ও সুরক্ষায় উচ্চ স্কোর অর্জন করেছে এবং চলমান অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক সংঘাতের মাত্রা কম রয়েছে। তবে দেশটিকে র্যাঙ্কিংয়ের সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছাতে বাধা দিচ্ছে সামরিকীকরণের স্তর।
শান্তি ও নিরাপত্তার ক্ষেত্রে পর্তুগাল নিজস্ব পথেই এগিয়ে চলছে। গত কয়েক বছরে প্রায় এক কোটি জনসংখ্যার এই দেশটি গ্লোবাল পিস ইনডেক্সে সবচেয়ে বেশি উন্নতি করা অন্যতম দেশ হিসেবে উঠে এসেছে।
২০১৪ সালে যে দেশ ১৮তম স্থানে ছিল সেখান থেকে শীর্ষ ১০–এর মধ্যে প্রবেশ করেছে—এমন ধারা যেন বিপরীতমুখী হওয়ার কোনো লক্ষণ দেখাচ্ছে না। এই বছর পর্তুগাল তালিকার সপ্তম স্থানে আছে।
পর্তুগালকে মোটের ওপর জীবনযাত্রার মানের কারণে শীর্ষস্থানীয় বিদেশি বসবাসের গন্তব্যগুলোর মধ্যে গণ্য করা হয়। এ ছাড়া প্রজাতন্ত্রটি মহাদেশের মধ্যে অন্যতম সাশ্রয়ী দেশ হিসেবে পরিচিত।
কখনো এক বা দুই ধাপ ওপরে ওঠে, কখনও আবার নেমে আসে—২০০৮ সাল থেকে ডেনমার্ক কখনো গ্লোবাল পিস ইনডেক্সে পঞ্চম স্থানের নিচে নামেনি। এটি ছিল গত বছর পর্যন্ত। এ বছর অষ্টম স্থানে থাকা ডেনমার্কের অবস্থানপতন মূলত অন্যান্য দেশের উন্নতির ফল।
নিজস্ব স্কোরে ডেনোর্কের কোনো উল্লেখযোগ্য পতন ঘটেনি; আগের প্রতিবেদনে এটি মাত্র ০.০৩৭ শতাংশ কমেছিল, আর এবার কমেছে ০.০৫৭ শতাংশ।
র্যাংকিংয়ে এমন ক্ষুদ্র পরিবর্তন শুধু এটুকুই দেখায় যে, দেশটি ভালো অবস্থানে আছে। ভ্রমণ ও বসবাসের জন্য নিরাপদ দেশ ডেনমার্ক, যা উচ্চ রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধার জন্য পরিচিত। দেশটিতে আয়ের সমতা উচ্চ এবং এটি প্রায়ই বিশ্বের সবচেয়ে সুখী দেশগুলোর মধ্যে একটি হিসেবে গণ্য করা হয়।
দীর্ঘমেয়াদি আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা এবং কার্যকর অভ্যন্তরীণ শাসন ব্যবস্থার প্রতিফলন ঘটিয়ে স্লোভেনিয়া শীর্ষ দশে তার স্থান ধরে রেখেছে। তালিকার নবম স্থানে থাকা দেশটিতে সহিংস অপরাধের নিম্ন স্তর, ন্যূনতম রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং সীমিত সামরিক সম্পৃক্ততা আছে।
দেশটি মধ্য ও পূর্ব ইউরোপের একমাত্র দেশ, যা শীর্ষ ১০–এর মধ্যে জায়গা পেয়েছে এবং এই অঞ্চলের সবচেয়ে শান্তিপূর্ণ দেশ হিসেবে স্বতন্ত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে।
নর্ডিক এই দেশটিতে কম অপরাধের হার, প্রতিষ্ঠানের প্রতি উচ্চ আস্থা এবং শক্তিশালী কল্যাণ রাষ্ট্রের জন্য পরিচিত। দেশটি বৈশ্বিক শান্তি সূচকে দশম অবস্থানে আছে।
২০০৮ সালে গ্লোবাল পিস ইনডেক্স চালু হওয়ার পর প্রায় এক দশক ধরে ফিনল্যান্ড শীর্ষ ১০–এ ছিল। তবে ২০১৭ সালের দিকে দেশটি কিছুটা পিছিয়ে যেতে শুরু করে। ধীরে ধীরে দেশটির প্রতিরক্ষা ব্যয় বাড়তে থাকে।
২০২২ সালে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে, রাশিয়ার সঙ্গে সীমান্ত ভাগ করা ফিনল্যান্ডের সামরিক ব্যয় ৩৬ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। সেই বছরের শান্তি সূচকে ফিনল্যান্ডকে ১৬তম স্থানে রাখা হয়—যা দেশটির রেকর্ড সর্বনিম্ন অবস্থান।