আইন বাতিল, কৃষকের ভোট কি জুটবে মোদির

তিন আইন পাসের পর থেকে লাগাতার আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন কৃষকেরা। কেন্দ্রীয় সরকার এ আন্দোলনে কর্ণপাত করেনি
ফাইল ছবি: এএফপি

তিন কৃষি আইন প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বললেন, তপস্যায় নিশ্চয়ই ঘাটতি ছিল, তাই কৃষকদের সন্তুষ্ট করা সম্ভব হয়নি। মোদির এ বক্তব্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এই তিন আইন পাসের পর থেকে লাগাতার আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন কৃষকেরা। কেন্দ্রীয় সরকার এ আন্দোলনে কর্ণপাত করেনি। কিন্তু হঠাৎ করেই অবস্থান বদলে তিনি বললেন, আজ কাউকে দোষ দেওয়ার সময় নয়। আর এ প্রেক্ষাপটেই সামনে আসছে ২০২২ সালে বিধানসভা নির্বাচনের ভোট, কৃষকদের ভোট এবং শিখদের সঙ্গে ক্ষমতাসীন বিজেপির সম্পর্কের কথা।

বিজেপির সরকারের এ সিদ্ধান্ত যে ভোটকেন্দ্রিক, তা বলছেন অনেক বিশ্লেষকই। মোদির এই ঘোষণার পর ভারতের গণমাধ্যম দ্য হিন্দু সরাসরি উত্তর প্রদেশের নির্বাচনের দিকেই আঙুল তুলেছে। তারা বলছে, এ সিদ্ধান্ত উত্তর প্রদেশের ভোটের সমীকরণের ওপর প্রভাব ফেলবে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, এই তিন আইন পাস করার পর অনেক কৃষকই খেপেছিলেন বিজেপির ওপর। বিজেপিকে ভোট দেন এমন কৃষকও অন্য দলগুলোর প্রতি ঝুঁকছিলেন। তাঁদের হয়তো ঠেকানো যাবে এ সিদ্ধান্তের কারণে।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি
ফাইল ছবি: রয়টার্স

ইন্ডিয়া টুডের খবরে বলা হয়েছে, কৃষিক্ষেত্রে সংস্কারের উদ্দেশ্যে গত বছর কোভিড পরিস্থিতির মধ্যে সেপ্টেম্বর মাসে পার্লামেন্টের অধিবেশনে বিনা আলোচনায় তিনটি বিল আইনে রূপান্তরিত হয়। বিরোধীদের দাবি, কৃষকদের দাবি উপেক্ষা করেই আইনগুলো পাস করা হয়। তখন বিজেপি তার অনড় অবস্থানের কথা বারবার বলেছে। কৃষক প্রতিনিধিদের সঙ্গে নামমাত্র আলোচনাও হয়েছে। কিন্তু কাজ হয়নি।

মোদির এ সিদ্ধান্ত বদলের কারণে উত্তর প্রদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি যে এক চোটে বিজেপির নিয়ন্ত্রণে এসেছে, এমনটা নয়। উত্তর প্রদেশে ধর্মীয় বিভাজনের যে ফায়দা বিজেপি এর আগে ঘরে তুলেছিল, তা এবার তোলা কঠিন হবে বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। কারণ, কৃষকদের এই আন্দোলন জাট ও মুসলমানদের কাছে এনেছে। আর জাটরাও খেপেছে বিজেপির ওপর। বেশ কিছু গ্রামে বিজেপির স্থানীয় নেতাদের ঢুকতে না দেওয়ার ঘোষণাও দিয়েছে তারা। মোদির আইন বাতিলের ঘোষণার বদলের পরও জাটরা বলছে, এ সিদ্ধান্ত বহাল থাকবে।

ভারতের রাজধানী দিল্লিতে ট্রাক্টর মিছিল করা হয়। তারই অংশ হিসেবে বেঙ্গালুরুতে ট্রাক্টর মিছিলে অংশ নেন স্থানীয় কৃষকেরা
ফাইল ছবি: এএফপি

এই তিন আইন বাতিলে যুক্ত হয়েছে মোদি ও উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের নেতৃত্বের দৌড়ও। দলটির এক সূত্র বলছে, এই আইন থাকার পরও যোগী যদি নির্বাচনে জিতে যান, তবে ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী মুখ হতে পারতেন আদিত্যনাথ। কিন্তু বিজেপির একটি অংশ চায় না, যোগী আদিত্যনাথ এই প্রতিযোগিতায় সফল হোক।

২০২২ সালে যে রাজ্যগুলোয় বিধানসভা নির্বাচন হবে, তার মধ্যে অন্যতম পাঞ্জাব। ভারতের এ রাজ্য একমাত্র শিখপ্রধান। কৃষি আইন বাতিলে যাঁরা আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম এ রাজ্যের কৃষকেরা। শিখদের আধিক্যও দেখা গেছে এ আন্দোলনে। আর তাদের কথা মাথায় রেখে মোদি গতকালের দিন বেছে নিয়েছিলেন কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। কারণ, গতকাল শুক্রবার ছিল শিখধর্মাবলম্বীদের পবিত্র ‘গুরু পরব’। শিখদের প্রথম গুরু নানক দেবের জন্মবার্ষিকী। আর এই দিনই মোদি আইন প্রত্যাহারের ঘোষণা দিলেন, শিখদের গুরুর নামও উল্লেখ করলেন। এনডিটিভি এ প্রসঙ্গ উল্লেখ করেছিল তাদের খবরে। গতকাল তাদের খবরে বলা হয়েছিল, উত্তর প্রদেশ আর পাঞ্জাবের নির্বাচনের আগে মোদি আইনগুলো বাতিলের সিদ্ধান্তের কথা জানালেন। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত পাঞ্জাবের ভোটের ওপর কতটা প্রভাব ফেলতে পারবে, সেটা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে।

ভারতের এই দুই বড় রাজ্য ছাড়াও উত্তরাখন্ড, মনিপুর, গোয়ায় নির্বাচন হবে আগামী বছরের শুরুর দিকে। আর বছরের শেষ দিকে নির্বাচন হবে হিমাচল ও গুজরাটে। ফলে ভোটের সমীকরণে যে এ সিদ্ধান্তে কার্যকর ভূমিকা রেখেছে, তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু মোদি দাবি করেছেন, তিনি যা করছেন, দেশের জন্য করছেন; যা করেছিলেন দেশের কৃষকের কথা মাথায় রেখে করেছিলেন। আর এখানেই প্রশ্ন ওঠে, যখন আইন করা হলো, তখন কি কৃষকের স্বার্থ মাথায় ছিল? আর এত বড় আন্দোলন শুরুর পর এত দিন কেন লাগল বোধোদয়ের জন্য?

কৃষকদের আন্দোলন ভারতের সাম্প্রতিক সময়ে হওয়া আন্দোলনগুলোর মধ্যে অন্যতম। পরিসংখ্যানও তাই বলছে। দেখা যাচ্ছে, পাঞ্জাব-হরিয়ানাসহ বিভিন্ন রাজ্যের কৃষকেরা দিল্লির সীমান্তে এসে অবস্থান নিয়েছেন। প্রায় এক বছর ধরে তাঁরা সেখানে থাকছেন। সেখানে শিশুদের পড়াশোনা করাতে স্কুল গড়ে তোলা হয়েছে। কমিউনিটি কিচেন পরিচালনা করে কৃষকদের খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে দিনের পর দিন। এ আন্দোলনে ৭০০–এর বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। কিন্তু সরকার কর্ণপাত করেনি। উল্টো বিজেপির নেতারা কৃষকদের গায়ে দেশদ্রোহীর তকমা লাগিয়ে দিয়েছেন। মামলা করে, হামলা চালিয়ে কৃষকদের কোণঠাসা করার চেষ্টা করেছেন বিজেপির নেতা-কর্মীরা।

একটি দেশের সরকার তার দেশের জনগণকে নিয়ে ভাববে, এটাই স্বাভাবিক। মোদিও তাই বলছেন। কিন্তু কথা আর কাজে সেই মিল পাওয়া যাচ্ছে না বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। এই আন্দোলনের শুরুতে লক্ষ্য করা গেছে, শিখদের সঙ্গে বিজেপির সম্পর্ক নিয়ে বুকলেট প্রকাশ করতে হয়েছে। একটি সম্প্রদায়ের মানুষের সঙ্গে ক্ষমতাসীনদের সম্পর্কে কতটা অবনতি হলে এমনটা করতে পারে, সেটা ওই বুকলেটই স্পষ্ট করে দিয়েছে।

ভোটের আগে কৃষক মহান হয়ে উঠছেন মোদির কাছে। তিনি কৃষকদের ওপর কোনো দোষ চাপাননি। কিন্তু তিনি এটাও বলেননি যে আইনটি করা ঠিক হয়নি। তিনি বলেছেন, তাঁরা কৃষককে বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছেন। আর কৃষকদের অবস্থান যদি লক্ষ্য করা যায়, তাতেও দুই পক্ষের মধ্যে অবিশ্বাসের অবস্থানটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কৃষকেরা বলছেন, বিজয় হয়েছে। কিন্তু আইন বাতিল না হওয়া পর্যন্ত মাঠে থাকবেন তাঁরা।

এখন কথা হলো, মোদি যে উদ্দেশ্য নিয়ে এই আইন তিনটি বাতিল করলেন, সেই উদ্দেশ্য—ভোটে কি তিনি সফল হতে পারবেন? কৃষক কী সব ভুলে, সতীর্থের মৃত্যুর ঘটনা ভুলে ভোট তুলে দেবেন বিজেপির ঝুলিতে?