আচার্য পদে মুখ্যমন্ত্রীর নিয়োগ নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি সরগরম

মমতা ব্যানার্জি
ছবি: ভাস্কর মুখার্জি

আচার্যের পদ থেকে রাজ্যপালকে সরানো নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি সরগরম। রাজ্য মন্ত্রিসভা সিদ্ধান্ত নিয়েছে, রাজ্যপালের বদলে মুখ্যমন্ত্রীকে আচার্য করা হবে। এবার বিধানসভায় সেই বিল আসছে। তারপর রাজ্যপালের অনুমোদন পেলে তা আইনে পরিণত হবে।

গত ২৬ মে পশ্চিমবঙ্গের মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, এখন থেকে রাজ্যের সব সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে চ্যান্সেলর বা আচার্য পদে নিয়োগ করা হবে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে। একই সঙ্গে রাজ্যের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিজিটর বা পর্যবেক্ষক পদে বসানো হবে রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রীকে।

পশ্চিমবঙ্গে সরকারি তালিকাভুক্ত ৩৩টি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি এই রাজ্যের একমাত্র কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। সেটি হলো শান্তিনিকেতনের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য ভারতের প্রধানমন্ত্রী হলেও অন্য সব সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য পদে পদাধিকার বলে রাজ্যের গভর্নর বা রাজ্যপাল এবং বিশিষ্ট শিক্ষাবিদেরা রয়েছেন।

মুখ্যমন্ত্রীকে আচার্য পদে এবং শিক্ষামন্ত্রীকে পর্যবেক্ষক পদে বসানোর বিল ইতিমধ্যে রাজ্য বিধানসভায় পাস করার জন্য পেশ করা হয়েছে। এর আগে গত সোমবার এই নতুন বিলকে অনুমোদন দিয়েছে রাজ্যের মন্ত্রিসভা। একই সঙ্গে অনুমতি দেওয়া হয়েছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পর্যবেক্ষক পদে রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রীকেও বসানোর।

চলতি বর্ষাকালীন রাজ্য বিধানসভার অধিবেশনে এই বিল উঠবে বিধানসভায় আলোচনার জন্য। যেহেতু বিধানসভায় তৃণমূল একক সংখ্যাগরিষ্ঠ সেহেতু এই বিল পাস করাতে কোনো অসুবিধা হবে না। তবে এই বিল পাসের পর রাজ্যপাল যদি তাঁকে অপসারণ করে, আচার্য পদে মুখ্যমন্ত্রীকে বসানোর বিলে সই না করেন, সে ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ সরকার অর্ডিন্যান্স জারি করে এই বিল পাস করিয়ে নেবে।

এদিকে এই সিদ্ধান্তের পর এ নিয়ে রাজ্য রাজনীতি উত্তাল হয়ে উঠেছে। অনেক ছাত্রসংগঠন এবং শিক্ষকমণ্ডলীর অনেকেই আচার্য পদ থেকে রাজ্যপালকে সরিয়ে মুখ্যমন্ত্রীকে বসানোর সিদ্ধান্তকে ভালো চোখে নেননি। তাঁরা বলেছেন, এতে শিক্ষাক্ষেত্রেও রাজনীতির অনুপ্রবেশ ঘটবে। শিক্ষাব্যবস্থার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হবে। এভাবে মুখ্যমন্ত্রী ক্ষমতা কুক্ষিগত করার লক্ষ্যে নিজেকে আচার্য পদে বসাতে পারেন না।

রাজ্য বিজেপির সাবেক সভাপতি ও সাবেক রাজ্যপাল তথাগত রায় বলেছেন, আচার্য পদে থাকতে হলে রাজ্যপালের সম্মতির প্রয়োজন হবে। এত সহজভাবে মমতা আচার্য পদে অধিষ্ঠিত হতে পারবেন না।

রাজ্যের বিরোধীদলীয় নেতা ও বিজেপি বিধায়ক শুভেন্দু অধিকারী বলেছেন, ‘আমরা সর্বশক্তি দিয়ে এই সিদ্ধান্ত রুখব। যদিও শাসক দল পাল্টা দাবি করে বলেছে, রাজ্য বিধানসভায় এ-সংক্রান্ত আইন পাস হলে রাজ্যপাল ওই বিলে স্বাক্ষর করতে বাধ্য হবেন। আবার এই বিল পাস হলে রাজ্যপালকে তার অপসারণের বিলও অনুমোদন করতে হবে এবং ওই বিলেও স্বাক্ষর করতে হবে।’

এই সিদ্ধান্তের পর বিজেপির প্রধান মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্য বলেছেন, ‘শিক্ষাক্ষেত্রে নৈরাজ্য, একাধিক নিয়োগ কেলেঙ্কারি থেকে মানুষের নজর ঘোরাতে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। রাজ্য সরকার তো এখন নিজেদের একটি স্বাধীন অঙ্গরাজ্য হিসেবে ভাবতে শুরু করেছে।’

পাশাপাশি বিরোধীদলীয় নেতা শুভেন্দু অধিকারী বলেছেন, শিক্ষাক্ষেত্র কেন্দ্রীয় সরকার ও রাজ্য সরকারের যৌথ তালিকাভুক্ত বিষয়। তাই রাজ্য এত সহজে যা ইচ্ছা তা করতে পারবে না।

আর সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তী বলেছেন, এই সিদ্ধান্ত দুর্ভাগ্যজনক ও হাস্যকর। বর্তমান রাজ্যপালকে নিয়ে সমস্যা থাকলে সেখানে আচার্য পদে কোনো শিক্ষাবিদকে দেওয়া যেতে পারে। তিনি বলেন, নিরলস সাহিত্য সাধনার জন্য বাংলা একাডেমির পুরস্কার পাওয়ার পর মুখ্যমন্ত্রী নিজেকে এখন শিক্ষাবিদ মনে করছেন। আরও বলেন, যার ‘জাল’ ডক্টরেট ডিগ্রি নিয়ে এত বিতর্ক ছিল, তাঁর হাত থেকেই এখন পড়ুয়াদের ডিগ্রির সনদ নিতে হবে!

অন্যদিকে কেন্দ্রীয় শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী সুভাষ সরকার বলেছেন, পশ্চিমবঙ্গের মতো মুখ্যমন্ত্রীকে আচার্য করার চেষ্টা দেশে আর কোথায়ও হয়নি।

আর তৃণমূল কংগ্রেসের জাতীয় মুখপাত্র ও সংসদ সদস্য সুখেন্দু শেখর রায় বলেছেন, ‘শিক্ষাক্ষেত্রে দুর্নীতি, দলীয় রাজনীতির প্রভাব নিয়ে বাম ও বিজেপির কোনো কথা বলার অধিকার নেই। বাম জমানায় তো দলীয় ক্যাডার নিয়োগ হতো, তা সর্বজনবিদিত। সেই সঙ্গে গোটা দেশের শিক্ষায় গৈরিককরণ তো এখন সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে।’

আর এসব বিতর্কের মধ্যেই কলকাতার বিশিষ্টজনদের একাংশ এই বিলের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন। তাঁরা বলেছেন, এভাবে রাজ্যের শিক্ষাক্ষেত্রের রাজনীতিকায়ন করা ঠিক হবে না। এতে শিক্ষাব্যবস্থায় রাজনীতির অনুপ্রবেশ ঘটবে। কলুষিত হবে। তাই এই বিলের বিরোধিতায় বিশিষ্টজনদের স্বাক্ষর সংগ্রহ অভিযান শুরু হয়েছে। এই অভিযানে রয়েছেন বিশিষ্ট নাট্যকার ও নাট্যব্যক্তিত্ব বিভাস চক্রবর্তী, নাট্যব্যক্তিত্ব কৌশিক সেন, বিশিষ্ট চিত্রকর সমীর আইচ প্রমুখ।