‘অনুগত’ নেতাদের মনোনয়ন কংগ্রেসের, ক্ষোভ

ভারতের রাজনৈতিক দল কংগ্রেসের অন্তর্বতীকালীন প্রেসিডেন্ট সোনিয়া গান্ধী দলের কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠকে বক্তব্য দেন। এ সময় পাশেই ছেলে রাহুল গান্ধী ও দলের নেতা কে সি ভেনুগোপাল।নয়াদিল্লিতে কংগ্রেসের সদরদপ্তরে
ছবি: এএনআই

ভারতীয় পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভার নির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়নের মধ্য দিয়ে কংগ্রেসের শীর্ষ নেতৃত্ব বুঝিয়ে দিল, এত বছর ধরে দল যেভাবে চলে আসছে, তা থেকে তারা বিচ্যুত হচ্ছে না। গান্ধী পরিবার তাঁদেরই বেছে নিলেন, যাঁরা আনুগত্যের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ। মনোনীতদের অধিকাংশই পুরোনো মুখ, যাঁরা দীর্ঘদিন ক্ষমতাভোগ সত্ত্বেও দলকে ভরাডুবির হাত থেকে বাঁচাতে ব্যর্থ। রাজ্যসভার এ মনোনয়ন কংগ্রেসের সর্বস্তরে ক্ষোভ ও হতাশার সৃষ্টি করেছে। সেই সঙ্গে বিস্ময়ও।

আগামী ১০ জুন দেশের ১৫ রাজ্য থেকে ৫৭ জন নির্বাচিত হবেন রাজ্যসভায়। বিভিন্ন রাজ্য বিধানসভায় দলগত শক্তির নিরিখে এই আসনগুলো থেকে কংগ্রেসের জয়ের সম্ভাবনা রয়েছে ১০টিতে। গত রোববার কংগ্রেস ১০ প্রার্থীর নাম ঘোষণা করার পর থেকেই ক্ষোভের পাশাপাশি উঠতে শুরু করেছে একাধিক প্রশ্ন। এখনো যে দুই রাজ্যে কংগ্রেস ক্ষমতায় রয়েছে, আগামী বছরের বিধানসভা ভোটে সেই রাজস্থান ও ছত্তিশগড় ধরে রাখা সম্ভবপর হবে কি না, প্রার্থী মনোনয়নের পর সেই প্রশ্ন জোরালো হয়ে উঠেছে।

ক্ষোভ ও বিস্ময়ের প্রধান কারণ, যে ১০ জনকে বাছা হয়েছে, তাঁদের মধ্যে সাতজনই ‘বহিরাগত’ (রাজ্যের বাইরের প্রার্থী)। অন্য রাজ্য থেকে তাঁদের জিতিয়ে রাজ্যসভায় আনা হবে। যেমন রাজস্থান থেকে কংগ্রেস জেতার কথা তিনটি আসন (ক্রস ভোটিং না হলে) ও ছত্তিশগড় থেকে দুটি। এই দুই রাজ্যে যাঁদের প্রার্থী করা হয়েছে, তাঁরা প্রত্যেকেই অন্য রাজ্যের বাসিন্দা। যেমন কংগ্রেস মুখপাত্র রণদীপ সিং সুরযেওয়ালা হরিয়ানার, মুকুল ওয়াসনিক মহারাষ্ট্রের ও প্রমোদ তিওয়ারি উত্তর প্রদেশের। তাঁদের মনোনীত করা হয়েছে রাজস্থান থেকে।

আগের নির্বাচনেও রাজস্থান থেকে জেতানো হয়েছিল কেরালার নেতা কে সি বেনুগোপালকে। রাজীব শুক্ল দিল্লির বাসিন্দা। আগে উত্তর প্রদেশ থেকে রাজ্যসভায় এসেছিলেন। এবার মনোনীত হয়েছেন ছত্তিশগড় থেকে। একই রকমভাবে বিহারের ‘বাহুবলী’ কংগ্রেস নেতা পাপ্পু যাদবের স্ত্রী রঞ্জিত রঞ্জনকে দেওয়া হয়েছে ছত্তিশগড়ের দ্বিতীয় আসন। দিল্লির রাজনীতিক সাবেক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অজয় মাকেনকে মনোনীত করা হয়েছে হরিয়ানা থেকে। উত্তর প্রদেশের তরুণ নেতা ও কবি মহম্মদ ইমরান প্রতাপগড়িকে জেতানো হবে মহারাষ্ট্র থেকে। সাবেক অর্থমন্ত্রী পি চিদাম্বরম, জয়রাম রমেশ ও বিবেক তনখা তাঁদের নিজেদের রাজ্য যথাক্রমে তামিলনাড়ু, কর্ণাটক ও মধ্যপ্রদেশ থেকে দাঁড়িয়েছেন। এই তিনজনই শুধু ‘বহিরাগত’ নন।

তিন বছর ধরে দলের যে নেতারা সংস্কারের দাবি জানিয়ে আসছিলেন, যাঁরা ‘জি-২৩’ গোষ্ঠীভুক্ত বলে পরিচিত এবং সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধীকে চিঠি লিখেছিলেন, তাঁদের মধ্যে রাজ্যসভায় মনোনীত হলেন শুধু মুকুল ওয়াসনিক ও বিবেক তনখা। প্রবীণ গুলাম নবী আজাদ ও আনন্দ শর্মার সম্ভাবনা নিয়ে কদিন ধরে কথা চলছিল। তালিকা প্রকাশের পর বোঝা গেল, তাঁদের ভাগ্যও অনিশ্চিত। ‘জি-২৩’ অন্যতম নেতা আইনজীবী কপিল সিব্বাল মনোনয়ন পাবেন না জানতে পেরে আগেই সমাজবাদী পার্টির সঙ্গে বোঝাপড়া করে নিয়েছেন। ওই দলের টিকিটে তিনি রাজ্যসভায় প্রার্থী।

মনোনীত ১০ জনের মধ্যে একমাত্র নতুন মুখ মহম্মদ ইমরান প্রতাপগড়ি। ৩৪ বছর বয়সী এই উর্দু কবি গত নির্বাচনের সময় প্রিয়াঙ্কা গান্ধীর নজর কেড়েছিলেন। ইমরান, রাজীব শুক্ল ও প্রমোদ তিওয়ারি তিনজনই প্রিয়াঙ্কার পছন্দের। সুরযেওয়ালা ও অজয় মাকেন বরাবর রাহুল-ঘনিষ্ঠ। চিদাম্বরম ও জয়রাম রমেশ সুবক্তা। সাংসদ হিসেবে দক্ষ। সোনিয়া গান্ধীর পছন্দের। বিবেক তনখা কাশ্মীরি পণ্ডিত ও মুকুল ওয়াসনিক দলিত। ‘জি-২৩’ভুক্ত হলেও গান্ধী পরিবারের বিরুদ্ধাচরণ তাঁরা করেননি। রঞ্জিত রঞ্জন একমাত্র নারী। অর্থাৎ জাত-ধর্মের কোটার রাজনীতিতে কংগ্রেস ভারসাম্য রাখার চেষ্টা করেছে।

কিন্তু কংগ্রেসের উদয়পুরের ‘চিন্তন শিবির’-এর সিদ্ধান্ত হয়েছিল, যেকোনো নির্বাচনে মোট প্রার্থীর ৫০ শতাংশ হবেন ৫০ বছরের কম বয়সী। রাজ্যসভায় ১০ মনোনীতের মধ্যে সেই শর্ত পূরণ করেছেন মাত্র দুজন। ইমরান প্রতাপগড়ি (৩৪) ও রঞ্জিত রঞ্জন (৪৮)। ‘এক পরিবার একটি আসন’ নীতিও লঙ্ঘিত হলো। প্রমোদ তিওয়ারির কন্যা আরাধনা উত্তর প্রদেশের রামপুরের বিধায়ক। গত বিধানসভা ভোটে ওই রাজ্যে মাত্র দুটি আসন কংগ্রেস জিতেছিল। ‘এক ব্যক্তি এক পদ’ নীতিও উপেক্ষিত হলো। মুকুল ওয়াসনিক, রণদীপ সুরযেওয়ালা, রাজীব শুক্ল, রঞ্জিত রঞ্জন, বিবেক তনখা, অজয় মাকেন প্রত্যেকেই এআইসিসির পদাধিকারী। বোঝা যাচ্ছে, এত শোরগোল সত্ত্বেও কংগ্রেস চলছে তার পরিচিত ঢঙে।

রাজস্থান ও ছত্তিশগড় ছিনিয়ে নিতে বিজেপি বদ্ধপরিকর। তারা ইতিমধ্যে ‘বহিরাগত’ বিষয়টি নিয়ে সরব। প্রকাশ্যে ক্ষোভ দেখাচ্ছেন দুই রাজ্যের কংগ্রেসিরাও। কংগ্রেসের পরিচিত মুখ পবন খেরা টুইট করে বলেছেন, ‘আমার তপস্যায় নিশ্চয় এখনো ঘাটতি রয়েছে। ’ সাবেক অভিনেত্রী ও পরিচিত কংগ্রেসি নাগমা টুইট করে বলেছেন, ‘ইমরানের তুলনায় আমার ১৮ বছরের তপস্যা কিছুই নয়! ’