উত্তর প্রদেশের ভোট যে কারণে মোদির জন্য জনপ্রিয়তার পরীক্ষা

মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথকে সাহায্য করতে প্রধানমন্ত্রী মোদিকে উত্তর প্রদেশ রাজ্যে বারবার ছুটে যেতে দেখা গেছে
ছবি: রয়টার্স

উত্তর ভারতের রাজ্য উত্তর প্রদেশ। ১০ ফেব্রুয়ারি রাজ্যটিতে সাত ধাপের বিধানসভা নির্বাচন শুরু। দেশটির সবার নজর এখন এই নির্বাচনের দিকে। উত্তর প্রদেশের এই নির্বাচন কেন গুরুত্বপূর্ণ, তা ব্যাখ্যা করেছেন বিবিসির গীতা পাণ্ডে।

উত্তর প্রদেশ কেন গুরুত্বপূর্ণ
ভারতের পাঁচটি রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন আসন্ন। এই পাঁচ রাজ্যের মধ্যে উত্তর প্রদেশ অন্যতম; বরং বলা যায়, সবার চোখ এখন উত্তর প্রদেশের ভোটযুদ্ধের দিকে।

উত্তর প্রদেশ সাধারণত নামের আদ্যক্ষর ‘ইউপি’ দিয়ে পরিচিত। এটি ভারতের সবচেয়ে জনবহুল রাজ্য। রাজ্যের জনসংখ্যা প্রায় ২৪০ মিলিয়ন।

উত্তর প্রদেশ যদি একটি দেশ হতো, তাহলে জনসংখ্যার দিক দিয়ে তা হতো বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম দেশ। রাজ্যটির জনসংখ্যা ব্রাজিলের চেয়েও বেশি।

ভারতের পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ লোকসভা। লোকসভায় সর্বাধিকসংখ্যক এমপি আসেন উত্তর প্রদেশ থেকে, এই সংখ্যা ৮০। এ কারণে প্রায়ই বলা হয়, যে দল উত্তর প্রদেশে জয়ী হয়, তারাই দেশ শাসন করে।

যোগী আদিত্যনাথ
ছবি: রয়টার্স

ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুসহ দেশটির বেশ কয়েকজন প্রধানমন্ত্রী উত্তর প্রদেশ রাজ্য থেকেই এসেছেন।

ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি অবশ্য দেশটির পশ্চিমাঞ্চলীয় গুজরাট রাজ্যের মানুষ। তবে ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে তিনি যখন প্রথম প্রার্থী হন, তখন উত্তর প্রদেশের বারাণসী আসনকেই বেছে নেন। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনেও তিনি এই আসন থেকে পুনরায় নির্বাচিত হন।

দেশটির গত দুটি সাধারণ নির্বাচনে ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) বিপুল জয়লাভের কৃতিত্ব উত্তর প্রদেশের ভোটাররা দাবি করতেই পারেন। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে দলটি এই রাজ্যে ৭১টি আসন পায়। আর ২০১৯ সালের নির্বাচনে পায় ৬২টি আসন।

ভোটের মাঠের প্রধান খেলোয়াড়
গত শতকের শেষ দিক থেকে রাজ্যের রাজনীতিতে আঞ্চলিক সমাজবাদী পার্টি ও বহুজন সমাজ পার্টির (বিএসপি) আধিপত্য লক্ষ করা যায়। দল দুটি পর্যায়ক্রমে ক্ষমতায় আসীন হয়। এই দুই দলের দাপটে রাজ্যে কংগ্রেস ও বিজেপি কোণঠাসা হয়ে পড়ে।

তবে প্রধানমন্ত্রী মোদির জনপ্রিয়তা ও ক্যারিশমার ওপর ভর করে ২০১৭ সালে রাজ্যের ৪০৩ আসনের বিধানসভায় ৩১২টি আসন পায় দলটি। পপুলার ভোটের প্রায় ৪০ শতাংশ জিতে বিজেপি রাজ্য বিধানসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে।

অখিলেশ যাদব
ছবি: রয়টার্স

রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে বিজেপি বেছে নেয় যোগী আদিত্যনাথকে। হিন্দু সন্ন্যাসী থেকে রাজনীতিবিদ বনে যাওয়া আদিত্যনাথ তাঁর বিভাজনমূলক দৃষ্টিভঙ্গির জন্য বহুল পরিচিত। বিজেপির বিতর্কিত এই রাজনীতিবিদ আবার রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার আশা করছেন।

আদিত্যনাথকে সাহায্য করতে খোদ নরেন্দ্র মোদিকে উত্তর প্রদেশে বারবার ছুটে যেতে দেখা গেছে। তিনি সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বেশ কয়েকবার রাজ্যটি সফর করেছেন।

রাজ্যে আয়োজিত সভা-সমাবেশে ভাষণ দেন মোদি। রাজ্যে বিজেপিকে আবার সুযোগ দেওয়ার জন্য তিনি ভোটারদের কাছে আহ্বান জানান।

বিতর্কিত কৃষি আইন করার জেরে রাজ্যে বিজেপি তার আগের অবস্থান হারিয়েছে। প্রায় এক বছর ধরে কৃষকদের বিক্ষোভের মুখে গত বছরের শেষ দিকে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার এই আইন বাতিল করতে বাধ্য হয়।

গত বছর করোনা মহামারি মোকাবিলায় উত্তর প্রদেশ সরকারের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত হতাশাজনক। করোনায় সংক্রমিত হয়ে মারা যাওয়া শত শত মানুষের লাশ রাজ্যের গঙ্গা নদীতে ভেসে উঠতে দেখা যায়।

যদিও মহামারি চলাকালে বিনা মূল্যে রেশন দেওয়ার জন্য রাজ্য সরকার প্রশংসিত হয়। তবে তরুণদের কর্মসংস্থানের অভাব ও বেড়ে চলা মুদ্রাস্ফীতি নিয়ে রাজ্যে অসন্তোষ রয়েছে।

নির্বাচনী সমাবেশে আদিত্যনাথ (৪৯) দাবি করেন, তিনি রাজ্যে অনেক কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছেন। রাজ্যের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করেছেন। রাজ্যের আইনশৃঙ্খলার উন্নতি করেছেন। হিন্দু ভোট জিততে মুসলিমবিরোধী বক্তব্যও নির্বাচনী সভা-সমাবেশে দিয়েছেন আদিত্যনাথ।

রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনে আদিত্যনাথের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ৪৮ বছর বয়সী অখিলেশ যাদবের নেতৃত্বাধীন সমাজবাদী পার্টি। অখিলেশ রাজ্যের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী। ২০১৭ সালে বিজেপির কাছে হেরে ক্ষমতা থেকে বিদায় নেন তিনি।

মায়াবতী
ছবি: রয়টার্স

তবে বিজেপির কাছ থেকে ক্ষমতা কেড়ে নিতে অখিলেশ কঠোর পরিশ্রম করে চলেছেন। তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, ক্ষমতায় গেলে রাজ্যের সব ঘরে বিনা মূল্যে বিদ্যুৎ দেবেন। দরিদ্র নারীদের জন্য পেনশনের ব্যবস্থা করবেন। কৃষকদের সুদমুক্ত ঋণ দেবেন।

কয়েকটি ছোট আঞ্চলিক দলের সঙ্গে জোট বাঁধার পর আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে অখিলেশের সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়েছে।

দলিত নেত্রী মায়াবতীর নেতৃত্বে বিএসপিও রাজ্যের ক্ষমতায় ফিরতে চাইছে, কিন্তু অনেকেই তাঁর পক্ষে বাজি ধরতে রাজি নন।

মায়াবতী রাজ্যের চারবারের মুখ্যমন্ত্রী। তিনি ২০১২ সালে ক্ষমতা হারান। মায়াবতী তাঁর সম্প্রদায়ের মধ্যে জনপ্রিয়, কিন্তু ক্ষমতায় থাকাকালে নিজের ও অন্যান্য দলিত আইকনের আবক্ষমূর্তি নির্মাণের জন্য লাখ লাখ রুপি ব্যয় করে সমালোচিত হন তিনি।

মায়াবতী প্রায় এক দশক ধরে ক্ষমতার বাইরে। খুব স্বাভাবিকভাবেই তিনি ‘সাইডলাইনে’। আসন্ন নির্বাচনী প্রচারণাও খুব একটা জমাতে পারেননি তিনি।

ভারতের প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসসহ বেশ কয়েকটি ছোট দল উত্তর প্রদেশে ভোটের মাঠে রয়েছে। প্রিয়াঙ্কা গান্ধীর নেতৃত্বে তাঁর উদ্যমী প্রচারে কংগ্রেস রাজ্যে মনোযোগ আকর্ষণ করতে পেরেছে।

উত্তর প্রদেশে ধর্ষণের শিকার নারীর পরিবারের কাছে ছুটে গেছেন প্রিয়াঙ্কা। পুলিশি নির্যাতনের শিকার পরিবারের কাছে গেছেন তিনি। নির্বাচনী প্রচারে নারী ভোটারদের গুরুত্ব দিয়ে সংবাদের শিরোনাম হয়েছেন প্রিয়াঙ্কা। এই নির্বাচন উপলক্ষে তাঁর ব্যক্তিগত তৎপরতা অনেক বেশি ছিল। কিন্তু মাঠপর্যায়ে কংগ্রেসের প্রতি সমর্থনের অভাব দেখা গেছে।

হিসাব-নিকাশ

নিছক আকার ও সংখ্যার কারণে উত্তর প্রদেশ ভারতের একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনী যুদ্ধক্ষেত্র। আর মাঠে থাকা দলগুলোর জন্য এই নির্বাচনকে একটি ‘জীবন-মরণের’ লড়াই হিসেবে দেখা হচ্ছে।

১৯৮৯ সাল থেকে রাজ্যে কোনো দলই পরপর দুই মেয়াদে জয়লাভ করেনি। তাই বিজেপি ও আদিত্যনাথ এই ধারা ভাঙতে সচেষ্ট। তা এই নির্বাচনের ফলাফলকে আদিত্যনাথের হিন্দু জাতীয়তাবাদের রাজনীতির ‘গণভোট’ হিসেবেও দেখা হবে।

প্রধানমন্ত্রী মোদির জন্যও এই নির্বাচন তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, ২০২৪ সালের সাধারণ নির্বাচনের আগে উত্তর প্রদেশ বিধানসভা নির্বাচনকে একটি পরীক্ষামূলক প্রতিযোগিতা হিসেবে দেখা হচ্ছে।

বিজেপি যদি উত্তর প্রদেশে হেরে যায়, তবে তাঁকে কেন্দ্রের ক্ষমতায় থাকা দল ও প্রধানমন্ত্রী মোদির জনপ্রিয়তা হ্রাসের একটি চিহ্ন হিসেবে দেখা হবে।

প্রিয়াঙ্কা গান্ধী
ছবি: রয়টার্স

নির্বাচনে অখিলেশের জন্য জয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, ক্ষমতার বাইরে আরেক মেয়াদ থাকলে নেতা হিসেবে দলে তাঁর অবস্থান দুর্বল হয়ে যেতে পারে। নির্বাচনে হারলে সম্ভবত ছোট আঞ্চলিক গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে তিনি যে জোট তৈরি করেছেন, তারও অবসান ঘটবে।

মায়াবতীর জন্যও একটি জয় অপরিহার্য। তিনি গত ১০ বছর রাজনীতির ঊষর প্রান্তরে কাটিয়েছেন। বিশ্লেষকেরা বলছেন, যদি তিনি এবারও হেরে যান, তাহলে হয়তো কখনোই আর ফিরে আসতে পারবেন না।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, কংগ্রেস এবার আসলে জয়ের জন্য লড়ছে না। কংগ্রেস আশা করছে, প্রিয়াঙ্কার কঠোর পরিশ্রম দলকে পুনরুজ্জীবিত করতে সাহায্য করবে। ভবিষ্যতে দলকে একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখার মতো করে গড়ে তুলবে।

ভোট ও ভোটার

রাজ্য বিধানসভার ৪০৩টি আসন দখলের জন্য হাজারো প্রতিযোগী নির্বাচনী মাঠে রয়েছেন। সাত ধাপে এক মাসের বেশি সময় ধরে ভোট হবে।

নির্বাচনে ১৫০ মিলিয়নের বেশি ভোটার ১ লাখ ৭৪ হাজার ৩৫১টি কেন্দ্রে ভোট দেবেন। নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করতে পুলিশ ও আধাসামরিক বাহিনীর হাজারো সদস্য মোতায়েন করা হচ্ছে।

ভারতে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক দরিদ্র মানুষের বাস উত্তর প্রদেশে
ছবি: রয়টার্স

বাড়িতে টয়লেট নেই

রাজনৈতিক তাৎপর্য থাকা সত্ত্বেও উত্তর প্রদেশ ভারতের স্বল্পোন্নত রাজ্যগুলোর মধ্যে একটি হিসেবেই রয়ে গেছে। দেশটির সবচেয়ে বেশিসংখ্যক দরিদ্র মানুষের বাস এই রাজ্যে।

সম্প্রতি প্রকাশিত এক সূচক অনুসারে, রাজ্যের জনসংখ্যার ৩৭ দশমিক ৭৯ শতাংশ দরিদ্র্য। ৪৪ শতাংশের বেশি মানুষ পুষ্টি থেকে বঞ্চিত। রাজ্যের লাখো মানুষের বাড়িতে টয়লেট নেই।

সরকার নির্বাচনে নিজেদের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটানোর একমাত্র উপায় হলো ভোট। নির্বাচনের সময় ভোটাররা ব্যাপকভাবে তাঁদের এই অধিকার প্রয়োগ করেন। কিন্তু প্রায়ই দেখা যায়, ক্ষমতায় যারা থাকে, জনরায় তাদের বিরুদ্ধে যায়।

ভোটের তারিখ

১০ ফেব্রুয়ারি: ৫৮টি আসনে নির্বাচন

১৪ ফেব্রুয়ারি: ৫৫টি আসনে নির্বাচন

২০ ফেব্রুয়ারি: ৫৯টি আসনে নির্বাচন

২৩ ফেব্রুয়ারি: ৫৯টি আসনে নির্বাচন

২৭ ফেব্রুয়ারি: ৬১টি আসনে নির্বাচন

৩ মার্চ: ৫৭টি আসনে নির্বাচন

৭ মার্চ: ৫৪টি আসনে নির্বাচন

উত্তর প্রদেশ রাজ্যে ভোট গণনা করা হবে আগামী ১০ মার্চ।