এলাহাবাদের নাম পাল্টে প্রয়াগরাজ করছে যোগীর সরকার

ভারতের উত্তর প্রদেশের বিজেপি সরকারের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ ওই রাজ্যের ঐতিহ্যবাহী শহর এলাহাবাদের নাম বদলের উদ্যোগ নিয়েছেন। শহরের নাম পাল্টে ‘প্রয়াগরাজ’ করার জন্য রাজ্যের প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের সরকারি নির্দেশিকা জারি করেছেন তিনি।

উত্তর প্রদেশ সরকারের এই নাম পরিবর্তনের সিদ্ধান্তের পর কংগ্রেস নেতা প্রমোদ তেওয়ারি বলেছেন, লোকসভা ভোটের কথা মাথায় রেখে হিন্দুত্বের তাস খেলতে চাইছে যোগী আদিত্যনাথ সরকার। কারণ, সরকার বুঝতে পারছে কাজের নিরিখে আর জিততে পারবে না বিজেপি। তাই এখন হিন্দুত্বকে ভরসা করে এগোতে চাইছে বিজেপি।

নামবদলের এ কথা গতকাল শনিবার সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন এলাহাবাদের জেলা প্রশাসক সুহাস এলওয়াই। তিনি বলেছেন, রাজ্যের সব সরকারি দপ্তরে নামবদলের নির্দেশিকা পাঠিয়ে বলা হয়েছে, এখন থেকে এলাহাবাদ পরিচিত হবে ‘প্রয়াগরাজ’ হিসেবে। এর আগে শুক্রবার এই নামবদলের প্রস্তাবে অনুমোদন দেয় রাজ্যের রাজ্যপাল রাম নায়েক। রাজ্যপালের অনুমোদনের পর শুরু হয়ে যায় প্রশাসনিক পর্যায়ে নামবদলের প্রক্রিয়া। গত মঙ্গলবার এই নামবদলের প্রস্তাবের অনুমোদন দিয়েছে উত্তর প্রদেশ সরকারের রাজ্য মন্ত্রিসভা।
নামবদলের প্রস্তাব মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের পর মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ বলেছেন, সাধারণ মানুষের ইচ্ছাকে সন্মান জানাতে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে উত্তর প্রদেশ সরকার। আর বিজেপির এক মুখ্যপাত্র নামবদলের প্রস্তাবকে সমর্থন করে বলেছেন, সম্রাট আকবরের ভুল শোধরাল বিজেপি সরকার।
আগেই যোগী আদিত্যনাথ সরকার ঘোষণা দিয়েছিল, আগামী জানুয়ারি মাসে এলাহাবাদে অর্ধকুম্ভের আগেই এই নাম বদলে প্রয়াগরাজ করা হবে। সেই সিদ্ধান্তই এখন বাস্তবায়িত হতে চলেছে। তবে উত্তর প্রদেশের সমাজবাদী পার্টি এবং জাতীয় কংগ্রেস এই নামবদলের সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছে। কংগ্রেস মুখপাত্র ওঙ্কার সিং বলেছেন, কুম্ভ প্রয়াগরাজ হিসেবেই পরিচিত। সরকার চাইলে আরেকটি নতুন শহর বানিয়ে নামকরণ করতে পারত। আর এসব সমালোচনার পর যোগী আদিত্যনাথ বলেছেন, যাঁরা সমালোচনা করছেন, তাঁরা এলাহাবাদের ইতিহাস জানেন না।
এই ঘটনার জেরে এবার নামবদলের আরও দাবি উঠে এসেছে। যদিও এর আগে সম্প্রতি গুরুগাঁয়ের নাম বদলে নতুন নাম হয়েছে গুরুগ্রাম। ১৯৯৬ সালে মুম্বাদেবীর নামে বোম্বাইর নাম বদলে হয়েছে মুম্বাই। ২০১৪ সালে কর্ণাটকের রাজধানী ব্যাঙ্গালোরের নাম বদলে হয়েছে বেঙ্গালুরু। ম্যাঙ্গালোর হয়েছে মেঙ্গালুরু। ২০১১ সালে উড়িষ্যা হয়েছে ওডিশা। একই বছর পন্ডিচেরির নাম বদলে হয়েছে পুদুচেরি। আর ইংরেজিতে ক্যালকাটা হয়েছে কলকাতা।
এবার নতুন করে দাবি উঠেছে আহমেদাবাদের নাম কর্ণাবতী, হিন্দু রাজা করণ দেবের নামে নামকরণ করার। মহারাষ্ট্রের ঔরঙ্গাবাদের নাম শম্ভাজি নগর, হায়দরাবাদের নাম ভাগ্যনগর, মধ্যপ্রদেশের রাজধানী ভোপালের নাম ভোজপাল করার দাবি উঠেছে।

ভারতের উত্তর প্রদেশের এক ঐতিহাসিক শহর এলাহাবাদ। গত মঙ্গলবার উত্তর প্রদেশ সরকার রাজ্য মন্ত্রিসভার বৈঠকে এলাহাবাদ বা ইলাহাবাদের নাম পরিবর্তন করে প্রয়াগরাজ করার সিদ্ধান্ত নেয়। এর ফলে বদলে যাচ্ছে এলাহাবাদ রেলস্টেশনেরও নাম। হবে প্রয়াগরাজ রেলস্টেশন।
বিজেপি শাসিত উত্তর প্রদেশ সরকার এর আগে গত ৫ জুন উত্তর প্রদেশের ঐতিহাসিক রেলস্টেশন মোগলসরাইর নাম বদলে রেখেছে পণ্ডিত দীনদয়াল উপাধ্যায় নগর জংশন। উত্তর প্রদেশে অবস্থান এই ঐতিহাসিক মোগলসরাই ও এলাহাবাদ রেলস্টেশনের। মোগলসরাই হলো ভারতের চতুর্থ ব্যস্ততম রেলস্টেশন। আর এই স্টেশনেরই রয়েছে এশিয়ার সর্ববৃহৎ রেল ইয়ার্ড। এই ইয়ার্ডের দৈর্ঘ্য সাড়ে ১২ কিলোমিটার। এখানে ৫ হাজার ওয়াগন রাখার ব্যবস্থা রয়েছে। মোগলসরাই রেলস্টেশনের প্রতিষ্ঠা ১৮৬২ সালে। আর ইলাহাবাদ রেলস্টেশনের প্রতিষ্ঠা ১৮৫৯ সালে। এটি গড়েছিল ইস্ট ইন্ডিয়ান রেলওয়ে কোম্পানি। হাওড়া-দিল্লি রেললাইন তৈরির সময় তৈরি হয় এলাহাবাদ ও মোগলসরাই রেলস্টেশন।
পণ্ডিত দীনদয়াল উপাধ্যায় ছিলেন ভারতের কট্টর হিন্দুত্ববাদী সংগঠন ভারতীয় জনসংঘের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। ছিলেন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) ঘরানার নেতা। এই দীনদয়াল উপাধ্যায় ১৯৬৮ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি এই মোগলসরাই স্টেশনের কাছে রহস্যজনকভাবে মৃত্যু বরণ করেন। তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে বিজেপি এবং উত্তর প্রদেশের যোগী আদিত্যনাথ সরকার মোগলসরাই স্টেশনের নাম পরিবর্তন করার উদ্যোগ নেয়। যদিও এর পরেই দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে এই নামের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ওঠে। আপত্তি ওঠে ভারতের সংসদেও। দাবি ওঠে রেলস্টেশনের নাম যদি পরিবর্তন করতে হয়, তবে নামকরণ করা হোক ভারতের দ্বিতীয় প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রীর নামে। কারণ, শাস্ত্রী জন্মেছিলেন এই মোগলসরাইতে।
রাজ্য মন্ত্রিসভায় এলাহাবাদের নাম পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত পাস হওয়ার পর বিরোধীরা বলেছে, আগামী বছরে অনুষ্ঠেয় লোকসভা নির্বাচনের আগে হিন্দু আবেগ উসকে দেওয়ার জন্য যোগী আদিত্যনাথ সরকার এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথও জানান, এ বছর অনুষ্ঠেয় অর্ধকুম্ভের দিনক্ষণের ঘোষণার আগে অখিল ভারতীয় আখাড়া পরিষদ এই নাম পরিবর্তনের দাবি জানায়। তাঁরই পরিপ্রেক্ষিতে রাজ্য মন্ত্রিসভা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
একসময় এই এলাহাবাদের নাম ছিল প্রয়াগ। ষোড়শ শতকে মোগল সম্রাট আকবর সেদিনকার প্রয়াগের গঙ্গা, যমুনা ও সরস্বতী নদীর সঙ্গমস্থলের কাছে গড়ে ছিলেন একটি দুর্গ। এরপর ওই দুর্গ ও সন্নিহিত এলাকার নাম দেওয়া হয় ইলাহাবাদ। পরে আকবরের দৌহিত্র সম্রাট শাহজাহান গোটা শহরের নাম রাখেন ইলাহাবাদ বা এলাহাবাদ। যদিও এই দুর্গের কাছেই বহমান গঙ্গা, যমুনা ও সরস্বতী নদীর মিলনস্থল এবং এর আশপাশের এলাকা প্রয়াগ নামে পরিচিত ছিল।