কলকাতার ঐতিহ্য হাতেটানা রিকশা কি হারিয়ে যাবে
কলকাতার নিজস্ব দুই ঐতিহ্যের নাম—হাতেটানা রিকশা আর ট্রাম। এ দুই ঐতিহ্যের ইতিহাস শত বছর পেরিয়ে গেছে। তবু শহরটির রাস্তায় এখনো টিকে আছে এই দুটি যান, যা নেই ভারতের অন্য কোনো রাজ্যে। তবে দিনে দিনে কমে আসছে হাতেটানা রিকশার সংখ্যা। রাজ্য সরকারও চাইছে মানুষের হাতে টানা এবং ধীরগতির রিকশাকে তুলে সেখানে যান্ত্রিক যান চালু করতে। কিন্তু তাতে সায় দিচ্ছেন না রিকশাচালকেরা।
কলকাতায় হাতেটানা রিকশার প্রচলন হয় ১৩২ বছর আগে। ১৮৯০ সাল থেকে। ভারতে অবশ্য এই হাতেটানা রিকশা প্রথম এসেছিল ১৮৮০ সালে। তা কলকাতায় নয়। হিমাচল প্রদেশের রাজধানী সিমলায়। সিমলা তখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির গ্রীষ্মকালীন রাজধানী ছিল। তখন লোহা দিয়ে তৈরি এই রিকশা চালাতে ৪ জন মানুষের প্রয়োজন হতো। এরপর ১৮৯০ সালে জাপান থেকে কলকাতায় প্রথম আসে কাঠের তৈরি হাতেটানা রিকশা। সেই থেকে কলকাতায় আজও চলছে সে রিকশা, যা ভারতের অন্য কোনো রাজ্যে আর নেই।
কলকাতার ঐতিহ্য ট্রাম আর হাতেটানা রিকশার প্রতি প্রচণ্ড আকর্ষণ রয়েছে বিদেশি পর্যটকদের। মাসুম খান নামে বাংলাদেশের এক পর্যটক বলেন, তিনি এবার তাঁর স্ত্রী এবং সন্তানকে নিয়ে কলকাতায় এসেছেন। কলকাতা ঘুরতে। বলেছেন, কলকাতার হাতেটানা রিকশা, ট্রাম আর পাতালরেলে চড়বেন বলে স্ত্রী ও সন্তানকে কথা দিয়েছেন। তাই তিনি তাঁর পরিবারকে এগুলোতে চড়াবেন।
বেশির ভাগ হাতেটানা রিকশাচালক হলেন অবাঙালি এবং উত্তর প্রদেশ এবং বিহারের মানুষ। সত্তরের দশকে যেমন একসময় কলকাতার ট্যাক্সিচালকদের অধিকাংশ ছিলেন পাঞ্জাবি, ঠিক তেমনি হাতেটানা রিকশাচালকের বেশির ভাগ ছিল বিহারি।
রিকশাচালক যোগেশ রায় কলকাতা শহরে হাতেটানা রিকশা চালাচ্ছেন ৪০ বছর ধরে। বয়স এখন ৬০। এসেছেন বিহার রাজ্যের সীতামারি থেকে। হিন্দিভাষী এই অবাঙালি রিকশাচালক বলেন, ‘আমাদের জীবনজুড়ে আছে এই হাতেটানা রিকশার ঐতিহ্য। এই কলকাতা শহরে এখনো বেশির ভাগ হাতেটানা রিকশা চালান বিহার এবং উত্তর প্রদেশ থেকে কাজের জন্য কলকাতায় আসা মানুষ। কলকাতায় বাঙালি রিকশাচালকের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য।’
যোগেশ রায় আরও বলেন, এখন অবশ্য বহু বিহারি এই পেশা ছেড়ে চলে গেছেন নিজ নিজ রাজ্যের গ্রামে। সেখানে গিয়ে তাঁরা অন্য পেশায় যোগ দিয়েছেন। কেউ কেউ আবার এই শহরে কুলিগিরি করছেন। তবুও এই পেশাকে না ছেড়ে এখনো আঁকড়ে ধরে আছে বিহারের বহু হাতেটানা রিকশাচালক। তাঁরা সরকারের কথায় রাজি না হয়ে বরং এখন জীবনযুদ্ধে হাতেটানা রিকশা চালিয়ে জীবন নির্বাহ করছেন।
একসময় এই কলকাতা শহরে ২৪ হাজার হাতেটানা রিকশা চলত। এখন পৌর করপোরেশনের নিবন্ধিত রিকশার সংখ্যা ১ হাজার ৮০০। এ ছাড়া আরও হাজারখানেক অনিবন্ধিত রিকশার চলাচল আছে। কলকাতা পৌর করপোরেশন শহরের অধিকাংশ রাস্তায় বন্ধ করে দিয়েছে হাতেটানা রিকশার চলাচল। এসব রিকশা এখন চলছে ধর্মতলা, শিয়ালদহ, বড় বাজার, হাজরা, নিউমার্কেট, হাতিবাগান, শ্যামবাজার ও কলেজ স্ট্রিট এলাকায়।
২০০৫ সালে কলকাতার হাতেটানা রিকশাকে অমানবিক উল্লেখ করে তা তুলে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। তিনি চেয়েছিলেন হাতেটানা রিকশা বাদ দিয়ে রিকশাচালকদের পুনর্বাসিত করার জন্য তাঁদের হাতে যন্ত্রচালিত স্কুটার তুলে দেবেন। তবে তাতে সায় দেননি রিকশাচালকেরা। তাঁরা নেমেছিলেন আন্দোলনে।
কলকাতা করপোরেশনও চাইছে হাতেটানা রিকশা তুলে দিয়ে সেখানে ব্যাটারি বা যন্ত্রচালিত স্কুটার চালু করতে। এর জন্য হাতেটানা রিকশাচালকদের যন্ত্রচালিত স্কুটার কেনার জন্য ঋণ দিতে চাইলেও তাতে রাজি নন রিকশাচালকেরা। তাঁরা অনেকেই চাইছেন অতীতের ঐতিহ্য আঁকড়ে ধরে হাতেটানা রিকশা চালাতে। কলকাতা পৌরসভাও মনে করছে হাতেটানা রিকশা একটি অমানবিক পেশা। বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থাও দাবি তুলেছে এই অমানবিক পেশা থেকে মুক্তি দেওয়া হোক হাতেটানা রিকশাচালকদের। কিন্তু তাতে সম্মত হচ্ছেন না হাতেটানা রিকশাচালকেরা।
কলকাতার সাবেক মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়ের আমলে কলকাতা করপোরেশন হাতেটানা ৫ হাজার ৬৯৭ জন রিকশাচালকদের তালিকা তৈরি করে তাঁদের যান্ত্রিক যান প্রদানের মাধ্যমে পুনর্বাসনের উদ্যোগ নিলেও তাতে সায় দেয়নি হাতেটানা রিকশাচালকেরা।
কলকাতার অনেক মানুষই এখন শহর থেকে হাতেটানা রিকশা একেবারে তুলে দেওয়ার পক্ষপাতী নন। তাঁরা চাইছেন ইতিহাসের সাক্ষ্য হয়ে থাকুক হাতেটানা রিকশা। যদি সরকারের উন্নয়নের খাতিরে এবং আধুনিক প্রযুক্তির আবির্ভাবে তুলে দিতেই হয়, তবে অন্তত দু–একটি রাস্তায় স্মারক হিসেবে রাখা হোক কলকাতার শতবর্ষের এ ঐতিহ্যকে।