কাশ্মীরে বেছে বেছে হত্যা ছড়াচ্ছে জঙ্গিবাদের শঙ্কা

কাশ্মীরে জঙ্গিদের গুলিতে নিহত শিক্ষক সুপিন্দর কাউরের মৃতদেহ নিয়ে বিক্ষোভ করছে জনতা।
ছবি : রয়টার্স

কাশ্মীরের প্রধান শহর শ্রীনগরের একটি রেস্তোরাঁয় যাচ্ছিলেন ৪০ বছর বয়সী সিদ্ধার্থ বিন্দ্রু। হঠাৎ বেজে উঠল মুঠোফোন। অপর প্রান্ত থেকে শুনলেন দুঃসংবাদটি।

জানলেন, ‘বাবা আর নেই’। ওই অঞ্চলের বিখ্যাত এন্ডোক্রাইনোলজিস্ট হিসেবে পরিচিত সিদ্ধার্থ বিন্দ্রু খবরটি শুনে বড় ধাক্কা খেলেন। জানতে পারলেন, কিছু লোক তাঁদের পারিবারিক ওষুধের দোকানে ঢুকে তাঁর বাবা মাখন লাল বিন্দ্রুকে লক্ষ্য করে গুলি চালিয়েছে। তাঁকে মোট তিনটি গুলি করা হয়েছে। ঘটনাটি ঘটেছে ৫ অক্টোবর।

মাখন লাল বিন্দ্রু (৬৮) কাশ্মীরের বিখ্যাত চিকিৎসক রাখেশ্বর নাথ বিন্দ্রুর ছেলে। পরিবারটি বিখ্যাত ফার্মেসি চেইন শপ পরিচালনা করে থাকে। কাশ্মীর অঞ্চলে বিভিন্ন জীবন রক্ষাকারী ওষুধ বিক্রির জন্য পরিচিত এটি।

শিক্ষক সুপিন্দার কাউরের হত্যার বিচার দাবিতে বিক্ষোভে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটে।
ছবি : রয়টার্স

কাশ্মীরে স্থানীয়ভাবে ‘পণ্ডিত’ হিসেবে পরিচিত কাশ্মীরি ভাষাভাষী যে ৮০০ হিন্দু পরিবার আছে, বিন্দ্রুরা তাদের মধ্যে অন্যতম। নব্বইয়ের দশকে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এ অঞ্চলে যখন সশস্ত্র জঙ্গিবাদ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে, তখন হাজারো হিন্দু ওই এলাকা ছেড়ে ভারতের অন্য শহরগুলোতে চলে যান। তবে বিন্দ্রুরা সেখানে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। এই সশস্ত্র বিদ্রোহীরা মূলত ভারতের কাছ থেকে স্বাধীনতা চায়।

তাদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হন এখানকার সংখ্যালঘু হিন্দুরা। তাঁদের বিরুদ্ধে ভারতের নিরাপত্তা বাহিনীকে সহযোগিতার অভিযোগ তোলে সশস্ত্র বিদ্রোহীরা।

মঙ্গলবার বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারত-নিয়ন্ত্রিত এই কাশ্মীরে সাম্প্রতিক সময়ে বেসামরিক মানুষকে হত্যার কারণে আবারও ব্যাপক অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে এই অঞ্চলের সংখ্যালঘু লোকজনের মধ্যে আতঙ্ক বেড়ে গেছে।

যেদিন মাখন লাল বিন্দ্রু খুন হন, ওই দিনই আরও দুজন বেসামরিক ব্যক্তি হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। এর মধ্যে একজন ভারতের বিহার থেকে আসা হিন্দু ফেরিওয়ালা ও একজন মুসলিম ক্যাবচালক। তাঁদের দুজনকেই অজ্ঞাত বন্দুকধারীরা গুলি করে হত্যা করে। এর আগে ২ অক্টোবর একই কায়দায় দুজন কাশ্মীরি মুসলিম নাগরিককে হত্যা করা হয়।

জঙ্গিদের গুলিতে নিহত শিক্ষকের মৃতদেহ বহন করছেন বিক্ষোভকারীরা।
ছবি : রয়টার্স

এর দুই দিন বাদেই আবার বন্দুকধারীরা শ্রীনগরের বিচ্ছিন্ন সংগম এলাকার একটি সরকারি স্কুলে হামলা চালিয়ে সেখানকার শিখ প্রধান শিক্ষক ও হিন্দু একজন শিক্ষককে হত্যা করে। কাশ্মীরের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে বেছে বেছে লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে এভাবে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ব্যাপক আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। এর কারণে অনেক হিন্দু পরিবার এখন উত্তেজনাপূর্ণ এ অঞ্চল ছেড়ে চলে যাচ্ছে। এ পরিস্থিতিকে নব্বইয়ের দশকের সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে।

ভারত ও পাকিস্তান উভয় দেশই কাশ্মীরকে নিজেদের বলে দাবি করে। কিন্তু পারমাণবিক শক্তিধর প্রতিবেশী এই দুই দেশের কাছে কাশ্মীরের অংশবিশেষ রয়েছে। দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক সব সময় উত্তেজনাপূর্ণ। কিন্তু ২০১৯ সালে কাশ্মীরের বিশেষ রাজ্যের মর্যাদা দিল্লি তুলে নিলে সম্পর্ক আরও খারাপ হয়।

এ পদক্ষেপের পরে কয়েক মাস ধরে কাশ্মীরে সড়ক অবরোধ ও প্রশাসনিক পরিবর্তন ঘটতে থাকে। স্থানীয় লোকজনের ভাষায়, ভারতের একমাত্র মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলে জনসংখ্যাতাত্ত্বিক পরিবর্তন আনার লক্ষ্যে দিল্লি এই পরিবর্তন এনেছিল।

গত সপ্তাহে নিহত স্কুলের প্রধান শিক্ষক সুপিন্দার কাউরের স্বামী রামেশপাল সিং বলেন, স্ত্রীর মৃত্যুর পর দুই দিন পর্যন্ত তিনি কোনো কথা বলতে পারেননি। তিনি আরও বলেন, ‘স্ত্রীকে মৃত দেখেছি। আমার কাছে আর সবকিছুর কোনো অর্থ নেই।’

পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বন্দুকধারী হামলাকারী স্কুলে ঢুকে সবাইকে একসঙ্গে জড়ো করে পরিচয় জানতে চায়। পরে প্রধান শিক্ষক ও আরেক শিক্ষককে আলাদা করে গুলি করা হয়।

সুপিন্দারের প্রতিবেশী মাজিদ বলেন, ‘তিনি ছিলেন বোনের মতো। তিনি এতটাই উদার ছিলেন যে এক মুসলিম এতিম মেয়েকে দত্তক নিয়েছিলেন। তাঁর বেতনের কিছু অংশ মেয়েটির ভরণপোষণের জন্য ব্যয় করতেন।’

গত দুই দশকে লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে কাশ্মীরি পণ্ডিতদের হত্যাকাণ্ডের তালিকায় মাখন লাল ও সুপিন্দারের নামও নতুন করে যুক্ত হলো। এর আগে গত বছরের মার্চ মাসে অজ্ঞাত বন্দুকধারীরা অনন্তনাগ জেলায় ৩৫ জনকে গুলি করে হত্যা করে। তাঁরা সবাই ছিলেন শিখ। ২০০৩ সালে পুলওয়ামা জেলার নন্দীমার্গে ২০ জনের বেশি কাশ্মীরি পণ্ডিত হত্যাকাণ্ডের শিকার হন।

সম্প্রতি এক সপ্তাহের মধ্যে সেখানে সাতজনের বেশি হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। এই হত্যাকাণ্ড এমন এক সময়ে ঘটেছে, যখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দল ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) নেতৃত্বাধীন সরকারের ৭০ জনের বেশি মন্ত্রী কাশ্মীর সফর করছেন। এসব মন্ত্রীকে ভারতীয় সংবিধান থেকে ‘৩৭০ অনুচ্ছেদ’ বাতিল করার সুবিধা তুলে ধরতে পাঠানো হয়েছিল।

৩৭০ অনুচ্ছেদ অনুসারে, কাশ্মীরের নিজস্ব সংবিধান থাকবে। এ ছাড়া সামরিক, যোগাযোগ ও পররাষ্ট্রনীতি ছাড়া অন্য কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হলে রাজ্য সরকারের অনুমোদন লাগবে। এর অর্থ হলো আলাদা আইনকানুন দিয়ে জম্মু-কাশ্মীরের জনগণের নাগরিকত্ব, সম্পদের মালিকানা, মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ করা হচ্ছিল এত দিন। এ কারণেই অন্য রাজ্যের অধিবাসীরা সেখানে জমি কিংবা সম্পদ কিনতে পারতেন না। এ ছাড়া ভারতের সংবিধানের যে ভাগে ৩৭০ অনুচ্ছেদ যুক্ত, সেই ভাগে ‘অস্থায়ী, অন্তর্বর্তী ও বিশেষ বিধানের’ বিষয়গুলো উল্লেখ করা হয়েছে। এই বিশেষ বিধানের জন্যই বিশেষ মর্যাদা পেয়েছিল জম্মু-কাশ্মীর।

স্থানীয় রাজনীতিবিদেরা বলছেন, পরিস্থিতি স্বাভাবিক থেকে অনেক দূরে। কেউ কেউ একে নব্বইয়ের দশকের পরিস্থিতির সঙ্গে তুলনা করছেন। সাবেক মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতি এ হত্যাকাণ্ডগুলোকে শান্তি ও স্বাভাবিক পরিস্থিতির মিথ্যা দাবির বিরুদ্ধে ‘জোর আওয়াজ’ বলে মন্তব্য করেছেন।

কাশ্মীরের পুলিশপ্রধান বিজয় কুমার বলেছেন, এ বছর কাশ্মীরে সন্দেহভাজন জঙ্গিদের হাতে অন্তত ২৮ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে পাঁচজন স্থানীয় হিন্দু ও শিখ সম্প্রদায়ের এবং দুজন পৃথক রাজ্য থেকে আসা শ্রমিক।


নিহত ব্যক্তিদের অধিকাংশই মুসলিম সম্প্রদায়ের হলেও চলতি সপ্তাহে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকজনকে হত্যায় ধর্মীয় উত্তেজনার আশঙ্কা ছড়িয়েছে।

জম্মু ও কাশ্মীর পুলিশের মহাপরিচালক দিলবাগ সিং বলেছেন, এই হত্যাকাণ্ড সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করার একটা চেষ্টা।

পুলিশ বলছে, আক্রমণকারীদের ধরতে অনুসন্ধান চালানো হচ্ছে। সূত্র বলছে, জামিনে বাইরে থাকা শত শত সাবেক সশস্ত্র বিদ্রোহী ও বিক্ষোভকারীকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডাকা হয়েছে। তবে কাশ্মীরি পণ্ডিতেরা বলছেন, তাঁরা ভয় পাচ্ছেন। অনেকেই এলাকা ছাড়ার চিন্তাভাবনা করছেন।

কাশ্মীরি পণ্ডিতদের একটি সংগঠনের প্রধান সঞ্জয় টিকো (৫৩) বলেন, ‘বেশ কিছু পরিবার সম্প্রতি কাশ্মীর ছেড়েছে যাওয়ার পরিকল্পনা করছে। আমি আতঙ্কে থাকা পণ্ডিত পরিবার থেকে ফোনকল পাচ্ছি। কর্তৃপক্ষ আমাকে শ্রীনগরের বাড়ি থেকে সরিয়ে হোটেলে রেখেছে। এ ধরনের ভয়ার্ত পরিবেশে আমরা কীভাবে বাস করব?’

শ্রীনগরে বিন্দ্রুদের বাড়িগুলোয় এখন ব্যাপক নিরাপত্তা দেওয়া হচ্ছে। নাম প্রকাশ না করে এ ধরনের একটি বাড়ির এক বাসিন্দা বলেন, ‘অনেক পরিবার চলে গেছে। আমরা অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছি। কোনো ঘটনা ঘটলে সরকারি কর্মকর্তারা এখানে এসে আমাদের সমর্থন দেওয়ার বিষয়ে আশ্বস্ত করেন। কিন্তু তাঁরা কীভাবে সব স্কুল ও অফিসে নিরাপত্তা দেবেন?’

ভয় আর আতঙ্ক শুধু কাশ্মীরি এ পণ্ডিতদেরই গ্রাস করেনি, বরং তা পুরো উপত্যকায় ছড়িয়ে পড়েছে।

১৯৯১ সালে ‘ক্রসফায়ারে’ স্বজন হারানো মিস্ত্রি মুহাম্মদ আসলাম বলেন, ‘নব্বইয়ে দশকে পণ্ডিতদের হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ছিল হৃদয়বিদারক। আবার সে রকম ঘটনা দেখা যাচ্ছে। নিরাপত্তাব্যবস্থা পুরো ভেঙে পড়েছিল। আমি সেই দিনগুলো স্মরণ করতে ভয় পাই। এমনটা যেন আর না হয়।’

কিন্তু সব কাশ্মীরি পণ্ডিত এলাকা ছাড়তে চান না। বিন্দ্রুরা বলছেন, তাঁরা ফিরে যাবেন। মাখন লাল বিন্দ্রুর মেয়ে শ্রদ্ধা বিন্দ্রু বলেন, ‘আমরা কাশ্মীরের বাসিন্দা, আমরা কাশ্মীরি, মাখন লালের রক্ত আমাদের শরীরে।’

শ্রদ্ধা বলেন, তাঁর বাবার মৃত্যুর পর যেসব মানুষ তাঁদের বাড়িতে গেছেন, এর ৯০ শতাংশের বেশি মুসলমান। তাঁর ভাষ্য, ‘আমার মনে হয় না এ জায়গা ছাড়ার কোনো কারণ আমাদের আছে। লোকজন আমাদের চারপাশে আছেন।’