চলে গেলেন মহাশ্বেতা দেবী

মহাশ্বেতা দেবী
মহাশ্বেতা দেবী

চলে গেলেন উপমহাদেশের প্রখ্যাত সাহিত্যিক মহাশ্বেতা দেবী। গতকাল বৃহস্পতিবার বেলা ৩টা ১৬ মিনিটে দক্ষিণ কলকাতার বেসরকারি হাসপাতাল বেলভিউতে তিনি শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৯১ বছর। বুধবার গভীর রাতে তাঁর হার্ট অ্যাটাক হয়।
গত ২২ মে ফুসফুসে সংক্রমণ নিয়ে মহাশ্বেতা দেবী ভর্তি হন বেলভিউ হাসপাতালে। এখানেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন। দীর্ঘদিনের অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসের জন্য তাঁর দুটি কিডনিই বিকল হয়ে যায়। কাজ বন্ধ হয় ফুসফুসের। শেষ মুহূর্তে তাঁকে ডায়ালাইসিস করা যায়নি।
মহাশ্বেতা দেবীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও মেডিকেল বোর্ডের সদস্য সমরজিৎ নস্কর বলেছেন, ‘আমরা এই মহান সাহিত্যিককে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছি।’
মহাশ্বেতা দেবীর জন্ম বাংলাদেশের ঢাকায়। ১৯২৬ সালের ১৪ জানুয়ারি। শৈশব ও কৈশোরে স্কুলের পড়াশোনাও ঢাকায়। দেশভাগের পর তাঁরা চলে আসেন কলকাতায়। এরপর শা‌ন্তিনিকেতনের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে অনার্স এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেন। মহাশ্বেতা দেবীর বাবা মণীশ ঘটক ছিলেন প্রখ্যাত কবি ও কথাসাহিত্যিক। ঢাকার কথ্যভাষায় কবিতা ও উপন্যাস লিখে তিনি খ্যাতি অর্জন করেন। মা ধরিত্রী দেবীও ছিলেন সাহিত্যিক ও সমাজসেবী। তাঁর ছোট কাকা ঋত্বিক ঘটক ছিলেন প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা। বিখ্যাত নাট্যকার বিজন ভট্টাচার্যের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন মহাশ্বেতা দেবী। বিজন ভট্টাচার্য ছিলেন আইপিটিএ ও গণনাট্য সংঘের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। তাঁদের একমাত্র পুত্র নবারুণ ভট্টাচার্য কয়েক বছর আগে মারা যান। স্মরণীয় কবিতার পঙ্‌ক্তি ‘এ মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ নয়’ এবং হারবার্ট উপন্যাস লিখে নবারুণ বাংলা সাহিত্যে স্থায়ী স্বাক্ষর রেখে গেছেন। এখন রয়েছেন পুত্রবধূ ও এক নাতনি।

মহাশ্বেতা দেবীর কর্মজীবন শুরু হয় ১৯৬৪ সালে কলকাতার বিজয়গড় কলেজে অধ্যাপনার মধ্য দিয়ে। তিনি সাংবাদিকতাও করেছেন। একজন সমাজসেবী হিসেবে তিনি ঘুরে বেড়িয়েছেন বিহার, পশ্চিমবঙ্গ, ছত্তিশগড় ও মধ্যপ্রদেশের উপজাতি এবং দলিত লোধা ও শবর সম্প্রদায়ের মাঝে। এদের জীবন-জীবিকা এবং সুখ-দুঃখ নিয়ে লিখেছেন গল্প-উপন্যাস। তিনি উপজাতি ও আদিবাসীদের সংগ্রামে শামিল হয়েছেন। শামিল হয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে। সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রাম আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ছিলেন তিনি।

মহাশ্বেতা দেবী লিখেছেন প্রচুর গল্প ও উপন্যাস। তাঁর লেখা সংঘর্ষ, রুদ্রালি, গাঙ্গরসহ বেশ কয়েকটি উপন্যাসের চলচ্চিত্রায়ণ হয়েছে। বহির্বিশ্বে সর্বাধিক অনূদিত ভারতীয় লেখকদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। পেয়েছেন সাহিত্য আকাদেমি (১৯৭৯) ও জ্ঞানপীঠ (১৯৯৬) পুরস্কার। পেয়েছেন র‌্যামন মেগসাইসাই পুরস্কারসহ রাষ্ট্রীয় সম্মান পদ্মশ্রী, পদ্মবিভূষণ, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বাংলাবিভূষণ পুরস্কারসহ অন্যান্য পুরস্কার। মহাশ্বেতা দেবীর উল্লেখযোগ্য বইয়ের মধ্যে রয়েছে হাজার চুরাশির মা, অরণ্যের অধিকার, দৌলতী, বেদানাবালা, অর্জুন, অগ্নিগর্ভ, তিতুমীর, দ্রৌপদী, ওল্ড ওম্যান, ডাকাতি কাহিনী, কৈবর্ত খণ্ডা, খণ্ডিত দর্পণে সমাজ, নীল চাবি, রং নাম্বার ইত্যাদি।

মহাশ্বেতা দেবীর মৃত্যুতে গভীর শোক নেমে এসেছে পশ্চিমবঙ্গসহ গোটা ভারতের সাহিত্যজগতে। তাঁর মৃত্যুর সংবাদ শুনে দিল্লি সফর সংক্ষিপ্ত করে কলকাতায় ফিরছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বলেছেন, ‘আমরা এক মহান সাহিত্যিককে হারালাম। আমি আমার অভিভাবককে হারালাম।’ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি টুইট বার্তায় বলেছেন, ‘তিনি ন্যায় ও সাম্যের প্রতীক ছিলেন। কলমের শক্তিকে তুলে ধরেছেন আমাদের সামনে। তাঁর চলে যাওয়ায় আমরা গভীরভাবে শোকাহত।’ শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, বঞ্চিত মানুষের প্রতিনিধি ছিলেন তিনি। চিত্রপরিচালক গৌতম ঘোষ বলেছেন, সাংস্কৃতিক জগতের বড়ই ক্ষতি হয়ে গেল। অপর্ণা সেন বলেছেন, বিশ্বাস ও কাজে মহাশ্বেতা দেবীর তফাত ছিল না। সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় বলেছেন, তাঁর চলে যাওয়ায় সাহিত্যজগতের অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল। সাহিত্যিক নবনীতা দেবসেন বলেছেন, তাঁর চলে যাওয়ায় একটি যুগের অবসান হলো। নাট্যব্যক্তিত্ব রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত বলেছেন, ‘তিনি আজ আমাদের মধ্যে বেঁচে না থাকলেও তিনি আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবেন কাজের মাধ্যমে।’ এ ছাড়া মহাশ্বেতা দেবীর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন কংগ্রেস নেত্রী সোনিয়া গান্ধী, পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল কেশরী নাথ ত্রিপাঠী এবং পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা।

মহাশ্বেতা দেবীর মরদেহ গতকাল রাতে রাখা হয়েছে পিচ ওয়ার্ল্ডে। আজ সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১২টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত মরদেহ শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য রাখা হবে কলকাতার রবীন্দ্রসদন চত্বরে। বেলা একটায় মরদেহ নিয়ে শোক মিছিল হবে। তারপর রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন হবে কলকাতার কেওড়াতলা মহাশ্মশানে।

প্রথম আলোআগরতলা প্রতিনিধি জানান, মহাশ্বেতা দেবীর মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমে আসে উত্তর-পূর্ব ভারতের ত্রিপুরাতেও। তিনি বহুবার ত্রিপুরায় এসেছেন। এখানকার উপজাতিদের উন্নয়ন নিয়েও নিজের সুস্পষ্ট মতামত ব্যক্ত করেছেন মহাশ্বেতা দেবী। তাঁর মৃত্যুতে গভীর শোক জ্ঞাপন করেছেন রাজ্যপাল তথাগত রায়।

প্রখ্যাত সাহিত্যিক ও অধিকারকর্মী মহাশ্বেতা দেবীর মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করে গতকাল বিবৃতি দিয়েছে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ। সংগঠনটির সভাপতি আয়শা খানম ও সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু স্বাক্ষরিত ওই বিবৃতিতে শোক প্রকাশের পাশাপাশি মহাশ্বেতা দেবীর বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা ও শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করা হয়।