নির্বাচনে যেভাবে জেতান প্রশান্ত কিশোর
ভারতের রাজনীতিতে এ সময়ের আলোচিত নাম প্রশান্ত কিশোর। তিনি কোনো সাধারণ রাজনৈতিক পরামর্শদাতা বা কুশলী নন। এমনকি তাঁর দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডেও সাধারণত্বের ছাপ নেই। তাঁর বক্তব্য অনুসারে, তিনি খুব কমই টেলিভিশনে খবর দেখেন। তিনি পত্রিকা পড়েন না।
এখানেই শেষ নয়; প্রশান্ত কিশোর সাধারণত ই–মেইল করেন না, কোনো ঘটনার নোট নেন না। এক দশক ধরে তিনি ল্যাপটপও ব্যবহার করেন না। তিনি একটিমাত্র গ্যাজেটই ব্যবহার করেন, সেটা হলো মুঠোফোন। গত তিন বছরে তিনি টুইটারে ৮৬টি পোস্ট করেছেন। যদিও টুইটারে তাঁর অনুসারীর সংখ্যা প্রায় ৫ লাখ। বরাবরই কাজ পাগল মানুষ তিনি। তাঁর ভাষ্য, ‘কাজ ও জীবন যাপনের মধ্যে যে ভারসাম্য আনতে হয়, এটাতে আমি বিশ্বাস করি না। সত্যিকার অর্থে কাজের বাইরে কোনো কিছুতে আমার আগ্রহ নেই।’
প্রশান্ত কিশোর যে ভারতের পরিচিত রাজনৈতিক পরামর্শক এবং কুশলী—এই পরিচয় দিতে তিনি পছন্দ করেন না। যদিও তিনি বড় বড় ভারতীয় রাজনীতিকের সঙ্গে কাজ করেছেন। ভারতের ভোটারদের প্রভাবিত করতে এবং এই রাজনীতিকদের জয় ছিনিয়ে আনতে এই কুশলীকে কাজ করতে দেখা গেছে।
রাজনৈতিক পরামর্শদাতা হিসেবে প্রশান্ত কিশোরের যাত্রা শুরু ২০১১ সালে। এরপর থেকে তিনি ও তাঁর প্রতিষ্ঠান আই-প্যাক অধিকাংশ ক্ষেত্রে সফল হয়েছে। নয়টি নির্বাচন নিয়ে কাজ করে আটটিতে সফল হয়েছেন তাঁরা। তিনি যে শুধু একটি রাজনৈতিক দল নিয়ে কাজ করেছেন এমনটা নয়; বিভিন্ন দলের হয়ে কাজ করেছেন তিনি। এসব সাফল্যের কারণে বায়োপিক তৈরির প্রস্তাবও পেয়েছেন প্রশান্ত কিশোর। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠান ডিজনি, নেটফ্লিক্স, এমনকি বলিউড তারকা শাহরুখ খান তাঁর জীবনকাহিনি অবলম্বনে সিনেমা তৈরির প্রস্তাব দিয়েছিল। কিন্তু এসব প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন তিনি।
নির্বাচনী পরামর্শদাতা হিসেবে প্রশান্ত কিশোরের কাজে বেশ বৈচিত্র্যও রয়েছে। ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদি যখন প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন, তখন তাঁদের হয়ে কাজ করেছিলেন প্রশান্ত কিশোর। আবার এই মোদির কট্টর সমালোচক পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হয়েও কাজ করেছেন তিনি। তাঁর হাত ধরেই সর্বশেষ মে মাসের পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় জয় এসেছে মমতার।
প্রশান্ত কিশোরের এই সাফল্যের যেমন প্রশংসা হয়েছে, তেমনি নিন্দিতও হয়েছেন তিনি। তাঁর সমর্থকেরা বলে থাকেন, তিনি যা–ই করেন, তাতেই সাফল্য পান। আবার নিন্দুকেরা বলেন, খুব সতর্কতার সঙ্গে রাজনীতিক নির্বাচন করেন তিনি। যাঁদের জেতার সম্ভাবনা রয়েছে, তাঁদেরই গ্রাহক হিসেবে তিনি বেছে নেন।
পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনের পর প্রশান্ত কিশোর একটি ঘোষণা দিয়েছিলেন। ৪৪ বছর বয়সী এই পরামর্শক বলেছিলেন, ‘আমি দায়িত্ব ছেড়ে দিচ্ছি। আমি এবার অন্য কিছু করতে চাই।’ কিন্তু সম্প্রতি আবারও আলোচনায় এসেছেন প্রশান্ত কিশোর। কারণ, কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধীসহ বিভিন্ন দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন বিচক্ষণ এ ভোটকুশলী। কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন বিজেপিবিরোধী একটি জোট গঠনের চেষ্টা চালাচ্ছেন তিনি। কিন্তু প্রশান্ত কিশোরের ভাষ্য, সবই জল্পনা। তিনি বলেন, ‘আমি অবশ্যই এমন কিছু করব না, যেটা আমি আগে করেছি। আমরা কাছে অল্প কিছু বিকল্প সুযোগ আছে। কিন্তু আমি এখনো সিদ্ধান্ত নিইনি। এমনটা হতে পারে, আমি এমন কিছু করছি, যার সঙ্গে সরাসরি রাজনীতি নেই। আমি এই সিদ্ধান্ত নিলে আনুষ্ঠানিকভাবে তা জানাব।’
ভারতের লোকসভা নির্বাচনের আরও তিন বছর রয়েছে। আসছে নির্বাচনেও মোদিকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতে বিরোধীদের বেগ পেতে হবে বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। কিন্তু প্রশান্ত কিশোরের ভাবনা অবশ্য অন্য রকম। তিনি বিশ্বাস করেন, বিজেপি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হয়ে ওঠেনি। এখানে যেকোনো দলের সুযোগ রয়েছে। নতুন কিংবা বর্তমান যেকোনো দলের জন্যই এমন হতে পারে। যেকোনো দল একা কিংবা জোটবদ্ধভাবে ক্ষমতাসীনদের চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতে পারে।
প্রশান্ত কিশোরের এই বক্তব্যের পর ভারতের ভোটের চিত্রটিতে একবার চোখ বুলিয়ে নেওয়া যেতে পারে। ১৯৮০-এর দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে কংগ্রেসের ভোট ও আসন কমছে। ২০১৯ সালে দলটি পেয়েছে প্রায় ২০ শতাংশ ভোট। জিতেছে ৫২টি আসন। পরপর দুটি নির্বাচনে হেরেছে দলটি। যদিও দলটির ১০০ জন সাংসদ পার্লামেন্টে রয়েছেন। আর রাজ্যগুলোয় ৮৮০ জন বিধায়ক রয়েছেন। শক্তির দিকে থেকে বিজেপির বিরোধী হিসেবে এখনো কংগ্রেসেই সবচেয়ে শক্তিশালী। কংগ্রেসকে নিয়ে প্রশান্ত কিশোরের পর্যবেক্ষণ রয়েছে। তিনি বলেন, ‘কংগ্রেসের ভুল নিয়ে মন্তব্য করার আমি কেউ না। দলটির যে সংকট রয়েছে, তা বেশ গভীর, যা গত এক দশকে ভোটের ফলে প্রভাব ফেলছে।’
কিশোর বলেন, দেশজুড়ে রাজনীতি করবে, এমন একটি দল তৈরির কথা বলা সহজ, কিন্তু গড়া কঠিন। আর তৃতীয় একটি জোট গঠন করা কার্যকরও হবে না, স্থায়ীও হবে না। আর এমন কোনো জোট ভোট পরীক্ষাতেও অংশ নেয়নি। তিনি বলেন, ২০২৪ সালের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বিজেপি আবারও ক্ষমতায় আসার চেষ্টা করবে। তবে এটাও ঠিক, বিজেপি অজেয় নয়। সুযোগ আছে বিজেপিকে হারানোর। এমনকি এমন উদাহরণও আছে, ঠিকঠাক কৌশল গ্রহণ করলে এবং শ্রম দিলে তাদের হারানো যায়।
প্রশান্ত কিশোরের বক্তব্য হলো, ভারতে কোনো রাজনৈতিক দলের জয়ের সঙ্গে জনপ্রিয়তার সম্পর্ক নেই। যারা ভোটে জয়লাভ করেছে, তারা ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশের বেশি ভোট পায়নি। ২০১৯ সালের বিজেপি যখন জিতেছিল, তখন তারা ভোট পেয়েছিল ৩৮ শতাংশ। আর আসন পেয়েছিল ৩০০-এর বেশি।
প্রশান্ত কিশোর ও তাঁর প্রতিষ্ঠান আই–প্যাক (ইন্ডিয়ান পলিটিক্যাল অ্যাকশন কমিটি) কীভাবে কাজ করে, তার একটা উদাহরণ তিনি দিয়েছেন। কোনো দলের হয়ে নির্বাচনী প্রচারের সময় প্রতিষ্ঠানটির প্রায় ৪ হাজার কর্মী কাজ করেন, যাঁদের প্রত্যেকেই কঠোর পরিশ্রমী। তিনি বলেন, ‘নির্বাচনে ভালো করার জন্য যা করতে হয়, সেই কাজে আমরা সাহায্য করে থাকি। মূলত একটি দলের যে শক্তি রয়েছে, তা কয়েক গুণ বাড়াতে আমরা কাজ করি। আমরা আসলেই কিছু পার্থক্য তৈরি করে থাকি কাজের মাধ্যমে। কিন্তু এই পার্থক্য ঠিক কতটুকু, তা হিসাব করে বলা মুশকিল।’
প্রায় এক দশক ধরে নির্বাচন নিয়ে কাজ করছেন প্রশান্ত কিশোর। এই কাজ করতে গিয়ে তাঁর কিছু অভিজ্ঞতাও হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে, প্রচার সভার গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রয়েছে নির্বাচনের ফলাফলে। নির্বাচনে খরচ বেড়ে গেছে। ফলে অনেকের জন্য রাজনীতিতে আসা কঠিন হয়ে পড়েছে। ভারতের রাজনীতি এবং সমাজের মেরুকরণ হয়েছে অনেক বেশি।
প্রশান্ত কিশোরকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ভারতের যে ৮০ কোটি ভোটার রয়েছে, তাঁরা আসলে কীসের ওপর নির্ভর করে ভোট দিয়ে থাকেন। এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, জনকল্যাণ, পরিচয়, ক্ষমতায়ন, ওই প্রার্থীর কাছে যাওয়ার সুযোগ—এসব কিছুর ওপর নির্ভর করে ভোটাররা ভোট দিয়ে থাকেন। এ ছাড়া আরও কিছু বিষয় রয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমি সব সময় একটি ব্যবস্থা তৈরির চেষ্টা করছি, যার মাধ্যমে এটা জানা যায়, আসলে মানুষ কী বলতে চায়। বিভিন্ন সময় মানুষের কাছ থেকে আমরা যা জানতে পারি, তাতে আমরা অবাক ও অভিভূত হয়ে যাই।’
এর একটি উদাহরণও দিয়েছেন প্রশান্ত কিশোর। বিহারে তাঁর জন্ম। তাঁর প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা ২০১৫ সালে এই রাজ্যের ৪০ হাজার মানুষের কাছে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁরা আসলে জানতে চেষ্টা করছিলেন, রাজ্যের মানুষ আসলে কী চায়। এ প্রসঙ্গে কিশোর বলেন, সেই সময় রাজ্যের অন্যতম ইস্যু ছিল পানিনিষ্কাশন ব্যবস্থা। তাঁরা অনুসন্ধানে এটাও জানতে পেরেছিলেন যে, সেখানকার থানাগুলোয় যেসব অভিযোগ আসে, তার প্রতি পাঁচটির একটি এই নিষ্কাশনসংক্রান্ত।
এমন কাজ গত বছর পশ্চিমবঙ্গেও করেছিলেন কিশোর। এই রাজ্যের মানুষদের অভিযোগ শুনতে একটি হেল্প লাইন চালু করেছিলেন তিনি। এই হেল্প লাইনে প্রায় ৭০ লাখ অভিযোগ এসেছিল। এসব অভিযোগের মধ্য থেকে ২৬ লাখ অভিযোগের সুরাহা করেছিল রাজ্য সরকার। এই টোটকা কাজে এসেছিল তৃণমূল কংগ্রেসের জন্য। এ বছর বিধানসভা নির্বাচনে জিতেছে দলটি।
একসময় রাজনীতি করেছেন প্রশান্ত কিশোর। এরপর রাজনীতি ছেড়ে তিনি হয়েছেন রাজনৈতিক পরামর্শক। এতে সাফল্য এসেছে। কিন্তু তাঁর ধারণা, রাজনীতি ঠিক তাঁর জন্য নয়। তাঁর ভাষ্য, ‘আমি আসলে রাজনীতি ঠিকঠাক বুঝি না। তবে আমার সাধারণ বিবেচনাবোধ আছে। আর আমি মানুষের কথা খুব মনোযোগ দিয়ে শুনি। আমি চাপ নিয়ে কাজ করতে পছন্দ করি।’
বিবিসি অবলম্বনে মোজাহিদুল ইসলাম মণ্ডল