পশ্চিমবঙ্গে পৌরসভা নির্বাচনে প্রার্থী পাচ্ছে না বিজেপি

ছবি: সংগৃহীত

ভারতের পশ্চিমবঙ্গে ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) ধারাবাহিক পতন এখন এক অবিশ্বাস্য আকার নিচ্ছে। ঠিক ছয় মাস আগে যে দলটি পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় আসবে বলে অনেকেই ধরে নিয়েছিলেন, সেই দল এখন কলকাতা পৌরসভার আসন্ন নির্বাচনে প্রার্থী দিতে পারছে না বলে দলেরই একাংশ জানিয়েছে।

পশ্চিমবঙ্গের ১২৬টি পৌরসভাই এখন মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে কলকাতা ও হাওড়া পৌরসভায় ভোট ১৯ ডিসেম্বর।

রাজ্য বিজেপির এক সাধারণ সম্পাদক প্রথম আলোকে বলেন, কলকাতা পৌরসভার ১৪৪টি ওয়ার্ডে দেওয়ার মতো যোগ্য প্রার্থী তাঁরা প্রাথমিক অনুসন্ধান করে পাননি। ‘এমন নয় যে আমরা খুব তলিয়ে অনুসন্ধান করেছি। কিন্তু প্রাথমিক খোঁজখবরের পরে দেখলাম বিশেষ কেউই কলকাতায় প্রার্থী হতে রাজি নন,’ বলেন ওই নেতা।

অথচ ছয় মাস আগে রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনের সময় একেকটি আসনে প্রার্থী হওয়ার জন্য অসংখ্য স্থানীয় নেতা–নেত্রী আবেদন করেছিলেন।

বিজেপি সাধারণ সম্পাদকের ব্যাখ্যা—প্রথমত, প্রার্থী দিতে না পারা প্রমাণ করে তৃণমূল স্তরে দলের সংগঠন এখনো ততটা ছড়ায়নি, যতটা মনে করা হয়েছিল। ‘বাম ফ্রন্ট কোনো আসন পায় না কিন্তু সব আসনে প্রার্থী দিতে পারে। এটা প্রমাণ করে ৫ শতাংশ ভোট পেলেও তাদের একটা সংগঠন আছে, যা আমাদের নেই। এটা ভেবে দেখা প্রয়োজন,’ বলেন ওই নেতা।

দ্বিতীয়ত, বিজেপি করতে গিয়ে অনেকে মার খাচ্ছেন, ঘরছাড়া হচ্ছেন এবং মামলা-মোকদ্দমায় ফেঁসে যাচ্ছেন, যা থেকে বেরোতে তাঁদের বিস্তর টাকাপয়সা খরচ করতে হচ্ছে। অথচ পার্টি তাঁদের পাশে দাঁড়াতে পারছে না বলে অভিযোগ। এ অবস্থায় কেউই বিজেপির প্রার্থী হতে চাইছেন না। তৃতীয়ত এবং সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো বিজেপির ভেতরের কলহ।

বিজেপির অন্তর্দ্বন্দ্ব

বিজেপির দুই সাবেক রাজ্য সভাপতি তথাগত রায় ও দিলীপ ঘোষের সংঘাত এখন প্রায় নিয়মিতই সংবাদের শিরোনাম হচ্ছে। দুই নেতাই কঠোর ভাষায় পরস্পরকে আক্রমণ করছেন। একদিকে দিলীপ ঘোষ তাঁর পূর্বসূরির উদ্দেশে বলেছেন, না পোষালে তথাগত রায় দল ছেড়ে দিতে পারেন। অন্যদিকে তথাগত রায় হুমকি দিচ্ছেন, দল ছাড়তে পারলে তিনি প্রকাশ্যে জানাবেন নির্বাচনে কীভাবে অর্থ তছরুপ হয়েছে এবং নারীঘটিত কেলেঙ্কারিতে জড়িয়েছেন বিজেপির শীর্ষ নেতারা।

বিধানসভা নির্বাচনের ফল প্রকাশ হওয়ার পরেই তথাগত রায় অন্তত চারজন বিজেপি নেতার বিরুদ্ধে এই প্রতিবেদকের কাছে অভিযোগ করেছিলেন এবং বলেছিলেন, তাঁরা পরিকল্পনামাফিক দলকে হারিয়েছেন। এই চার নেতার মধ্যে তিনজন ছিলেন কেন্দ্রীয় স্তরের নেতা—কৈলাস বিজয়বর্গী, অরবিন্দ মেনন, শিব প্রকাশ এবং অপরজন রাজ্য স্তরের নেতা দিলীপ ঘোষ। সেই সময় তিনি ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় সে কথা বললেও এখন খোলাখুলি সামাজিক মাধ্যমে এ অভিযোগ করছেন। গত রোববার সামাজিক মাধ্যমে তথাগত লেখেন, ‘৩ থেকে ৭৭ (এখন ৭০) গোছের আবোলতাবোল বুলিতে পার্টি পিছোবে, এগোবে না। অর্থ ও নারীর চক্র থেকে দলকে টেনে বার করা অত্যাবশ্যক।’ দিলীপ ঘোষ এর আগে বলেছিলেন, তাঁর নেতৃত্বেই বিজেপি পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভায় তিনটি আসন থেকে সাতাত্তরে পৌঁছেছে।

বিজেপির রাজ্য স্তরের এক নেতা প্রথম আলোকে বলেন এই অন্তর্দ্বন্দ্ব সামলাতে না পারলে বিজেপি আরও বড় বিপদের মধ্যে পড়বে। ‘এখন বিজেপির জন্য সবচেয়ে বড় চিন্তার বিষয় হলো এমএলএদের ধরে রাখা। তাঁদের সংখ্যা ক্রমেই কমছে। পাঁচজন এমএলএ এখন পর্যন্ত বিজেপি ছেড়ে তৃণমূলে গিয়েছেন। এভাবে অন্তর্দ্বন্দ্ব চলতে থাকলে কতজন এমএলএ যে বিজেপি ছাড়বেন, তা বলা শক্ত। কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব চুপ করে রয়েছে, কিন্তু তাদের এক্ষুনি পশ্চিমবঙ্গে হস্তক্ষেপ করা উচিত,’ মন্তব্য করেন রাজ্য স্তরের ওই নেতা।

যত সময় যাচ্ছে, পরিস্থিতি বিজেপির জন্য ক্রমেই জটিল হচ্ছে। সোমবার দলের শীর্ষ নেতা শুভেন্দু অধিকারীর নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলায় বিজেপি হাওড়া জেলা সদরের সভাপতি সুরজিৎ সাহাকে বহিষ্কার করেছে, যিনি প্রায় ৩০ বছর বিজেপির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। দলের মধ্যে বিদ্রোহ আগামী দিনে আরও বাড়বে বলে মনে করা হচ্ছে। এরই মধ্যে বিজেপি ছেড়ে দিয়েছেন অভিনেত্রী শ্রাবন্তী চট্টোপাধ্যায়, যিনি গত বিধানসভা ভোটে বেহালা পশ্চিম কেন্দ্র থেকে তৃণমূলের পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে গেরুয়া শিবিরের প্রার্থী ছিলেন। ভোটে পরাজিত হওয়ার পর দলের সঙ্গে দূরত্ব বাড়তে থাকে শ্রাবন্তীর।

পাশাপাশি তৃণমূলের যে আত্মবিশ্বাস বাড়ছে, তা বলাই বাহুল্য। ২০১৯–এর লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি ৪২–এর মধ্যে ১৮ আসন পাওয়ায় তৃণমূল কলকাতাসহ রাজ্যের ১২৬ পৌরসভায় নির্বাচন করেনি ওই পৌরসভাগুলোর মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও। কিন্তু এখন তারা নির্বাচন করতে চাইছে। কারণ, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বুঝতে পেরেছেন, এখন তাঁর দল প্রায় সব পৌরসভাতেই জিতবে।