ভারতের প্রধান বিচারপতিকে অপসারণের উদ্যোগ

ভারতের সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্রকে অপসারণের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগের একটি, শীর্ষ বিচারপতিদের উপেক্ষা করে তিনি নিজের খেয়ালখুশিমতো পছন্দের বিচারপতিদের এজলাসে গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর মামলাগুলো পাঠাচ্ছেন। কিছুদিন আগে সর্বোচ্চ আদালতের চার শীর্ষ বিচারপতি প্রকাশ্যে প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে এ অভিযোগ এনেছিলেন। ওই চারজন হলেন বিচারপতি জে চেলামেশ্বর, বিচারপতি রঞ্জন গগৈ, বিচারপতি কুরিয়ন জোসেফ ও বিচারপতি মদন বি লকুর।
প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসের শীর্ষ নেতা গুলাম নবি আজাদ, আহমেদ প্যাটেল, কপিল সিবাল ও আনন্দ শর্মা বিভিন্ন বিরোধী দলের নেতাদের সঙ্গে এ উদ্যোগ নিয়ে আলোচনা চালাচ্ছেন।
অপসারণ প্রস্তাবের পক্ষে সই সংগ্রহ চলছে। এ বিষয়ে ইতিমধ্যেই তাঁরা এনসিপি, সমাজবাদী পার্টি, ডিএমকে, আইইউএমএল ও বাম দলগুলোর সঙ্গে কথা বলেছেন। তৃণমূল নেত্রী ও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গেও অনেকে এ বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন। মমতা তাঁদের বলেছেন, বিষয়টি নিয়ে তিনি দলীয় মহলে আলোচনা করবেন। সুপ্রিম কোর্টের বিশিষ্ট আইনজীবী প্রশান্ত ভূষণ বিষয়টি নিয়ে গতকাল মঙ্গলবার মমতার সঙ্গে কথা বলেন। কংগ্রেসসহ বিরোধীরা এ প্রস্তাবটি রাজ্যসভায় আনতে চাইছেন।
ন্যাশনালিস্ট কংগ্রেস পার্টির (এনসিপি) মজিদ মেমন জানিয়েছেন, এ পর্যন্ত ২০টি সই সংগ্রহ করেছে। এর মধ্যে কংগ্রেসের তিন নেতা গুলাম নবি, আহমেদ প্যাটেল এবং কপিল সিবাল পিটিশনে সই করেছেন। এ ছাড়া এনসিপির পাঁচজন এই পিটিশনে সই করেছেন।
এনসিপির ডিপি ত্রিপাঠি বলেন, ‘আমি এতে (পিটিশন) সই করেছি। অন্যরাও সই করছে এবং প্রক্রিয়াটি অব্যাহত রয়েছে।’ এ ছাড়া সিপিআই-এম এবং সিপিআইও পিটিশনে সই করেছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
আজ বুধবার সমাজবাদী পার্টি জানিয়েছে, তারা এই পিটিশনকে সমর্থন করে। দলটির এক নেতা বার্তা সংস্থা এএনআইকে বলেন, ‘সমাজবাদী পার্টি এই প্রস্তাবের পাশে রয়েছে।’
ভারতীয় সংবিধান অনুযায়ী দেশের প্রধান বিচারপতিসহ সুপ্রিম ও হাইকোর্টের বিচারপতিদের দুর্ব্যবহার, দুর্নীতি অথবা অযোগ্যতার কারণে অপসারণ করা যায়। সে জন্য সংসদের উভয় কক্ষের যেকোনো একটিতে এ-সংক্রান্ত প্রস্তাব আনতে হয়। লোকসভায় প্রস্তাবের পক্ষে প্রয়োজন ১০০ সদস্যের সই, রাজ্যসভায় ৫০ সদস্যের। প্রস্তাবটি গৃহীত হলে সভার অধ্যক্ষ তিন সদস্যের এক কমিটি গঠন করবেন। সেই কমিটি অভিযোগ সত্য মনে করলে প্রস্তাবটি সভায় আলোচিত হবে। অপসারণের জন্য সংসদের দুই কক্ষেই প্রস্তাবের পক্ষে বিশেষ সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রয়োজন। প্রস্তাব সেই গরিষ্ঠতা পেলে তা অনুমোদনের জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানো হয়। কংগ্রেস সূত্রের খবর, বিরোধীরা এই প্রস্তাবটি রাজ্যসভায় আনতে আগ্রহী। এই কক্ষে বিরোধীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ।
সুপ্রিম কোর্টের চার শীর্ষ বিচারপতি গত জানুয়ারি মাসে দীপক মিশ্রর বিরুদ্ধে খামখেয়ালিপনার মারাত্মক অভিযোগ এনেছিলেন। প্রকাশ্যে সংবাদ সম্মেলন করে তাঁরা বলেছিলেন, গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর মামলাগুলো প্রধান বিচারপতি তাঁদের এজলাসে না পাঠিয়ে তাঁর পছন্দের ও কাছের জুনিয়র বিচারপতিদের কাছে পাঠাচ্ছেন। এভাবে চার শীর্ষ বিচারপতিকে তিনি অবহেলা করছেন। প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে তাঁরা দুর্নীতির অভিযোগও এনেছিলেন। সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি অমিতাভ রায়ও কিছুদিন আগে প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে একই রকমের অভিযোগ এনেছিলেন। তাঁদের অভিযোগের পর কয়েক মাস কেটে গেলেও সুপ্রিম কোর্টের হাল ফেরেনি বলে কংগ্রেসসহ বিভিন্ন বিরোধী দলের অভিযোগ। সে কারণেই প্রধান বিচারপতিকে অপসারণের উদ্যোগ।
দীপক মিশ্রর বিরুদ্ধে একটি বিশেষ অভিযোগ ছিল, চার শীর্ষ বিচারপতিকে উপেক্ষা করে সিবিআই বিচারপতি ব্রিজগোপাল হরকিষেণ লোয়ার মৃত্যু সম্পর্কিত মামলা তিনি পছন্দের বিচারপতির কাছে পাঠিয়েছেন। গুজরাটের সোহরাবুদ্দিন ভুঞা সংঘর্ষ হত্যা মামলা চলছিল বিচারপতি লোয়ার এজলাসে। ওই মামলায় অন্যতম অভিযুক্ত ছিলেন অমিত শাহ, যিনি এখন বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি। অভিযোগ, অমিত শাহর পক্ষে রায় দেওয়ার জন্য বিচারপতি লোয়াকে ১০০ কোটি রুপি ঘুষের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। তা নিতে অস্বীকার করার পর হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে তাঁর মৃত্যু হয়। লোয়ার পরিবারের পক্ষে কেউ কেউ এই মৃত্যু স্বাভাবিক মনে করতে রাজি নন। এই মৃত্যুর তদন্তে যে জনস্বার্থ মামলা সুপ্রিম কোর্টে দায়ের করা হয়, অভিযোগ, চার শীর্ষ বিচারপতিকে এড়িয়ে পছন্দের এক বিচারপতির এজলাসে তা পাঠিয়েছিলেন প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্র। সংবাদ সম্মেলনে এ বিষয়েরও উল্লেখ করেছিলেন ওই চার শীর্ষ বিচারপতি।
কংগ্রেস নেতারা প্রকাশ্যে কিছু না বললেও মহারাষ্ট্রের নেতা শরদ পাওয়ারের দল জাতীয়তাবাদী কংগ্রেস পার্টির (এনসিপি) সদস্য মজিদ মেনন সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, ২০ জন সাংসদ ইতিমধ্যেই প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিয়েছেন।
ভারতে আজ পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্ট বা হাইকোর্টের কোনো বিচারপতিকে ‘ইমপিচমেন্ট’ প্রস্তাব এনে অপসারণ করা যায়নি। যদিও দুবার এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। প্রথমবার ১৯৯৩ সালে। পাঞ্জাব ও হরিয়ানা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি ভি রামস্বামীর বিরুদ্ধে লোকসভায় ইমপিচমেন্ট প্রস্তাব আনা হয়। কংগ্রেসের বিরোধিতায় দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকায় প্রস্তাবটি পরাজিত হয়। দ্বিতীয় প্রস্তাবটি ছিল কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি সৌমিত্র সেনের বিরুদ্ধে। ২০০৯ সালে প্রস্তাবটি রাজ্যসভায় পাস হয়। লোকসভায় আসার আগে বিচারপতি সেন পদত্যাগ করেন। ২০১১ সালে সিকিম হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি পি ডি দিনাকরণের বিরুদ্ধে ইমপিচমেন্টের উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু প্রস্তাব কার্যকর হওয়ার আগেই তিনি ইস্তফা দেন।
ভারতীয় সংসদের উভয় কক্ষই এই মুহূর্তে অচল। অচলাবস্থার কারণে সরকারের বিরুদ্ধে আনা অনাস্থা প্রস্তাবও বিবেচিত হতে পারছে না। বিরোধীদের অভিযোগ, ইচ্ছাকৃতভাবে সরকারপক্ষ সংসদ অচল করে রেখেছে, যাতে অনাস্থা প্রস্তাব বিবেচিত হতে না পারে। এই পরিস্থিতিতে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে ইমপিচমেন্টের প্রস্তাব গ্রহণ করে সংসদে সরকার বিরোধিতার সুযোগ মোদি সরকার বিরোধীদের হাতে তুলে দেবে কি? প্রশ্নটি বিরোধী মহলে ঘোরাফেরা করছে।