ভারতে নেতা-নেত্রীদের সম্পত্তি বাড়ছে সাংঘাতিকভাবে

অর্থ আত্মসাৎ
প্রতীকী ছবি

ভারতের রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীদের সম্পত্তি, বিশেষত জমিজমা সাংঘাতিক বেড়ে যাওয়ার প্রবণতা গত কয়েক সপ্তাহে দেশটিতে এক বড় বিষয় হিসেবে সামনে এসেছে।
গত এক মাসে এ–সংক্রান্ত অন্তত তিনটি বড় অভিযোগ সামনে এসেছে। এর প্রথমটি নিয়ে প্রতিবেদন করেছে দুটি সংবাদমাধ্যম। এ অভিযোগে বলা হয়েছে, আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মার স্ত্রী রিংকি ভূঁইয়া শর্মা ও তাঁর পরিবার সরকারি জমি হস্তগত, ব্যবহার এবং বিক্রি করেছেন। বিষয়টি নিয়ে ১০ জানুয়ারি থেকে আসামে প্রায় এক মাসের জন্য আন্দোলনে নামছে প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস। মুখ্যমন্ত্রীর পরিবারের বিরুদ্ধে অভিযোগটির বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবিতে তাঁরা পথে নামবেন বলে আজ মঙ্গলবার জানিয়েছেন আসাম কংগ্রেসের সভাপতি ভূপেন কুমার বরা।

পাশাপাশি কলকাতা পৌর করপোরেশনের নির্বাচনী হলফনামায় দেখা গেছে, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাইয়ের স্ত্রী কাজরী বন্দ্যোপাধ্যায় বিপুল পরিমাণ সম্পত্তির অধিকারী। একজন সমাজকর্মী কাজরীর এত সম্পত্তি কোথা থেকে এল, তা জানতে মঙ্গলবার হলফনামা পেশ করার নির্দেশ দিয়েছেন কলকাতা হাইকোর্ট।
কংগ্রেসের পক্ষ থেকেও অযোধ্যায় রামমন্দিরের জন্য অধিগ্রহণ করা জমি নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ বিজেপির বিরুদ্ধে তোলা হয়েছে। সম্প্রতি আরও একাধিক রাজ্য যেমন তামিলনাড়ু, মহারাষ্ট্র বা অন্ধ্র প্রদেশ থেকে রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে আইনবহির্ভূতভাবে জমি অধিগ্রহণের খবর পাওয়া গেছে।

মমতার পরিবারের সম্পত্তি নিয়ে হলফনামা পেশের নির্দেশ
আসামের পাশের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গেও মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিবারের সম্পত্তির পরিমাণ দেখে অবাক হয়েছেন অনেকে। মমতা বরাবরই বলে এসেছেন তাঁর বা তাঁদের পরিবারের বিরাট সম্পত্তি নেই। অথচ গত ডিসেম্বরে কলকাতা পৌর করপোরেশনের নির্বাচনের প্রাক্কালে দেখা গেল, মুখ্যমন্ত্রীর ভাই সমীর বন্দ্যোপাধ্যায় ও তাঁর স্ত্রী কাজরী বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিপুল পরিমাণ সম্পত্তি রয়েছে। কাজরী পৌর করপোরেশন নির্বাচনে দাঁড়িয়ে ছিলেন দক্ষিণ কলকাতার ৭৩ নম্বর ওয়ার্ড থেকে এবং জিতেছেন।

কাজরী বন্দ্যোপাধ্যায় নির্বাচনী হলফনামায় বলেছেন, তাঁদের দক্ষিণ কলকাতার হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটসহ কালীঘাট এলাকায় নয়টি জমি রয়েছে। ওডিশা রাজ্যের পুরী ও তালতোরেও সম্পত্তি রয়েছে। এই ১১টি অস্থাবর সম্পত্তির বাজারমূল্য ২ কোটি ১০ লাখ রুপি বলে হলফনামায় উল্লেখ করেন তিনি। প্রশ্ন হলো হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিট কলকাতার অন্যতম অভিজাত এলাকা; যেখানে জমির দাম খুব বেশি। সেখানকার একটি প্লটের দাম কী করে ভারতীয় মুদ্রায় ২ কোটির কাছাকাছি হয় তা নিয়ে অল্পবিস্তর লেখালেখি হয়েছে সংবাদমাধ্যমে।

কাজরী জানিয়েছেন, তিনি ও তাঁর স্বামী সমাজকর্মী এবং তাঁদের প্রায় ৫ কোটি টাকার সম্পত্তি রয়েছে। কোনো সমাজকর্মীর কীভাবে ৫ কোটি টাকার সম্পত্তি ও ১১টি জমির মালিকানা থাকতে পারে, তা নিয়েও উঠছে প্রশ্ন। বিরোধীরা অবশ্য এ নিয়ে বিশেষ মুখ খোলেননি।

ইমতিয়াজ আহমেদ নামের এক আইনজীবী কলকাতা হাইকোর্টে একটি জনস্বার্থ মামলা করে জানতে চান, কাজরী নিজেকে সমাজকর্মী হিসেবে পরিচয় দিলেও কীভাবে তাঁর কাছে কয়েক কোটি টাকার সম্পত্তি এল। আহমেদ বিষয়টির নিরপেক্ষ তদন্তের জন্য কলকাতা হাইকোর্টে আবেদন জানান। এই মামলায় হাইকোর্ট রাজ্যের নির্বাচন কমিশন, রাজ্য সরকারের সদর দপ্তর নবান্ন, কাজরী বন্দ্যোপাধ্যায় ও আইনজীবী আহমেদকে আদালতে হলফনামা জমা দিয়ে নিজেদের অবস্থান ও বক্তব্য জানাতে বলেছে।

সপ্তাহ কয়েক আগে কাজরী তাঁর সম্পত্তি সম্পর্কে বলেন, ‘আমাদের সবকিছুই বৈধ। সবকিছুরই কাগজপত্র রয়েছে এবং প্রয়োজনে তদন্ত করে দেখতে পারে কোনো অসংগতি রয়েছে কি না।’

এই মামলার পরবর্তী শুনানি হবে ২৮ ফেব্রুয়ারি। আদালত মামলাটি গ্রহণ করায় ও এটিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করায় ভবিষ্যতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাইয়ের সম্পত্তির বিষয়টি যে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে একটা ইস্যু হয়ে উঠবে, তা ইতিমধ্যে পরিষ্কার হয়ে গেছে।

আসামের মুখ্যমন্ত্রীর পরিবারের বিরুদ্ধে অভিযোগ
সম্ভবত সবচেয়ে খোলাখুলিভাবে জমি কেনাবেচা হয়েছে আসামে; যা মুখ্যমন্ত্রীর পরিবার করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। আসামের অনলাইন সংবাদমাধ্যম ‘দ্য ক্রসকারেন্ট’ ও দিল্লির ‘দ্য ওয়্যার’ একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে বলেছে, আর বি রিয়েলটারস প্রাইভেট লিমিটেড নামে আসামে একটি জমি বেচাকেনার সংস্থা অতীতে ১৮ একর (৭২ বিঘা) সরকারি জমি অধিগ্রহণ করেছে।

সংস্থার যুগ্ম প্রতিষ্ঠাতা মুখ্যমন্ত্রীর স্ত্রী ও তাঁর ছেলে নন্দিল বিশ্বশর্মার এ সংস্থায় বিরাট অঙ্কের শেয়ার রয়েছে। জমিটি রয়েছে গুয়াহাটির জালুকবারি অঞ্চলে; যা মুখ্যমন্ত্রী বিশ্বশর্মার নির্বাচনী কেন্দ্রের মধ্যে। জমিটি আইনবহির্ভূতভাবে অধিগ্রহণ, ব্যবহার ও বিক্রি করা হয়েছে—জানিয়েছে দুই সংবাদমাধ্যম।

জমি কেনা হয়েছে দুই পর্যায়ে; ২০০৬-০৭ সালে ও ২০০৯ সালে। সেই সময়ে হিমন্ত বিশ্বশর্মা আসামের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন না। তিনি কংগ্রেস দলের প্রভাবশালী মন্ত্রী ছিলেন। সেই সময় আসামে ক্ষমতায় ছিল কংগ্রেস। ২০০৯ সালে রিনিকি ভূঁইয়া সংস্থার নির্দেশকের পদ থেকে সরে যান ও তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন একজন ব্যবসায়ী। যদিও বিজেপির কৃষক মোর্চার সহসভাপতি রঞ্জিত ভট্টাচার্য আরবিএস রিয়েলটারসে থেকে যান। তাঁকে মুখ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ নেতা বলে মনে করা হয়।

স্বল্প সময়ের মধ্যে এই জমি কেনাবেচার মাধ্যমে প্রভূত লাভ করা হয় বলে সংবাদমাধ্যমে অভিযোগ করা হয়েছে। কেনাবেচাসংক্রান্ত তথ্য আসাম সরকারের ওয়েবসাইটেই রয়েছে বলে প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে।

আসাম বিধানসভায় কংগ্রেসের নেতা দেবব্রত শইকীয়া বলেছেন, আসামের দুটি জমিসংক্রান্ত আইন রয়েছে; যা ১৯৮৯ ও ১৯৫৬ সালে প্রণয়ন করা হয়েছিল। সেই আইন মোতাবেক যে পরিমাণ জমি একজন কিনতে পারেন, তার চেয়ে বেশি জমি কিনে তা দ্রুত বিক্রি করা হয়েছে। এ ধরনের সরকারি জমি ১০ বছরের আগে বেচাকেনা করা যায় না। অভিযোগ রয়েছে, জমি তিন মাসের মধ্যে বিক্রি করে মুনাফা করা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে তদন্ত হওয়া প্রয়োজন বলে শইকীয়া মন্তব্য করেন।
উল্লেখ্য, আসামের জমি বহিরাগতরা নিয়ে নিচ্ছে বলে লাগাতার উচ্ছেদ অভিযান চালাচ্ছে সরকার। এই উচ্ছেদ অভিযানে অনেকের মৃত্যুও হয়েছে। জনসমক্ষে এই অভিযানকে সমর্থন দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা।

আসাম সরকারের পক্ষ থেকে অভিযোগের কোনো পাল্টা প্রতিক্রিয়া দেওয়া হয়নি। তবে সরকারের ঘনিষ্ঠ একজন সাংবাদিক অতনু ভূঁইয়া সামাজিক মাধ্যমে বলেছেন, অভিযোগগুলো ভ্রান্ত। সম্পত্তির নতুন মালিক রঞ্জিত ভট্টাচার্য তাঁকে জানিয়েছেন, তাঁরা মামলা করবেন। বস্তুত ওই সংস্থা (যার বর্তমান নাম বশিষ্ঠ রিয়ালটারস প্রাইভেট লিমিটেড) দ্য ওয়্যারকে আইনি নোটিশ পাঠিয়েছেন।

এ দুই অভিযোগের পাশাপাশি কংগ্রেসের তরফে ডিসেম্বরে অভিযোগ করা হয়, অযোধ্যায় রামমন্দির নির্মাণের জন্য জমির দাম ‘মিনিটে মিনিটে বেড়ে’ ২ কোটি টাকা থেকে প্রায় ২০ কোটিতে পৌঁছেছে। কংগ্রেস নেত্রী প্রিয়াঙ্কা গান্ধী অভিযোগ করেন, যে জমির দাম ২ কোটি টাকা, তার জন্য দুই ভাগে ৮ ও সাড়ে ১৮ কোটি টাকা দিয়েছে রামমন্দির ট্রাস্ট।

বিষয়টি নিয়ে ইতিমধ্যে বিজেপি নেতাদের একাংশ ও সরকারি আমলাদের কয়েকজনের নামে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে উত্তর প্রদেশ সরকার।