ভুয়া টিকা–কাণ্ডের মূল হোতাকে পুলিশ হেফাজতে রাখার নির্দেশ
কলকাতার চাঞ্চল্যকর ভুয়া টিকা–কাণ্ডের মূল হোতা দেবাঞ্জন দেবকে আগামী ২ জুলাই পর্যন্ত পুলিশ হেফাজতে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। শনিবার হত্যাচেষ্টাসহ বেশ কয়েকটি মামলায় দেবকে কলকাতার আলীপুর আদালতে তোলা হলে আদালত এ নির্দেশ দেন।
একই সঙ্গে দেবাঞ্জনের তিন সহকারীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তাঁরা হলেন সুশান্ত দাস, রবীন সিকদার ও শান্তনু মান্না। তাঁদের কারাগারে পাঠানো হয়েছে। তাঁরাই মূলত দেবের ভুয়া অফিস চালাতেন। বিভিন্ন এলাকায় টিকাদানের ক্যাম্পের আয়োজন করতেন।
এদিকে রাজ্যের স্বাস্থ্য দপ্তর চিকিৎসক শান্তনু ত্রিপাঠিকে প্রধান করে চার সদস্যের একটি বিশেষজ্ঞ টিম গঠন করা হয়েছে। এ কমিটি যেসব মানুষ ভুয়া টিকা নিয়েছেন, তাঁদের স্বাস্থ্য পরীক্ষার উদ্যোগ নেবে। আজ কসবা এবং কলকাতার সিটি কলেজে ভুয়া টিকা গ্রহণকারীদের শারীরিক পরীক্ষা করা হয়েছে। সেখানে কিছু মানুষের সামান্য উপসর্গ দেখা গেলেও অধিকাংশের উপসর্গ তেমন প্রকট ছিল না।
ভুয়া টিকা দেওয়ার ঘটনা প্রকাশের পরে তদন্ত শুরু করেছে কলকাতা পুলিশও। কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা কর্মকর্তা সৈকত ঘোষের নেতৃত্বে ১০ সদস্যের একটি বিশেষ তদন্ত দল গঠন করা হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে আটক দেবাঞ্জন দেবকে।
কলকাতার পুলিশ কমিশনার সৌমেন মিত্রকে এ ঘটনার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অনিচ্ছাকৃত খুনের মামলা দায়েরের নির্দেশ দিয়েছেন মমতা। তাঁর নির্দেশ, এ ঘটনায় পুলিশ যেন কোনো আপস না করে, সহানুভূতি না দেখায়। অন্যদিকে বিজেপি দাবি করেছে, এ ভুয়া টিকা–কাণ্ডের সঙ্গে জড়িত আছেন শাসক দলের বহু নেতা–কর্মী। তাই এ ঘটনার সিবিআই তদন্ত হলে বেরিয়ে পড়বে আসল দোষী ব্যক্তিদের নাম। এদিকে কলকাতা হাইকোর্টে গতকালই সিবিআই তদন্ত চেয়ে দায়ের হয়েছে একটি জনস্বার্থ মামলা। এ মামলা করেছেন আইনজীবী সন্দীপন দাস।
গত মঙ্গলবার কলকাতার কসবায় একটি কেন্দ্রে গিয়ে করোনার টিকা নেন তৃণমূলের সাংসদ ও অভিনেত্রী মিমি চক্রবর্তী। এ সময় তাঁকে দেওয়া হয়নি কোনো সনদ।
জানানো হয়, মুঠোফোনে পাঠানো হবে টিকার সনদ। কিন্তু সেই সনদ না আসায় সন্দেহ হয় মিমির। পুলিশ ডাকেন তিনি। আটক করা হয় ওই কেন্দ্রের পরিচালক দেবাঞ্জন দেবকে। এরপরই কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে বেরিয়ে আসে সাপ।
পুলিশি তদন্তে জানা গেছে, নিজেকে একজন আইএএস কর্মকর্তা ও কলকাতা করপোরেশনের যুগ্ম কমিশনার হিসেবে পরিচয় দিয়ে ভুয়া টিকার কেন্দ্র চালাতেন দেবাঞ্জন। সরকারি স্টিকার বসানো গাড়িতে চড়তেন। ছিল সশস্ত্র নিরাপত্তারক্ষীও।
দেবাঞ্জন ১৩ জনের একটি দল তৈরি করে তাঁদের দিয়ে ভুয়া টিকা দেওয়ার কেন্দ্র পরিচালনা করতেন। পুলিশ ইতিমধ্যে ১১ জনকে চিহ্নিত করেছে। দেবাঞ্জনের কসবার দপ্তরে অভিযান চালিয়ে বেশ কিছু ভুয়া করোনার টিকা উদ্ধার করেছে পুলিশ।
দেবাঞ্জন শুরুতে কলকাতার পাইকারি ওষুধের বাজার বড়বাজারের বাগরি মার্কেটের এক ওষুধ ব্যবসায়ীর কাছ থেকে একধরনের অ্যান্টিবায়োটিক ইনজেকশন কিনেছিলেন। পরে লেবেল পরিবর্তন করে করোনার টিকা কোভিশিল্ড, কোভ্যাকসিন ও স্পুতনিক-ভির লেবেল লাগিয়ে নেন। এসব ভুয়া টিকা ব্যবহার করা হতো তাঁর টিকাদানকেন্দ্রে।
দেবাঞ্জনের চালচলনে এতটুকু ঘাটতি ধরা পড়েনি। তিনি কসবার টিকাকেন্দ্রে গত ১০ দিনে বিনা মূল্যে প্রায় দেড় হাজার মানুষকে করোনার ভুয়া টিকা দিয়েছেন। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, শুধু কসবায় নয়, কলকাতার সিটি কলেজেও টিকাদানকেন্দ্র খুলে কলেজের শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও কর্মচারীদেরও ভুয়া টিকা দিয়েছেন তিনি। এমনকি নিজের প্রতিষ্ঠানের কর্মীদেরও তিনি এ ভুয়া টিকা দিয়েছেন। কসবায় সাংসদ মিমিকেও করোনার এ ভুয়া টিকা দেওয়া হয়েছে।
অ্যান্টিবায়োটিক ইনজেকশন নিয়ে কলকাতার চিকিৎসকেরা বলছেন, এই অ্যান্টিবায়োটিক যকৃৎ ও স্নায়ুর ক্ষতি করে। ডায়াবেটিস রোগীদের কিডনির ক্ষতি করে। এই অ্যান্টিবায়োটিক সাধারণত ইউরিন ইনফেকশন সারাতে ব্যবহৃত হয়।
শুধু তা-ই নয়, কলকাতা পৌর করপোরেশনের বিশেষ কমিশনার তাপস চৌধুরীর সই জাল করে দেবাঞ্জন তিনটি ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খুলেছেন। এ সময় তিনি পৌর করপোরেশনের কর্মকর্তা হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন। কসবার এক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে কমিউনিটি সেন্টার গড়ার নামে ৯০ লাখ রুপি ও আরেক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ২৬ লাখ রুপি হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে দেবাঞ্জনের বিরুদ্ধে। অভিযোগ রয়েছে, দেবাঞ্জন সরলা ডেভেলপমেন্ট মাইক্রোফিন্যান্স নামের একটি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে করোনার টিকা দেওয়ার নাম করে ১ লাখ ১১ হাজার রুপি নিয়েছেন।