ভোট–পরবর্তী সহিংসতা নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ভূমিকায় আদালতের অসন্তোষ

কলকাতা হাইকোর্ট
ছবি: প্রথম আলো

পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচনের পর বিরোধী রাজনৈতিক নেতা–কর্মীদের ওপর হামলা-সহিংসতার ঘটনায় ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থতার জন্য রাজ্য সরকারের ভূমিকায় অসন্তোষ জানিয়েছেন কলকাতা হাইকোর্ট।

রাজ্য সরকারের আবেদন খারিজ করে ভারতের জাতীয় মানবাধিকার কমিশনকে এসব ঘটনার তদন্ত করে আদালতে প্রতিবেদন দেওয়ার নির্দেশও দিয়েছেন আদালত।

এবার পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস বিপুল ভোটে জয়ী হওয়ার পর রাজ্যজুড়ে শুরু হয় দলটির কর্মীদের তাণ্ডব। হামলা শুরু হয় বিজেপি সমর্থকদের ওপর, তাঁদের বাড়িঘর ও দোকানপাট ভাঙচুর করা হয়। শুধু তা–ই নয়, রাজ্যের বিভিন্ন এলাকায় সন্ত্রাসের কবলে পড়ে বিজেপির বহু নেতা-কর্মী-সমর্থক জীবনের ভয়ে এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যান। বেশ কয়েকজন বিজেপি কর্মী খুনও হন। এসব ঘটনায় সংশ্লিষ্ট থানায় মামলা হলেও পুলিশ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি বলে অভিযোগ। ফলে হাজারো বিজেপি সমর্থক বাড়িছাড়া হন। এ নিয়ে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনে ৫৪১টি আবেদন জমা পড়ে। কিন্তু রাজ্য মানবাধিকার কমিশনে একটি আবেদনও জমা পড়েনি।

এই নির্বাচনোত্তর সহিংসতা নিয়ে হাইকোর্টের শরণাপন্ন হন বেশ কয়েকজন ভুক্তভোগী। করা হয় জনস্বার্থ মামলা। সেই মামলার শুনানি হয় কলকাতা হাইকোর্টের পাঁচ সদস্যের ডিভিশন বেঞ্চে। হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি রাজেশ বিন্দলের নেতৃত্বে গড়া এই ডিভিশন বেঞ্চের অন্য চার বিচারপতি হলেন বিচারপতি ইন্দ্র প্রসন্ন, বিচারপতি সৌমেন সেন, বিচারপতি হরিশ ট্যান্ডন ও বিচারপতি সুব্রত তালুকদার।
এর আগে আদালত সহিংসতার মুখে ঘর ছেড়ে যাওয়া ব্যক্তিদের ফেরাতে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে দেন। সেই কমিটির কাছে নির্বাচনোত্তর সহিংসতার ৩ হাজার ২৪৩টি অভিযোগ জমা পড়ে।

এরপরই হাইকোর্টের এই ডিভিশন বেঞ্চ নির্দেশ দেন, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন নির্বাচনোত্তর সহিংসতা তদন্তের জন্য একটি দল গঠন করবে। ওই কমিটির সদস্যরা সরেজমিনে নির্বাচনোত্তর সহিংসতার তদন্ত করে ৩০ জুনের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেবেন।

হাইকোর্টের এ আদেশ মেনে নিতে পারেনি পশ্চিমবঙ্গ সরকার। গতকালই তারা ওই আদেশ পুনর্বিবেচনার আবেদন করে এই ডিভিশন বেঞ্চে। রাজ্য সরকারের সেই আবেদনের শুনানি হয় আজ সোমবার হাইকোর্টের এই ডিভিশন বেঞ্চে। শুনানির পর হাইকোর্ট রাজ্য সরকারের পুনর্বিবেচনার আবেদন খারিজ করে দিয়ে ১৮ জুনের আদেশ বহাল রাখেন। অর্থাৎ জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের গড়া তদন্ত কমিটিই নির্বাচনোত্তর সহিংসতার সরেজমিন তদন্ত করে রিপোর্ট দেবে হাইকোর্টে। যদিও রাজ্য সরকার দাবি করেছে, বিভিন্ন ঘটনার তদন্ত তারা করেছে।

এ বিষয়ে রাজ্য সরকার একটি প্রতিবেদন জমা দেয় হাইকোর্টে। সেই প্রতিবেদন দেখে হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি রাজেশ বিন্দল বলেন, ‘এই সবকিছু দেখতে চাই না।

যেভাবে তদন্ত হয়েছে, তা সঠিক নয়। পুলিশ এফআইআরই করেনি। এত গুরুতর অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও রাজ্য সরকার স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। এত লুকোচুরি কেন? এর মানে তো অভিযোগকারীদের কোনো বক্তব্যই শুনছেন না। তাই রাজ্যের এই আশ্বাসে আদালত ভরসা রাখতে পারছে না। তাই শেষ যে নির্দেশ ছিল, তা–ই বহাল থাকবে। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের গড়া কমিটিই সহিংসতার তদন্ত করবে। তবে রাজ্য সরকার চাইলে এ নিয়ে হলফনামা দিতে পারে।’

গত ২ মে নির্বাচনের ফল প্রকাশের পর রাজ্যের বিভিন্ন এলাকায় সহিংসতার অভিযোগ তুলে ধরে বিজেপি। এদিকে রাজ্যপালের কাছে এ বিষয়ে নানা অভিযোগ এলে তিনিও বিভিন্ন এলাকায় ছুটে যান। কথা বলেন ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের সঙ্গে। এরপর করা হয় জনস্বার্থ মামলা।

এই মামলার শুনানিকালে প্রধান বিচারপতি রাজেশ বিন্দল বলেন, ‘আমাদের পর্যবেক্ষণে ভোট–পরবর্তী সহিংসতার প্রমাণ রয়েছে। অথচ গোড়া থেকে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে আসছিল রাজ্য সরকার। কলকাতার লিগ্যাল সার্ভিস কমিটির রিপোর্টেও সহিংসতার কথা বলা হয়েছে।’

এরপরই ১৮ জুন হাইকোর্ট আদেশ দেন, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন একটি দল বা কমিটি গঠন করবে। তারা রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত ঘুরে সহিংসতার প্রতিবেদন পর্যবেক্ষণ করবে। এরপর ৩০ জুনের মধ্যে সেই প্রতিবেদন জমা দিতে হবে আদালতে। আর এই পর্যবেক্ষণকালে মানবাধিকার কমিশনের গড়া তদন্ত দলকে সার্বিক সাহায্য ও সহযোগিতা করতে হবে রাজ্য মানবাধিকার কমিশন ও পুলিশকে। এ নির্দেশ মানা না হলে আদালত অবমাননার দায় আসতে পারে রাজ্য সরকারের ওপর।