মমতার মুখ্যমন্ত্রিত্ব ধরে রাখার লড়াই আজ

ফল ঘোষণা ৩ অক্টোবর। পর্যবেক্ষকেরা বলছেন, মমতার হেরে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়

ভারতের পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ কলকাতার ভবানীপুর বিধানসভা কেন্দ্রে আজ বৃহস্পতিবার উপনির্বাচন। এই উপনির্বাচন নির্ধারণ করবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ। দুই লাখের কিছু বেশি ভোটারের এই আসনে হেরে গেলে সাময়িকভাবে সমস্যায় পড়বেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ভারতের নির্বাচনী রীতি অনুযায়ী কোনো জনপ্রতিনিধি নির্বাচনে হেরে গিয়েও পদ গ্রহণ করলে তাঁকে ছয় মাসের মধ্যে আবার নির্বাচনে দাঁড়িয়ে জিতে আসতে হয়। গত এপ্রিল-মে মাসে বিধানসভা নির্বাচনে পূর্ব মেদিনীপুরের নন্দীগ্রাম থেকে হেরে যান মমতা। সেই কারণেই তাঁকে পাড়ার কেন্দ্র ভবানীপুরে দাঁড়াতে হলো, কারণ অনির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তাঁর কার্যকালের মেয়াদ শেষ হচ্ছে ৫ নভেম্বর। উপনির্বাচনের ফল ঘোষণা করা হবে ৩ অক্টোবর।

ভবানীপুরে মমতাযর হেরে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। ২০১১ সালে কেন্দ্রটি তৈরি হওয়ার পর এবং তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতায় আসার পর এখানে কখনো তৃণমূল হারেনি। ২০১৬ সালে মমতা এখানে জিতেছিলেন ২৫ হাজার ভোটের ব্যবধানে। ২০২১-এ তাঁর সহকর্মী শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় জিতেছিলেন ২৮ হাজার ভোটে। ইতিহাস বলছে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘরের মাঠে তাঁকে পরাস্ত করা অসম্ভব। তবু তৃণমূল কংগ্রেস চাপে রয়েছে। এর অনেকগুলো কারণ রয়েছে বলে দক্ষিণ কলকাতায় দলের এক প্রবীণ নেতা জানালেন।

ওই নেতা বলেন, যে দল জিতবে বলে সবাই ধরে নেয়, সেই দলের ওপর সব সময় একটা বাড়তি চাপ থাকে। কিছুটা অকল্পনীয়ভাবে নন্দীগ্রামে তৃণমূল নেত্রী হেরে গিয়েছিলেন, আর তাতেও চাপ বেড়েছে অনেকটাই। এ ছাড়া মমতাকে এখন শুধু রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী নয়, দেশের প্রথম সারির নেতাদের মধ্যে প্রথম বলে প্রচার করা হচ্ছে। এই অবস্থায় ছয় মাসের মধ্যে দুবার হেরে গেলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সর্বভারতীয় ভাবমূর্তি ভালো রকম ধাক্কা খাবে।

তবে ভবানীপুরে হেরে গেলেও মমতা যে বিরাট বিপদে পড়বেন তা নয়, কারণ, রাজ্যের আরও চারটি বিধানসভা কেন্দ্রে আগামী ৩০ অক্টোবর উপনির্বাচন ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন। ভবানীপুরে হেরে গেলে তার একটি থেকে লড়তে পারেন মমতা। তবে সে ক্ষেত্রে তাঁর প্রধান প্রতিপক্ষ বিজেপি যে মমতা ও তৃণমূলের বিরুদ্ধে অনেক বেশি আক্রমণাত্মক প্রচার করার সুযোগ পেয়ে যাবে, তা বলাই বাহুল্য।

বস্তুত ভবানীপুরে বিজেপির কম বয়সী প্রার্থী প্রিয়াঙ্কা টিব্রেওয়াল বেশ আক্রমণাত্মক প্রচার করেছেন। বিজেপির প্রথম সারির নেতা-মন্ত্রীরা দিল্লি থেকে না এলেও, মাঝারি মাপের নেতা-নেত্রীদের দিল্লি থেকে এনেছে বিজেপি। আর তাঁদের নিয়ে সারাক্ষণ ভবানীপুরে মাটি কামড়ে পড়ে থেকে প্রচার চালিয়েছেন প্রিয়াঙ্কা। কোনো সময়ে তাঁরা এক মৃত বিজেপি কর্মীর দেহ নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর বাসার কাছে বিক্ষোভ দেখাতে গিয়ে পুলিশের হাতে মার খেয়েছেন, আবার কখনো–বা দলের সাবেক রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষের নেতৃত্বে এলাকায় প্রচার চালানোর সময় তৃণমূল কর্মীদের সঙ্গে বিজেপির কর্মীদের ভালো রকম মারপিট হয়েছে। এসবই প্রচার পেয়েছে। ফলে প্রিয়াঙ্কার প্রচার যে খুব খারাপ হয়েছে এমনটা বলা যাবে না। এসব কারণেই এই লড়াইয়ে তাদের একটা ভালো সম্ভাবনা রয়েছে বলে বিজেপির রাজ্যস্তরের নেতৃত্ব মনে করছে।

তারপরও বিজেপির সম্ভাবনা কম। এলাকার প্রায় ১৭০ বুথে তৃণমূল কংগ্রেস সংগঠনকে বিরাটভাবে মাঠে নামিয়েছে। নিশ্চিতভাবেই তৃণমূলের যাঁরা ভোটার, তাঁদের বাড়ি থেকে আনা, ভোট দেওয়ানো এবং তারপর বাড়ি পৌঁছানোর দিকে নজর রেখেছেন দলের শীর্ষ নেতৃত্ব। বিশেষ করে দুই দিন ধরে লাগাতার বৃষ্টির কারণে যাতে ভোটারের সংখ্যা কমে না যায়, সেদিকে বিশেষভাবে নজর রাখছে তৃণমূল। পৃথকভাবে নির্বাচন কমিশনও নৌকার বন্দোবস্ত করেছে ভোটারদের বাড়ি থেকে এনে ভোট দেওয়ানোর জন্য।

তৃণমূলের এই কর্মকাণ্ডের মাথায় রয়েছেন দলের মন্ত্রী ও কলকাতা পুরসভার মুখ্য প্রশাসক ফিরহাদ হাকিম। তাঁর ওপর রয়েছেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তারও ওপরে দলের সভানেত্রী। মমতার ভোট-কৌশলী প্রশান্ত কিশোর বিহারের মানুষ হলেও ভবানীপুরে ভোটার হিসেবে নাম নথিভুক্ত করেছেন। অতএব আজ মাঠে থাকছেন তিনিও। ভবানীপুর বিধানসভা কেন্দ্রে কলকাতা পৌরসভার আটটি ওয়ার্ড রয়েছে, এর প্রতিটির দায়িত্বে রয়েছেন একজন জ্যেষ্ঠ নেতা। তাঁর নিচে অসংখ্য নেতা, সাধারণ কর্মী। বিজেপির পক্ষে এত লোক জোগাড় করা যে অসম্ভব, দলের নেতারা ব্যক্তিগত স্তরে তা স্বীকার করছেন।

এই বিরাট লোকবল থাকার কারণে তৃণমূল যাতে নিয়মবহির্ভূতভাবে কোনো কাজ করতে না পারে, তা দেখার জন্য ১৫ কোম্পানি (প্রায় ২০০০) আধা সামরিক বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে।

প্রতিটি ভোটকেন্দ্রের ২০০ মিটারের মধ্যে ভারতীয় ফৌজদারি দণ্ডবিধির ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে, যার অর্থ পাঁচজনের বেশি জমায়েত হতে দেওয়া হবে না। সিপিআইএম (কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া মার্ক্সিস্ট) দলের অল্পবয়স্ক আইনজীবী শ্রীজীব বিশ্বাস প্রার্থী হয়েছেন। তিনিও মোটামুটি বেশ ভালোই প্রচার করেছেন।

আজ মুর্শিদাবাদের জঙ্গিপুর ও সামশেরগঞ্জেও ভোট হবে। তবে এই দুই আসনে তৃণমূল কংগ্রেসের জয় প্রায় শতভাগ নিশ্চিত। এই পর্যায়ের এক মাস পর ৩০ অক্টোবর কোচবিহার জেলার দিনহাটা, নদীয়ার শান্তিপুর, উত্তর ২৪ পরগনার খড়দহ ও দক্ষিণ ২৪ পরগনার গোসাবা কেন্দ্রে উপনির্বাচন হবে বলে নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে।