মিষ্টি নিয়ে সাহিত্যের উৎসব হবে কলকাতায়

আগামী ডিসেম্বরে অনুষ্ঠেয় মিষ্টির সাহিত্য উৎসব উপলক্ষে সাংবাদিক সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন অভিনেত্রী মুনমুন সেন, অভিনেতা প্রসেনজিৎসহ একাধিক নামী তারকাছবি: ভাস্কর মুখার্জি

এ এক অভিনব সাহিত্য উৎসব। গল্প, কবিতা বা উপন্যাস নিয়ে নয়, সাহিত্য উৎসব মিষ্টি নিয়ে। কোনো দিন এ ধরনের সাহিত্য উৎসব হয়নি কলকাতায়। ভারতের কোথাও হয়েছে, তেমনটাও জানা যায়নি। মিষ্টি সাহিত্য উৎসবের আয়োজন করছে কলকাতার প্রখ্যাত মিষ্টি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান যুগল’স। আগাম ৯ ডিসেম্বর থেকে এই উৎসব শুরু হবে কলকাতার ১০টি এলাকায়। চলবে ১১ ডিসেম্বর পর্যন্ত।

এ উৎসবে যেমন দেখা যাবে অভিনব মিষ্টির সমাহার, সেই সঙ্গে কলকাতাসহ গোটা বিশ্বের মিষ্টির এক ইতিহাস। কীভাবে কলকাতাসহ বিভিন্ন দেশের মিষ্টি তৈরি হলো বা হচ্ছে, সেসব ইতিহাস তুলে ধরা হবে এই উৎসবে। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যসহ বিশ্বের আরও কিছু দেশ এই উৎসবে যোগ দেবে। কলকাতাবাসীও জানতে পারবে সেসব মিষ্টি এবং মিষ্টির ইতিহাস।

কলকাতার বিভিন্ন মিষ্টি আজও ভারতের সেরা মিষ্টি হিসেবে পরিচিত। কারণ, ভারতের সবচেয়ে বেশি মিষ্টি খায় বাঙালিরা । ফলে বাঙালি–অধ্যুষিত শহর কলকাতায় গড়ে উঠেছে নানা মিষ্টির নানা প্রতিষ্ঠান।

রসগোল্লা কলকাতার একান্ত নিজেদের সৃষ্টি। রসগোল্লা ছাড়া দানাদার, কাঁচাগোল্লা, মণ্ডা, জিলিপিরও আলাদা ইতিহাস রয়েছে। তাই যুগল’স এই প্রথম এগিয়ে এসে এই কলকাতা শহরে তিন দিনব্যাপী আয়োজন করতে চলেছে ‘মিষ্টি সাহিত্য উৎসব’। অর্থাৎ এই মিষ্টির ইতিহাস নিয়ে যেসব সাহিত্য আছে, তা নিয়ে এবার আয়োজন করা হচ্ছে এই মিষ্টি সাহিত্য উৎসবের।

অভিনেত্রী রাইমা সেনকে মিষ্টি খাওয়াচ্ছেন প্রসেনজিৎ
ছবি: ভাস্কর মুখার্জি

যুগল’সের কর্ণধার লহনা ঘোষ গতকাল বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেছেন, রসগোল্লার আগে ছিল গোপাল গোল্লা। সেই গোপাল গোল্লাকে ১৮৬৮ সালে নবীন চন্দ্র দাস রূপ দিয়েছেন রসগোল্লায়। এর জন্ম বাংলাতেই। ওডিশাও একই দাবি করলেও ধোপে টেকেনি বাংলার রসগোল্লার কাছে। প্রতিষ্ঠিত হয়েছে রসগোল্লার ইতিহাসের সঙ্গে নবীনচন্দ্র দাসের নাম। আবার যেমন লেডিক্যানির নাম হয়েছে ভারতের প্রথম গভর্নর জেনারেল লর্ড ক্যানিংয়ের সহধর্মিণী শার্লট ক্যানিংকে নিয়ে। তখন লেডি ক্যানিংয়ের দারুণ পছন্দ ছিল এই মিষ্টি। এরপরই এই মিষ্টির নাম হয়ে লেডিকেনি । আর সন্দেশের ইতিহাস পাওয়া যায় দক্ষিণেশ্বর কালীমাতা মন্দিরের উদ্বোধনের সময়। তখন রানিমাতা রাশমণি মিষ্টি বানিয়ে মায়ের ভোগ দিতেন। ওই মিষ্টির মধ্যে অন্যতম ছিল সন্দেশ। সেখান থেকে শুরু হয় সন্দেশের নাম।

লহনা ঘোষের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ১৯৩০ সালে কালী ঘোষ প্রথম তৈরি করেছিলেন দই। নাটোরের বিখ্যাত কাঁচাগোল্লা ও চম চম প্রথম তৈরি করেছিলেন ধীরেন সরকার ও কালীপদ দত্ত। সাদা বোঁদে প্রথম তৈরি হয়েছিল হুগলির কামারপুকুরে রামকৃষ্ণ দেবের জন্মভিটায় মা কালীর মন্দিরে ভোগ দেওয়ার জন্য। রাবড়ি প্রথম তৈরি করেছিলেন করাচির হনুমান হালুইকর। সত্যজিৎ রয়ের সবচেয়ে বেশি পছন্দের তালিকায় ছিল এই রাবড়ি।

মিষ্টির ইতিহাস তুলে ধরে যুগল’সের তথ্য, ত্রয়োদশ শতকে প্রথম জিলাপি তৈরি হয়েছিল মিসরে। তৈরি করেছিলেন মহম্মদ বিন হাসান আল বাগদাদি। রসমালাই প্রথম তৈরি হয়েছিল বাংলাদেশের কুমিল্লায়। আবার ছানাবড়ার প্রচণ্ড ভক্ত ছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। ১৮৮২ সালে মণ্ডা তৈরি করেছিলেন বাংলাদেশের ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার রামগোপাল পাল। মণ্ডার প্রচণ্ড ভক্ত ছিলেন ওস্তাদ আলউদ্দিন খাঁ, ডা. বিধানচন্দ্র রায়। আরও পছন্দ ছিল স্তালিন, আইয়ুব খান, মা সে–তুং, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবেরও। আবার বরফি খুব পছন্দ ছিল কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের।

মধ্যযুগে মঙ্গলকাব্যে এসব মিষ্টির কথা উল্লেখ আছে। সেসব ইতিহাসসহ অতীতের নানা ইতিহাস খুঁজে বের করে এবার কলকাতায় আয়োজন করা হচ্ছে মিষ্টি সাহিত্য উৎসবের।

অভিনেতা শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়ের মুখে মিষ্টি তুলে দিচ্ছেন প্রসেনজিৎ
ছবি: ভাস্কর মুখার্জি

আর এসব নিয়ে যুগল’স সম্প্রতি কলকাতার আর্ট গ্যালারিতে আয়োজন করে এক সাংবাদিক সম্মেলনের। সেই বৈঠকে যোগ দিয়েছিলেন চলচ্চিত্র অঙ্গনের একঝাঁক তারকা। এঁদের মধ্যে ছিলেন অভিনেত্রী মুনমুন সেন, প্রসেনজিৎ, শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়, রাইমা সেন, পরিচালক অনীক দত্ত, অরিন্দম শীল, সংগীতশিল্পী অনুপম রায়, মধু নেওটিয়া প্রমুখ।

লহনা ঘোষ বললেন, এই মিষ্টি সাহিত্য উৎসবে আরও যোগ দেবেন বাংলাদেশ, মিসর, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের মিষ্টি ব্যবসায়ীরা। তাঁরাও সেই দেশের সাহিত্যে মিষ্টির ইতিহাস তুলে ধরবেন। থাকবেন হলিউডের প্রখ্যাত শেফ আসমা সাইদ খান, কানাডার প্রখ্যাত নৃতাত্ত্বিক ও লেখক কলিন টেইলর, ইতিহাসবিদ পুষ্পেশ পান্থ, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কুণাল বসুসহ কলকাতার বিশিষ্টজনেরা।