রাজ্যের দাবিতে কেএলওর তৎপরতা বাড়ছে পশ্চিমবঙ্গে
করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ার পর সপ্তাহ তিনেক আগে মারা গেছেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের উত্তর প্রান্তে রাজবংশী জাতিগোষ্ঠীর জন্য পৃথক রাজ্যের আন্দোলনের নেতা অতুল রায়। তিনি অবশ্য দীর্ঘদিন আগেই পৃথক রাজ্যের আন্দোলন থেকে সরে এসেছিলেন, যুক্ত ছিলেন রাজ্য সরকারের বিভিন্ন কাজকর্মের সঙ্গে। কিন্তু নয়ের দশকের মাঝামাঝি রাজবংশীদের পৃথক কামতাপুর রাজ্যের যে স্বপ্ন তিনি দেখিয়েছিলেন, সেই স্বপ্ন শেষ হয়ে যায়নি। সম্প্রতি কামতাপুর লিবারেশন অর্গানাইজেশনের (কেএলও) কর্মকাণ্ডে তা স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
বস্তুত গত এক মাসে দুটি ভিডিও বার্তা প্রচার করেছেন সশস্ত্র ও নিষিদ্ধ সংগঠন কেএলওর চেয়ারম্যান তামির দাস ওরফে জীবন সিংহ। কেএলওর লক্ষ্য, রাজবংশী সম্প্রদায়ের জন্য স্বাধীন কামতাপুর রাজ্য। দীর্ঘ সময় পরে তাদের কাজকর্ম যে উত্তরবঙ্গে খানিকটা বেড়েছে, কেএলওর সাম্প্রতিক বিবৃতিই তার প্রমাণ।
জুন মাসের শেষের দিকে তৃণমূল কংগ্রেসের কোচবিহার জেলার সভাপতি পার্থপ্রতিম রায় ও সাবেক জেলা সভাপতি বিনয়কৃষ্ণ বর্মণকে হুমকি দিয়েছে কেএলও। এক বিবৃতিতে কেএলওর প্রচারসচিব বলেছেন, যদি উত্তরবঙ্গের রাজবংশী নেতারা ‘দল দাসে পরিণত হয়ে ঔপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠীকে তেলমর্দন করে জাতিবিরোধী কাজে লিপ্ত হয় তাহলে জাতির হয়ে আমরা চরম শাস্তির ব্যবস্থা করতে বাধ্য হব।’ উত্তরবঙ্গের এক নিরাপত্তা আধিকারিক বলেন, এই ধরনের ভাষা ব্যবহার করে রাজনৈতিক নেতৃত্বকে হুমকি দেওয়ার ঘটনা অনেক দিন পরে ঘটল। তৃণমূল নেতৃত্ব জানিয়েছেন, এই হুমকিতে তাঁরা ভীত নন।
এই হুমকির ঠিক আগে জুন মাসে কেএলওর চেয়ারম্যান জীবন সিংহ দুটি ভিডিও বার্তা প্রকাশ করেন। মূলত তৃণমূলকে আক্রমণ করে তিনি বলেন, সরকার ‘জাতি বৈষম্যের রাজনীতি করছে’ এবং মিথ্যা মামলা দিয়ে, অত্যাচার করে রাজবংশীদের আন্দোলন রোখার চেষ্টা করছে। তৃণমূলের রাজবংশী এমপি এবং এমএলএদেরও তিনি সাবধান করে দিয়েছেন। সিংহ বলেন, ‘জাতিগত শোষণ চললে আমরা জাতিগতভাবে এর মোকাবিলা করব।’ একটি ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে তাঁকে ঘিরে রয়েছেন বেশ কয়েকজন সামরিক পোশাক পরা যুবক, তাঁদের হাতে রয়েছে ভারতে নির্মিত আধা স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্র ইনশাস এবং জঙ্গিদের প্রিয় একে-৪৭।
অপর একটি ভিডিওতে জীবন সিংহ ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) সমালোচনা করে বলেন, লোকসভা (২০১৯) নির্বাচনে আসাম ও পশ্চিমবঙ্গের রাজবংশীরা বিজেপিকে ভোট দিয়েছিল। কিন্তু সংবিধানের তফসিলের আওতায় এনে কামতাপুরী ভাষাকে একটি আনুষ্ঠানিক ভাষার স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। তিনি বলেন, ‘ভারতে মোট ২২টি ভাষাকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আমাদের দেওয়া হয়নি। পাঞ্জাবিদের পাঞ্জাব, উড়িয়াদের উড়িষ্যা, বাঙালিদের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য থাকলেও কামতাপুরী ভাষার মানুষের কোনো রাজ্য নেই।’ উল্লেখ্য, একই সময়ে উত্তরবঙ্গে বিজেপির এমপি জন বারলাও পৃথক রাজ্যের দাবি তোলেন। যদিও কলকাতায় বিজেপির রাজ্য নেতৃত্ব বলেছেন, এই দাবির সঙ্গে তাঁদের কোনো সম্পর্ক নেই।
এদিকে গত রোববার জলপাইগুড়ি জেলার নাগরাকাটায় বারলার বাড়িতে গিয়ে দেখা করেছেন পৃথক রাজ্যের সমর্থক উত্তরবঙ্গের স্থানীয় সাতটি রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা। এই দলগুলোর মধ্যে রয়েছে কামতাপুর পিপলস পার্টি, কামতাপুর ডেমোক্রেটিক পার্টি, কামতাপুর প্রগ্রেসিভ পার্টি, গ্রেটার কোচবিহার ডেমোক্রেটিক পার্টি।
বারলা অস্বীকার করেননি যে তিনি এখনো পৃথক রাজ্যের দাবিতে সক্রিয়। উত্তরবঙ্গে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘রাজ্যের কাছ থেকে নয়, আমি সংবিধানসম্মতভাবে কেন্দ্রের কাছে আলাদা উত্তরবঙ্গ রাজ্যের দাবি করছি। বহু মানুষের আকাঙ্ক্ষাকে তুলে ধরছি মাত্র। রাস্তায় নেমে কোনো আন্দোলন হয়নি। কিন্তু তা সত্ত্বেও ব্যাপক জনসমর্থন মিলছে। এই বিষয়ে আমি দিল্লিতে গিয়ে কথাবার্তা বলব।’ কামতাপুরের সমর্থকেরা বলেছেন, যেহেতু তাঁদের দাবি নিয়ে নতুন করে কথাবার্তা শুরু হয়েছে, তাই পৃথক রাজ্যের দাবিকে জোরদার করাই এখন তাঁদের লক্ষ্য। কামতাপুর রাজ্যের দাবিদারদের প্রধান বক্তব্য, রাজবংশীরা ও উত্তরবঙ্গ নানা ক্ষেত্রে বঞ্চিত। সেই বঞ্চনা শেষ হয়নি।
উত্তরবঙ্গে বসবাসকারী রাজবংশীদের বলা হয় কোচ। কোচদের মাতৃভাষা বাংলা নয়, কামতাপুরী। বাংলাদেশের উত্তর অংশের তিনটি জেলা (দিনাজপুর, ময়মনসিংহ, রংপুর), নেপালের ঝাপা, মরাং ছাড়াও ভুটান ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে রয়েছে কোচ রাজবংশীরা। রয়েছে পূর্ব ভারতের বিহারেও। তবে সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় রয়েছে আসামের চার ও পশ্চিমবঙ্গের উত্তরাঞ্চলের অন্তত আটটি জেলায়। রয়েছে দক্ষিণবঙ্গেও। মূলত কোচবিহার, আলিপুরদুয়ার, জলপাইগুড়ি ও দুই দিনাজপুরে কোচ-রাজবংশীদের সংখ্যা বেশি। ২০০১-এর আদমশুমারি মোতাবেক এই সংখ্যা প্রায় ৩৪ লাখ, যা তফসিলি জাতিভুক্ত গোষ্ঠীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি, ১৮ শতাংশ। হিমালয়ের পাদদেশে বিরাটসংখ্যক রাজবংশী থাকার কারণে একসময় তারা আলাদা রাষ্ট্রের দাবি করেছিল, বর্তমানে তা রাজ্যের দাবিতে সীমাবদ্ধ।
উত্তরবঙ্গে রাজবংশীদের এক নেতা বংশীবদন বর্মণ, যিনি বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতাসীন দল তৃণমূলের ঘনিষ্ঠ, অতীতে এই প্রতিবেদককে বলেছেন, উত্তরবঙ্গে কামতাপুরী ভাষা আন্দোলন এবং রাজ্যের দাবি তখনই মাথাচাড়া দেয়, যখন কেন্দ্রের সঙ্গে রাজ্যের নানা বিষয়ে মতবিরোধ দেখা দেয়।
আট ও নয়ের দশকে যখন কেন্দ্রের কংগ্রেস সরকারের সঙ্গে রাজ্যের বামফ্রন্ট সরকারের নানা বিষয়ে মতবিরোধ হতো, সেই সময়ই জন্ম কেএলওর। হাতে গোনা কিছু ছেলেকে নিয়ে এই আন্দোলন শুরু হলেও তা বড় আকার ধারণ করে। একটা সময় কেএলওর সশস্ত্র সদস্যসংখ্যা ৩০০-এর ওপরে চলে যায়। এই আন্দোলন বামফ্রন্ট সরকারকে ভালো রকম চিন্তায় ফেলেছিল বলে মন্তব্য করেছেন সেই সময়ের রাজ্য পুলিশের এক আধিকারিক। তিনি বলেন, এই মুহূর্তে কেএলওর পক্ষে মাথা তোলা মুশকিল।
নয়ের দশকে জঙ্গি আন্দোলন নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা ছিল পুলিশের এই আধিকারিকের। প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক ওই আধিকারিক বলেন, ‘আট–এর দশকের শেষে ও নয়ের দশকের গোড়ায় ভারতবর্ষে নানা ধরনের বড়মাপের জঙ্গি আন্দোলন মাথা চাড়া দিয়েছিল। যেমন কাশ্মীরে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন বা তার কিছু আগে পাঞ্জাবে খালিস্তানি মুভমেন্ট ইত্যাদি। পূর্ব ভারতে আসামের জঙ্গিগোষ্ঠী বা উলফার (ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অব আসাম) উত্থান হয়েছিল। দার্জিলিংয়ে গোর্খাল্যান্ডের সামাজিক-রাজনৈতিক আন্দোলনটিও গড়ে উঠেছিল। আন্দোলনগুলো পরস্পরকে প্রভাবিত করেছিল, সাহায্যও করেছিল। সেটাই সাধারণত হয়। উলফার সঙ্গে যোগাযোগ ছিল কেএলওর, তারা সাহায্যও পেয়েছিল। আর উলফা টিকে ছিল, কারণ তারা প্রতিবেশী দেশে শিবির স্থাপন করতে পেরেছিল। সেই আশঙ্কা এখন কম, কারণ প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক ভালো। অন্য যে জঙ্গিগোষ্ঠীগুলো কেএলও-কে সাহায্য করত তারা অধিকাংশই আর সক্রিয় নয়, যেমন ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অব বোড়োল্যান্ড।’
তবে নাগাল্যান্ডের শক্তিশালী ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট কাউন্সিল অব নাগাল্যান্ডের (এনএসসিএনআই-এম) সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকারের কথাবার্তা বিশেষ এগোয়নি, তারা এখনো বেশ সক্রিয়। কেন্দ্রের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের অবনতি হলে কেএলও শক্তিশালী হতে পারে বলে অনেকে মনে করছেন। তবে এখনো এনএসসিএন আলোচনার মধ্যেই আছে। অতীতে কেন্দ্র ও রাজ্যের সম্পর্কে অবনতির সঙ্গে সঙ্গে এই ধরনের গোষ্ঠী মাথাচাড়া দিয়েছে। বর্তমানে কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক তলানিতে। এই অবস্থার সুযোগ কেএলও নিতে পারে কি না, সেটাই দেখার।