৪ বছর বয়সে ধর্ষণের শিকার মঞ্জুলাই এখন অন্যদের শক্তি

দলিত সম্প্রদায়ের ধর্ষণের শিকার নারীদের হয়ে লড়ছেন মঞ্জুলা প্রদীপ
ছবি: বিবিসির সৌজন্যে

৪৮ বছর আগের কথা। মঞ্জুলা প্রদীপের বয়স তখন চার বছর। সেদিন হলুদ রঙের একটা ফ্রক পরেছিলেন। হয়তো হলুদ প্রজাপতির মতোই উড়ে বেড়াচ্ছিলেন। হঠাৎ তাঁর ওপর পড়ে কালো ছায়া। চারজন পুরুষের ধর্ষণের শিকার হন মঞ্জুলা।

এরপর জীবনটা বদলে যায় মঞ্জুলার। তিনি সব সময়ই ভয় পেতেন। অপরিচিত কাউকে দেখলে ভয়ে কুঁকড়ে যেতেন। বাইরের কেউ বাসায় এলে ভয় পেতেন। ভয়ংকর এ ঘটনার কথা বাড়ির কাউকে বলতেও পারেননি মঞ্জুলা। কারণ, পরিবারেও ছিল অশান্তি। দলিত সম্প্রদায়ের হওয়ায় এমনিতেই মঞ্জুলার পরিবার ছিল সামাজিকভাবে নির্যাতিত। বর্ণবৈষম্যের শিকার। সমাজ ও উচ্চবর্ণের হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছে তারা ছিল অচ্ছুত। মঞ্জুলার বাবা তাঁর মায়ের চেয়ে বয়সে অনেক বড় ছিলেন। কোনো ভাই না থাকায় প্রায়ই অশান্তি লেগে থাকত মা-বাবার মধ্যে।

মঞ্জুলাকে মারধর করতেন তাঁর মা। তাঁকে কুৎসিত বলতেন। এসবের মধ্যেই দিন কেটে যাচ্ছিল। ভারতের উত্তর প্রদেশ থেকে কর্মসূত্রে গুজরাটে বদলি হয়ে যান মঞ্জুলার বাবা। পরিবেশ বদলের সঙ্গে সঙ্গে মঞ্জুলার মনোজগতেও বদল আসে। দলিত হিসেবে বৈষম্যের শিকার হওয়ার কারণে এতটাই ক্ষুব্ধ ছিলেন যে মঞ্জুলা নিজের নামের উপাধি বাদ দেন, যাতে কেউ বুঝতে না পারে যে তিনি দলিত সম্প্রদায়ের। তবে নাম মুছে ফেললেও অবহেলা আর নির্যাতন থেকে পরিত্রাণ মেলেনি।
তখন মঞ্জুলার বয়স নয় বছর। স্কুলে পরিচ্ছন্নতার ভিত্তিতে শিক্ষার্থীদের পুরস্কার দেওয়া হচ্ছিল। যথেষ্ট পরিপাটি হয়ে আসার পরও মঞ্জুলার অবস্থান হয় সবার শেষে। কারণ, তিনি দলিত।

দলিত সম্প্রদায়ের ধর্ষণের শিকার নারীদের হয়ে লড়ছেন মঞ্জুলা প্রদীপ
ছবি: বিবিসির সৌজন্যে

বঞ্চনা ও বৈষম্যের সঙ্গে লড়াই করতে করতেই মঞ্জুলা বড় হতে থাকেন। পড়াশোনা শুরু করেন সমাজকর্ম ও আইন বিষয়ে। যুক্ত হন দলিতদের অধিকার রক্ষায় গঠিত সংগঠন নভসারজেনের সঙ্গে। সেখানে তিনিই ছিলেন একমাত্র নারী সদস্য। ১৯৯২ সালের দিকে গ্রামে গ্রামে ঘুরতে শুরু করেন মঞ্জুলা। উদ্দেশ্য ছিল দলিত সম্প্রদায়ের নিপীড়িত নারীদের পাশে দাঁড়ানো।

এক দশক পরে নির্বাচনে জয়ী হয়ে সংগঠনের অন্য সব পুরুষকে পরাজিত করে মঞ্জুলা চেয়ারপারসন নির্বাচিত হন। মঞ্জুলা বলেন, ‘একজন দলিত নারীর এত উচ্চ অবস্থানে যাওয়ার ঘটনা খুব বেশি ঘটে না। আমি নির্বাচনে চারজন পুরুষকে পরাজিত করেছি। আমি এখন সংগঠনের নেতৃত্ব দিই। নারী ও পুরুষের সঙ্গে কাজ করি।’

মঞ্জুলা ধর্ষণের শিকার ৫০ জনের বেশি নারীকে সহায়তা দিচ্ছেন এবং তাঁদের নিয়ে কাজ করছেন। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি ঘটনায় অপরাধী সাজাও পেয়েছেন।


নির্যাতনের শিকার দলিত নারীদের নিয়ে কাজ করতে করতে আত্মবিশ্বাস ফিরেছে মঞ্জুলার। তিনি বলেন, দলিত নারীদের তথ্য জানানো এবং প্রশিক্ষণ দেওয়াটা খুবই জরুরি। মঞ্জুলা আরও বলেন, ‘আমি চাই না আরেকজন মঞ্জুলা আসুক। আমি চাই এই নারীরা আমার ছায়ায় নয়, নিজের পরিচয়ে পরিচিত হোক।’

আর মঞ্জুলা যে তা করতে পেরেছেন, তা বোঝা যায় ভারতের পশ্চিমাঞ্চলের রাজ্য গুজরাটের ছোট একটি শহরের বাসিন্দা ভাবনা নারকারের কথায়। ২৮ বছরের ওই নারী বলেন, মঞ্জুলার কথা শোনার পর মনে হয়েছিল, তাঁর কাছে বন্দুক আছে, গুলি নেই। আর সে গুলিটাই মঞ্জুলা।

আমি চাই না আরেকজন মঞ্জুলা আসুক। আমি চাই এই নারীরা আমার ছায়ায় নয়, নিজের পরিচয়ে পরিচিত হোক।
মঞ্জুলা প্রদীপ

ভারতের নারীদের মধ্যে ১৬ শতাংশ এসেছেন দলিত সম্প্রদায় থেকে। তাঁদের ওপর ধর্ষণসহ বিভিন্ন নিপীড়ন চালিয়েছে উচ্চবর্ণের হিন্দুরা।

সরকারি তথ্য বলছে, দলিত নারীদের ওপর ধর্ষণের ঘটনা ২০১৪ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ৫০ শতাংশ বেড়েছে। তবে বিভিন্ন গবেষণা ও জরিপ বলছে, দলিত নারীদের ওপর ধর্ষণের বেশির ভাগ ঘটনাই আসলে জানানো হয় না। পরিবারের সহযোগিতার অভাব ও পুলিশের অসহযোগিতার কারণে অনেক সময় ধর্ষণের শিকার নারী আইনি পদক্ষেপ নিতে পারেন না। প্রভাবশালী উচ্চবর্ণের হিন্দুরাও এ ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।


আর ধর্ষণের শিকার এসব নারীর হয়েই ৩০ বছর ধরে লড়ছেন মঞ্জুলা প্রদীপ। তিনি ন্যাশনাল কাউন্সিল ফর উইমেন লিডারসের সহপ্রতিষ্ঠাতা হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন। মঞ্জুলা বলেন, দলিত সম্প্রদায়ের নারীদের উন্নয়নে কাজ করা ছিল তাঁর দীর্ঘদিনের স্বপ্ন। তিনি আরও বলেন, করোনাভাইরাস মহামারির সময় যৌন সহিংসতার ঘটনাগুলো তিনি নথিভুক্ত করেছেন। যৌন সহিংসতার শিকার নারীদের উন্নয়নে কাজ করার এখনই সময়।

শুধু বক্তব্য দিয়েই গ্রামের নারীদের উদ্দীপ্ত করেননি মঞ্জুলা প্রদীপ; তিনি দলিত নারীদের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। অনেক সময় বিচার চাইতে গিয়ে আদালতেও দলিত একজন নারীকে অবমাননা সহ্য করতে হয়। বিচারক প্রশ্ন ছুড়ে দেন, কেন উচ্চবর্ণের কেউ তাঁকে ধর্ষণ করতে চাইবে? তিনি তো অচ্ছুত। অনেকে বলতে চান প্ররোচিত করার কারণে তিনি ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। এসব কারণেই মঞ্জুলা প্রদীপ সংগঠনের মাধ্যমে কাজ করার কথা ভাবেন। তিনি স্থানীয় দলিত অধিকার সংস্থা গড়ে তোলেন।

প্রশিক্ষণ চলাকালে মঞ্জুলা প্রদীপ ধর্ষণের শিকার নারীদের প্রথমেই বোঝান পুলিশের কাছে যাওয়াটা কতটা জরুরি। নিজে যৌন হয়রানির শিকার বলেই মঞ্জুলা হয়তো বোঝেন ধর্ষণের ঘটনার বিচার আসলে কতটা জরুরি।