আতিক–আশরাফ হত্যায় কি ‘রাষ্ট্রের’ হাত, প্রশ্ন ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের

আতিক ও তাঁর ভাই আশরাফকে হত্যার আগে গত শনিবার রাতে পুলিশি পাহারায় স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য প্রয়াগরাজে হাসপাতালে নেওয়া হচ্ছিল
ছবি এএনআই

ভারতের সাবেক সংসদ সদস্য ও বিধায়ক আতিক আহমেদ ও তাঁর ভাই সাবেক বিধায়ক আশরাফ আহমেদ হত্যার তদন্তে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়েছে। পাশাপাশি উত্তর প্রদেশ রাজ্য পুলিশ তিন সদস্যের এক বিশেষ তদন্ত দলও গঠন করেছে। সেই দলের তদন্ত ঠিকমতো হচ্ছে কি না, দেখতে গড়া হয়েছে আরও এক উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি। তাতে এই হত্যা রহস্যের কিনারা কতটা হবে, সেই প্রশ্ন ছাপিয়ে উঠে এসেছে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন, যাতে পুলিশের গাফিলতি স্পষ্ট। আর এসব প্রশ্ন থেকেই জন্ম এই জোড়া খুনে ‘রাষ্ট্রের’ হাত ছিল কি না।

প্রশ্নটা উঠছে। কারণ, উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী আদিত্যনাথ একাধিকবার বলেছেন, রাজ্য থেকে ‘গুন্ডা ও মাফিয়ারাজ’ পুরোপুরি খতম করে দেবেন। ইতিমধ্যেই তাঁর রাজত্বে শতাধিক এ ধরনের খুনের ঘটনা ঘটেছে। রাজ্য পুলিশের রেকর্ড বলছে, ২০১৭ সাল থেকে আদিত্যনাথের রাজত্বে মোট ১০ হাজার ৯০০টি ‘এনকাউন্টার’–এর ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় ১৮৩ ‘অপরাধী’ নিহত হয়েছেন বলে সম্প্রতি পিটিআইকে জানিয়েছেন রাজ্য পুলিশের স্পেশাল ডিরেক্টর জেনারেল (আইনশৃঙ্খলা) প্রশান্ত কুমার। পুলিশের রেকর্ড অনুযায়ী, ১৩ পুলিশ কর্মীও নিহত হয়েছেন। ৫ হাজার ৪৬ জন আহত হয়েছেন। ২৩ হাজার ৩০০ ‘অপরাধীকে’ গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টকে এই বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে ইতিমধ্যেই আরজি জানানো হয়েছে।

আতিক–আশরাফ হত্যা তদন্তে রাজ্য সরকার গতকাল রোববারই এলাহাবাদ হাইকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি অরবিন্দ কুমার ত্রিপাঠির নেতৃত্বে তিন সদস্যের বিচার বিভাগীয় কমিটি করেছে। কমিটির অন্য দুই সদস্য হলেন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি ব্রিজেশ কুমার সোনি ও রাজ্য পুলিশের সাবেক মহাপরিচালক সুবেশ কুমার সিং। বিচার বিভাগীয় এই তদন্তের পাশাপাশি গড়া হয়েছে রাজ্য পুলিশের এক বিশেষ তদন্তকারী দল (সিট)। এর নেতৃত্বে রয়েছেন প্রয়াগরাজ পুলিশ ক্রাইম ব্রাঞ্চের তিন উচ্চপদস্থ কর্তা। নেতৃত্বে অতিরিক্ত ডেপুটি কমিশনার সতীশ চন্দ্র, সহকারী কমিশনার সত্যেন্দ্র তিওয়ারি ও ক্রাইম ব্রাঞ্চের তদন্তকারী অফিসার ওম প্রকাশ। ‘নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে’ এই দলকে ‘বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিতে’ সব দিক খতিয়ে তদন্ত শেষ করতে বলা হয়েছে।

মজার কথা, সিটের তদন্ত তদারকি করতে আবার গড়া হয়েছে এক ‘সুপারভিশন’ দল। এই দলের নেতৃত্বে রয়েছেন রাজ্য পুলিশের মহাপরিচালক আর কে বিশ্বকর্মা। এত কিছুর প্রয়োজনীয়তা কেন এবং এতে কাজের কাজ কতটা হবে, সেই প্রশ্ন রাজনৈতিক মহল ও সামাজিক মাধ্যমে উঠতে শুরু করেছে।

এসব প্রশ্নের মধ্যেই তিন আততায়ী সানি সিং, অরুণ মৌর্য ও লাভলেশ তিওয়ারিকে আজ সোমবার প্রয়াগরাজ নৈনি সেন্ট্রাল জেল থেকে নিরাপত্তার খাতিরে প্রতাপগড় জেলা কারাগারে স্থানান্তর করা হয়েছে। রাজ্য প্রশাসনের সন্দেহ, ওই তিন আততায়ী আক্রান্ত হতে পারেন।

আতিক ও তাঁর ভাই আশরাফকে গুলি করে হত্যায় জড়িত সন্দেহভাজন তিন তরুণ অরুণ মৌর্য্য, সানি সিং ও লাভলেশ তিওয়ারি
এএনআই

প্রশ্ন উঠেছে, নিরাপত্তাই যদি কারণ হয়ে থাকে, তা হলে তিন সন্দেহভাজন খুনিকে কেন একই কারাগারে রাখা হয়েছে? এই প্রশ্নের কোনো উত্তর রাজ্য প্রশাসনে নেই। যেমন নেই অত্যন্ত গুরুতর কিছু প্রশ্নের জবাব। সাবেক কংগ্রেস নেতা কপিল সিব্বাল এক টুইটে সেসব প্রশ্ন তুলে ধরে এই ঘটনাকে ‘আর্ট অব এলিমিনেশন’ বলে কটাক্ষ করেছেন। সামাজিক মাধ্যমও এ নিয়ে সরব।

প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণে দাবি, অকুস্থলে সাংবাদিক সেজে আসা তিন আততায়ীকে পুলিশের গাড়ি থেকেই নামতে দেখা গেছে। এই হত্যাকাণ্ডের ‘প্রকৃত মদদদার’ কারা, তা নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে।

কপিল সিব্বালের প্রথম প্রশ্ন, কেন রাত ১০টায় দুই ভাই আতিক ও আশরাফকে হাসপাতালে স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য আনা হয়? কোনো জরুরি মেডিকেল কারণ ছিল কি? এত ঝুঁকিপূর্ণ দুই অপরাধীকে কেন হাসপাতালের বাইরে গাড়ি থেকে নামানো হলো? গাড়ি কেন হাসপাতালের ভেতরে নিয়ে যাওয়া হলো না? কেন তাঁদের সর্বসমক্ষে হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল? দুই ভাইকে হত্যা করে তিনজনই আত্মসমর্পণ করলেন?

প্রশ্ন তুলেছে সংবাদমাধ্যমও। আতিকের শরীরে নয়টি ও আশরাফের শরীরে পাঁচটি বুলেট ক্ষত পাওয়া গেছে। টানা ২২ সেকেন্ড ধরে মোট ২০টি গুলি চালাল ৩ খুনি, অথচ পুলিশ একটি গুলিও ছুড়ল না কেন? হত্যার পর ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি দিতে দিতে তাঁরা আত্মসমর্পণ করলেন! আতিক ও আশরাফের নিরাপত্তার দায়িত্ব যাঁদের ওপর ছিল, তাঁদের কারও বিরুদ্ধে রাজ্য সরকার এখনো কর্তব্যে গাফিলতির কারণে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি!

পুলিশ ও প্রশাসন সূত্রে জানানো হচ্ছে, খুনের সঙ্গে জড়িত তিন সন্দেহভাজন ব্যক্তিই পুলিশের কাছে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে বলেছেন, আতিক–আশরাফকে খুন করে তাঁরা আরও বড় গ্যাংস্টার হতে চেয়েছিলেন। ভেবেছিলেন, তাঁদের খুন করতে পারলে তাঁরা অপরাধী হিসেবে ‘জাতে’ উঠবেন।