হিন্দুত্বের ব্যাখ্যা দিয়ে কিসের জবাব দিতে চাইলেন রাহুল
হিন্দুধর্ম বলতে কী বোঝায়, বিস্তারিতভাবে সেই ব্যাখ্যা দিলেন কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী। লিখিতভাবে জানালেন, ভয় উপেক্ষা করে সত্যের পথে চলাই প্রকৃত হিন্দুত্ব। যাঁরা তা পারেন, হিন্দু তাঁরাই। প্রকৃত হিন্দুর কর্তব্য দুর্বল ও অসহায়দের রক্ষা করা।
স্বলিখিত এক নিবন্ধে হিন্দুত্বের এই ব্যাখ্যা দেওয়ার পাশাপাশি রাহুল লিখেছেন, জীবনসমুদ্রে মৃত্যুর ভয়, হারানোর ভয়, ক্ষুধার ভয়ের সঙ্গে রয়েছে প্রত্যাখ্যাত ও অপদস্থ হওয়ার ভয়। ভয়কে জয় করে ভেসে থেকে সবার হিতাকাঙ্ক্ষী হওয়াই প্রকৃত হিন্দুর সংজ্ঞা।
কংগ্রেস নেতা লিখেছেন, হিন্দুধর্ম কারও একার নয়। সবার জন্য তার দ্বার উন্মুক্ত। সত্য ও অহিংসার বাণী তুলে ধরা হিন্দুদের কর্তব্য। প্রকৃত হিন্দুর কাছে শত্রুতা নয়, প্রেমই কাম্য। এই ধর্মে আমিত্বের কোনো স্থান নেই। শুধু নিজের ধর্ম নয়, নিজের হিত নয়, সব ধর্ম ও সবার মঙ্গল কামনাই হিন্দুধর্মের শিক্ষা।
রাহুলের এই নিবন্ধ গতকাল রোববার দেশের বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়। ইংরেজিতে লেখা সেই নিবন্ধের শিরোনাম, ‘সত্যম শিবম সুন্দরম’। এই নিবন্ধ তিনি তাঁর ‘এক্স’ হ্যান্ডেল (সাবেক টুইটার) মারফতও প্রচার করেন। মহাত্মা গান্ধীর জন্মদিনের আগের দিন হিন্দুধর্ম সম্পর্কিত নিজের ধ্যানধারণা জানানোর মধ্য দিয়ে রাহুল যেমন বিজেপির ‘হিন্দুত্ববাদের’ সরাসরি বিরোধিতা করলেন, তেমনই মনে করা হচ্ছে এর মধ্য দিয়ে সনাতন ধর্ম নিয়ে গড়ে ওঠা বিতর্কের জবাবও তিনি দিলেন।
তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী ও ডিএমকে নেতা এম কে স্ট্যালিনের ছেলে উদয়নিধি সম্প্রতি সনাতন ধর্ম নিয়ে কিছু মন্তব্য করেন, যার বিরুদ্ধে খড়্গহস্ত হয় বিজেপি। চেন্নাইয়ে প্রগতিশীল লেখক ও শিল্পী সমিতি আয়োজিত এক সভায় ডিএমকে নেতা উদয়নিধি দিন কয়েক আগে বলেছিলেন, মশা, ডেঙ্গু জ্বর, ম্যালেরিয়া, করোনাভাইরাস এসবের বিরোধিতা হয় না। এগুলো নির্মূল করতে হয়। সনাতন ধর্মও তেমন। বিরোধিতা নয়, নির্মূল করা দরকার। কারণ, তা সাম্য ও সামাজিক ন্যায়ের বিরুদ্ধে।
উদয়নিধির ওই মন্তব্যের তীব্র বিরোধিতায় নামে বিজেপি। তারা প্রচার শুরু করে, সনাতন ধর্মকে ডিএমকে মশা–মাছি ম্যালেরিয়া–ডেঙ্গুর সঙ্গে তুলনা করেছে। দেশের ৮০ শতাংশ সনাতন ধর্মাবলম্বীকে নিধন করার নিদান দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে বিজেপির শীর্ষ নেতারা সবাই উদয়নিধির বিরুদ্ধে সরব হন। কংগ্রেস ওই মন্তব্যকে কীভাবে নিচ্ছে, কোন চোখে দেখছে, তা জানানোর দাবি তোলেন।
উদয়নিধির বক্তব্য নিয়ে বিজেপি দ্রুত রাজনীতি শুরু করে, যাতে বিরোধী মহলে ভাঙন ধরিয়ে ‘হিন্দুত্ববাদীদের’ জোটবদ্ধ করা যায়। বিরোধী জোট ‘ইন্ডিয়া’র অন্যতম প্রধান শরিক ডিএমকে। তামিলনাড়ু রাজনীতিতেও তারা কংগ্রেসের শরিক।
বিজেপির তীব্র বিরোধিতা ও দাবি সত্ত্বেও কংগ্রেস ওই বিষয়ে সরাসরি কোনো মন্তব্য করেনি। দলের সাধারণ সম্পাদক কে সি বেনুগোপাল শুধু বলেছিলেন, কংগ্রেস সর্বধর্মে সমভাবে বিশ্বাসী। এটাই কংগ্রেসের চিন্তাধারা। তবে সব দলেরই স্বাধীন চিন্তাধারার স্বাধীনতা আছে। তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কারও নাম না করে বলেছিলেন, অন্যের ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত লাগে, এমন মন্তব্য করা উচিত নয়।
বিজেপির আক্রমণের মুখে উদয়নিধি অবশ্য বলেছিলেন, সনাতন ধর্মাবলম্বীদের গণহত্যার নিদান তিনি কখনো দেননি। বলেছিলেন, সনাতন এমন এক ভাবধারা, যা জাতি–ধর্ম–বর্ণ বিচারে সমাজকে বিভাজিত করেছে। সেই ভাবধারা নির্মূল করতে হবে। সে বিষয়ে যা বলেছেন তা থেকে তিনি যে পিছু হটছেন না, সে কথাও জানাতে ভোলেননি।
তামিলনাড়ুর দ্রাবিড়ীয় রাজনীতির মূলে রয়েছে আর্যাবর্ত, অর্থাৎ উত্তর ভারতের গোবলয়ের ব্রাহ্মণ্যবাদ, হিন্দিবিরোধী নিরীশ্বরবাদী আন্দোলন। এই আন্দোলনই জন্ম দেয় ডিএমকে দলের।
রাহুলের নিবন্ধ ওই বিতর্কের পরিপ্রেক্ষিতে তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে। দলের মুখপাত্র জয়রাম রমেশ ওই নিবন্ধকে ‘চিন্তাভাবনার খোরাক’ বলে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন, এই ভাবনা তিনিই দিতে পারেন, যাঁর প্রকৃত সত্তার পরিচয় দেশবাসী চার হাজার কিলোমিটার পথচলার সময় পেয়েছে।
যদিও বিজেপির দৃষ্টিতে কংগ্রেস নিছকই ‘ভোট হিন্দু’ দল। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অনুরাগ ঠাকুর বলেছেন, ‘হিন্দুত্ব আমাদের সম্প্রীতি ও সর্বজন হিতের কথা শিখিয়েছে। হিন্দুধর্ম নিয়ে দীর্ঘ নিবন্ধ লেখা সহজ, কিন্তু হিন্দুত্বের আধারে জীবন পরিচালনা সহজ নয়। তা ভোট–হিন্দুদের কর্ম নয়।’
পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মীনাক্ষী লেখি বলেন, ওদের আমলে কী কী হয়েছিল, মানুষ তা জানে। ভোট–হিন্দুদের কাছ থেকে তাই কেউ কিছু আশা করা যায় না।
অবশ্য কংগ্রেস মনে করছে, এই নিবন্ধের মধ্য দিয়ে রাহুল যেমন সনাতন বিতর্কে জল ঢাললেন, তেমনই বুঝিয়ে দিলেন বিজেপি ও রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) হিন্দুত্ববাদের পার্থক্য ও অসাড়ত্ব। কংগ্রেস বলছে, বিজেপি–সংঘের হিন্দুত্ববাদ হলো সাভারকর (হিন্দুত্ববাদের প্রবক্তা) ও নাথুরাম গডসের (গান্ধীর হত্যাকারী)। কিন্তু প্রকৃত হিন্দুধর্ম হলো মহাত্মা গান্ধী অনুসৃত জীবনশৈলী।