৩৮ বছর পর বাবার এমন ফেরা চাননি সন্তানেরা

উত্তরাখন্ডের মুখ্যমন্ত্রী পুশকার সিং ধামি ল্যান্স নায়েক চন্দ্রশেখরের মরদেহে গত বুধবার শ্রদ্ধা জানান। এরপর তিনি চন্দ্রশেখরের স্ত্রী ও দুই মেয়েকে সান্ত্বনা দেন। ১৭ আগস্ট
ছবি: এএনআই

মা, বাবা কখন আসবে? বছরের পর বছর ধরে প্রতিদিন এই এক প্রশ্ন শুনে এসেছেন শান্তি দেবী। তিনিও একই জবাব দিয়ে গেছেন, তোমাদের বাবা কাজের প্রয়োজনে বাড়ি থেকে দূরে গিয়েছে, তাড়াতাড়ি ফিরে আসবে।

এই দুই মেয়ের বাবা চন্দ্রশেখর হারবোলা একজন ভারতীয় সেনা। ১৯৮৪ সালে ভারত-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের সিয়াচেন হিমবাহে টহল অভিযানের সময় নিখোঁজ হন তিনি। চন্দ্রশেখর যখন টহল দিচ্ছিলেন, তখন সেই দলে ২০ জন ছিলেন। আচমকা একটি তুষারধসের শিকার হন তাঁরা। বিবিসির খবর

সিয়াচেনে ভারত ও পাকিস্তান উভয় দেশের সেনারা টহল দেন। অঞ্চলটি নিয়ে বিরোধ রয়েছে। সিয়াচেন বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু যুদ্ধক্ষেত্র বলে পরিচিত। দুর্গম এই এলাকায় বৈরী আবহাওয়ার কারণে মানুষের টিকে থাকা কঠিন। এখানে দুই দেশের মধ্যকার যুদ্ধে যত না প্রাণ যায়, তার চেয়ে বেশি যায় আবহাওয়ার কারণে। তুষারধস এখানকার নিয়মিত ঘটনা।

চন্দ্রশেখর ও তাঁর সহকর্মীদের ভাগ্যেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। তুষারধসের পর ১৫টি মরদেহ উদ্ধার হলেও চন্দ্রশেখরসহ ৫ জন নিখোঁজ হন। চন্দ্রশেখরের বড় মেয়ে কবিতা তখন আট বছরের আর ছোটটি ববিতার বয়স চার বছর। প্রায় চার দশক পর তাঁরা বাবার বাড়ি ফেরার খবর পেলেন। কিন্তু বাবা যে এভাবে ফিরবে, তা তাঁরা কল্পনাও করেননি।

সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে তাঁদের জানানো হয়, গত সপ্তাহে ওই হিমবাহে একটি ইউনিট একটি মরদেহ দেখতে পায়। খবরটি পরিবারটির জন্য যেমন স্বস্তির ছিল, তেমনি আশাহত হওয়ারও। শান্তি দেবী ও তাঁর দুই মেয়ে সবার মনের কোনায় আশা ছিল হয়তো চন্দ্রশেখর বেঁচে আছেন। হয়তো তাঁকে পাকিস্তানি সেনারা ধরে নিয়ে গেছেন। একদিন তিনি ফিরে আসবেন।

দুর্গম এই এলাকায় বৈরী আবহাওয়ার কারণে মানুষের টিকে থাকা কঠিন। এখানে নিয়মিত তুষারধস হয়। ১৫ আগস্ট সেনাবাহিনীর টহল দল একটি মরদেহ দেখতে পায়
ছবি: এএনআই

কিন্তু চলতি সপ্তাহে উত্তরাখন্ড রাজ্যের নিজ গ্রামে চন্দ্রশেখরের মৃতদেহ আসার মধ্য দিয়ে পরিবারটির অপেক্ষার অবসান ঘটে। শান্তি দেবী গত ৩৮ বছর সৃষ্টিকর্তার কাছে দুটি জিনিসই চেয়েছেন। তাঁর মেয়েদের ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা ও আর চন্দ্রশেখরের ফিরে আসা।

স্বামী নিখোঁজ হওয়ার পর শান্তি দেবী নার্সের প্রশিক্ষণ নেন এবং বাগেশ্বর জেলায় সরকারি হাসপাতালে যোগ দেন। সংসারের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন শান্তি দেবী। তখন তাঁর প্রধান দায়িত্ব ছিল সন্তানদের পড়াশোনা করানো। আবার কেন বিয়ে করেননি, জানতে চাইলে স্বামীর ছবির দিকে তাকিয়ে তিনি বিবিসিকে বলেন, ‘আমার আশা ছিল তিনি ফিরে আসবেন। আমি সন্তানদের আশ্বস্ত করতাম তাদের বাবা একদিন ফিরে আসবে।’

শান্তি দেবী প্রায়ই প্রধান সড়ক থেকে গ্রামের দিকে চলে যাওয়া পথটি ধরে হাঁটতেন। চন্দ্রশেখর ছুটিতে গ্রামে ফিরলে বা ছুটি শেষে কর্মস্থলে ফেরার সময় এই পথ ধরে চলতেন। ১৯৮৪ সালে শেষবার যখন গেলেন, আগের মতোই দ্রুত ফিরবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়ে গিয়েছিলেন।

শান্তি দেবী বলেন, ‘আমি ভাবতাম তাঁকে হয়তো বন্দী করা হয়েছে। তিনি হয়তো যুদ্ধবন্দী হিসেবে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে আছেন। এ রকম অনেক চিন্তা আমার মাথায় ঘোরপাক খেত।’

যেভাবে মিলল মরদেহ

ধাতুর ওপর খোদাই করা চন্দ্রশেখরের সেনাবাহিনীর আইডি নম্বরটি তখনো অক্ষত ছিল। ১৭ আগস্ট
ছবি: এএনআই

সিয়াচেনে একটি ইউনিট নিয়মিত টহল দিচ্ছিল। এ সময় তারা একটি বাংকার দেখতে পায়। সেটির কাছে গিয়ে একটি মরদেহ দেখে। একটি ধাতুর ওপর খোদাই করা চন্দ্রশেখরের সেনাবাহিনীর আইডি নম্বরটি তখনো অক্ষত ছিল। তারা বিষয়টি দ্রুত সদর দপ্তরে জানায়। সেখান থেকে রেকর্ড পুঙ্খানুপুঙ্খ যাচাই করার পর তারা নিশ্চিত করে লাশটি নিখোঁজ সেনা চন্দ্রশেখর হারবোলার। এরপরই সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়।

চন্দ্রশেখরের ভাইয়ের ছেলে হরিশচন্দ্র হারবোলা বলেন, ‘আমরা ১৩ আগস্ট রাতে খবরটি পাই। নিয়োগের সময় তিনি যে পরিচয়পত্র পেয়েছিলেন, তার ভিত্তিতে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছিল। ডিস্কের মাধ্যমে তারা আমাদের চাচাকে শনাক্ত করেছে। খবরটি আমাদের সব আশা শেষ করে দিয়েছে। তারপরও দেশের জন্য তাঁর (চন্দ্রশেখর) জীবন উৎসর্গ আমাদের জন্য গর্বের।

চন্দ্রশেখরের দাহের সময় উপস্থিত একজন সেনা কর্মকর্তা বলেছেন, সেনাবাহিনী তার নিখোঁজ সৈন্যদের সন্ধান কখনো বন্ধ করেনি। তিনি বলেন, ‘আমরা হারিয়ে যাওয়া জওয়ানদের (সৈন্যদের) সন্ধান জারি রাখি। এই গ্রীষ্মে সিয়াচেন হিমবাহের বরফ গলতে শুরু করলে আমরা হারিয়ে যাওয়া জওয়ানদের খোঁজে আবার অনুসন্ধান শুরু করি। এবং আমরা চন্দ্রশেখরকে খুঁজে পাই। আমরা আশা করি অন্যদেরও খুঁজে পাব।’

আশাভঙ্গের বেদনা

সামরিক মর্যাদায় চন্দ্রশেখরকে বিদায় জানান সহকর্মীরা। ১৭ আগস্ট
ছবি: এএনআই

কবিতা এখন ৪৬ বছর বয়সী আর ববিতা ৪২। মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে বাবার মরদেহের অপেক্ষায়। অনেক স্বজন, প্রতিবেশী এবং আশপাশের সাধারণ মানুষ এসেছিলেন চন্দ্রশেখরকে শ্রদ্ধা জানাতে। সেখানে অনেকে স্লোগান দিচ্ছিলেন চন্দ্রশেখর হারবোলা অমর হও। সবার চোখেই ছিল জল। অনেকে তো বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না যে তাঁর মরদেহ পাওয়া গেছে। ৩৮ বছর পর মরদেহ পাওয়া ও পূর্ণ সামরিক মর্যাদায় বাড়িতে নিয়ে আসা প্রতিদিন ঘটে না। এর মধ্য দিয়ে তাঁর পরিবারের জন্য একটি অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটল। কিন্তু তাঁদের আশা ভঙ্গ হওয়ার বেদনা আজীবন থাকবে।

২০১২ সালে সিয়াচেন হিমবাহের কাছে একটি তুষারধসে অন্তত ১২৯ পাকিস্তানি সেনা মারা গিয়েছিলেন। আর ২০১৬ সালে তুষারধসে ভারতের অন্তত ১০ জন এবং ২০১৯ সালে আরও ৪ জন মারা গিয়েছিলেন।