‘নতুন’ রাহুল নিজেকে কতটা বদলে নিতে পারবেন
‘পাপ্পু’ তকমা ঝেড়ে ফেলে দিয়েছেন, ঠিক যেভাবে পুকুর সাঁতরে পালক থেকে পানি ঝরায় পাতিহাঁস। ভারত জোড়ো যাত্রায় চার হাজার কিলোমিটার পথ হেঁটে পাড়ি দেওয়ার পর আর কেউ তাঁকে ‘চপলমতি’ কিংবা ‘আর্মচেয়ার পলিটিশিয়ান’ বলেও কটাক্ষ করার সাহস পাননি। উপহাস কিংবা ঠেস দেওয়া টিপ্পনী তো দূরের কথা।
লোকসভা ভোটের ফল প্রকাশের পর সব মহল যখন সমীহ করছে, ঠিক তখনই বিরোধী নেতার পদ গ্রহণ করে দায়িত্বশীল রাজনীতিকের পরিচিতি আদায় করে নিলেন রাহুল গান্ধী। লোকসভায় প্রধানমন্ত্রীর বিপরীতে মুখোমুখি আসনে বসে এখন তিনি বুঝিয়ে দিচ্ছেন, নরেন্দ্র মোদির আসল চ্যালেঞ্জার কে।
এই ভোলবদলের মধ্য দিয়ে রাহুলেরও বেশ বদল ঘটে গেছে। ২০২২ সালের ৭ সেপ্টেম্বর তামিলনাড়ুর কন্যাকুমারী থেকে রাহুল যখন ভারত জোড়ো যাত্রা শুরু করেছিলেন, তখন তাঁর পরনে ছিল সাদা টি–শার্ট ও ট্রাউজার্স। ১৩৬ দিন পথচলার সময় দাড়ি কাটেননি। শীতে গায়ে তোলেননি গরম জ্যাকেট। গ্রীষ্ম বা বর্ষায় মাথা ঢাকেননি ছাতায়। যাত্রা শেষ হয়ে গেলে দাড়ি ছেঁটেছেন, কিন্তু সাদা টি–শার্ট ছাড়েননি। অষ্টাদশ সংসদের প্রথম দিন লোকসভায় শপথও নিয়েছেন সেই টি–শার্ট ও ট্রাউজার্স পরে।
২০২২ সালের ৭ সেপ্টেম্বর তামিলনাড়ুর কন্যাকুমারী থেকে রাহুল যখন ভারত জোড়ো যাত্রা শুরু করেছিলেন, তখন তাঁর পরনে ছিল সাদা টি-শার্ট ও ট্রাউজার্স। ১৩৬ দিন পথচলার সময় দাড়ি কাটেননি। শীতে গায়ে তোলেননি গরম জ্যাকেট। গ্রীষ্ম বা বর্ষায় মাথা ঢাকেননি ছাতায়।
তবে গতকাল বুধবার সভাকক্ষে ঢুকলেন ভারতীয় রাজনীতির অঘোষিত সর্বজনীন ইউনিফর্মে। ধোপদুরস্ত সাদা পাঞ্জাবি–পায়জামায় আবির্ভাব হলো এক নতুন রাহুল গান্ধীর। ১০ বছর পর বিরোধীরাও আদায় করে নিল লোকসভার বিরোধী নেতার পদ।
কী তার অর্থ? বিরোধী নেতা হিসেবে এবার থেকে রাহুল পাবেন কেন্দ্রের পূর্ণমন্ত্রীর পদ মর্যাদা। পূর্ণমন্ত্রীর সমতুল্য বেতন, বাসস্থান, নিরাপত্তা ও অন্যান্য সুবিধা। লোকসভার সব বিরোধী দলের নেতৃত্বই তিনি শুধু দেবেন না, তিন নির্বাচন কমিশনার, সিবিআইয়ের পরিচালক, কেন্দ্রীয় ভিজিল্যান্স কমিশন, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের মতো সাংবিধানিক পদের চেয়ারপারসন নিয়োগ কমিটির তিনি হবেন অন্যতম সদস্য। তাঁর মতামতকে গুরুত্ব দিতে হবে।
এসবের অর্থ, এতকাল ধরে নরেন্দ্র মোদি যাঁকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে এসেছেন, নাম উচ্চারণ না করে ‘শেহজাদা’ সম্বোধন করে এসেছেন, সেই রাহুলের ওজর–আপত্তি যুক্তিকে গুরুত্ব দিতে হবে। বিরোধীরা নির্বাচিত করলে তিনিই হবেন পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটির চেয়ারম্যান। সেটা হলে যাবতীয় সরকারি অডিটও তিনি তলব করতে পারবেন। সরকারকে জবাবদিহিতে বাধ্য করতে পারবেন।
শুধু পোশাকি বদলই নয়, নেতা হিসেবেও রাহুল বদলে ফেলার চেষ্টা করছেন নিজেকে। তিনি জানেন, চলতি বছরের শেষে মহারাষ্ট্র, হরিয়ানা ও ঝাড়খন্ডের বিধানসভা ভোটে ‘ইন্ডিয়া’ জোট বিজেপিকে পর্যুদস্ত করলে জাতীয় রাজনীতির প্রবাহ অন্য খাতে বইতে শুরু করবে।
অথচ এই রাহুলই মনমোহন সিং মন্ত্রিসভার সদস্য হতে চাননি। প্রণব মুখোপাধ্যায় পর্যন্ত তাঁকে বলেছিলেন, পছন্দের কোনো মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নিতে। প্রশাসনিক ক্ষেত্রের সেই অভিজ্ঞতা ভবিষ্যতে কাজে লাগবে। রাহুল গা করেননি। বরং কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় গৃহীত অর্ডিন্যান্স প্রকাশ্যে ছিঁড়ে ফেলে নিজের আপত্তি জাহির করেছিলেন!
২০১৯ সালের ভোটে পর্যুদস্ত হওয়ার পর হুট করে কংগ্রেসের সভাপতির পদ ছেড়ে দিয়েছিলেন রাহুল। শুধু তা–ই নয়, গান্ধী পরিবারের কাউকে সেই দায়িত্ব নিতেও দেননি। এখন বিরোধী নেতার গুরুদায়িত্ব গ্রহণের মধ্য দিয়ে তিনি সম্ভবত বোঝাতে চাইছেন, অদূর অতীতের ওই অধ্যায় তিনি ভুলে যেতে চান। এটা তাঁর নতুন ইনিংস।
সেই ইনিংস রাহুল শুরুও করলেন চমক দিয়ে। এত দিন ধরে নিরবচ্ছিন্নভাবে যাঁকে তিনি রাজনৈতিক আক্রমণের একমাত্র লক্ষ্য করেছিলেন, সেই নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে করমর্দন করতে দ্বিধা করেননি। বিরোধী নেতা হিসেবে তাঁর দায়িত্ব ছিল প্রধানমন্ত্রী ও সংসদীয় মন্ত্রীর সঙ্গে গিয়ে নবনির্বাচিত স্পিকারকে তাঁর আসন পর্যন্ত এগিয়ে দেওয়া। রাহুল তা করলেন এবং শিষ্টাচার মেনে নিজে থেকেই করমর্দনের হাত বাড়িয়ে দিলেন মোদির দিকে।
২০১৮ সালের জুলাইয়ে লোকসভায় অনাস্থা প্রস্তাবের ওপর ভাষণ দিয়ে রাহুল সরাসরি চলে গিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রীর আসনের কাছে। আচম্বিতে তাঁকে বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। ছয় বছর আগের সেই বালখিল্য আচরণের পুনরাবৃত্তি এবার তিনি করেননি। এখন তিনি অনেক পরিণত। তা ফুটে ওঠে স্পিকারকে অভিনন্দন জানিয়ে দেওয়া তাঁর ভাষণের মধ্যে।
উদ্বোধনী অধিবেশনের সংক্ষিপ্ত ভাষণে রাহুল স্পিকার ওম বিড়লাকে মনে করিয়ে দিয়েছেন, গত পাঁচ বছর স্পিকার হিসেবে তাঁর ‘পক্ষপাতিত্ব ও নিরপেক্ষহীনতার’ ধারাবাহিকতার কাহিনি। বুঝিয়ে দিয়েছেন, বিরোধীরাও দেশের মানুষের কণ্ঠস্বর। সেই স্বর দাবিয়ে রাখা অন্যায়। সরাসরি জানিয়ে দিলেন, বিরোধীদের দমিয়ে রেখে সংসদ চালানো অগণতান্ত্রিক।
শুধু পোশাকি বদলই নয়, নেতা হিসেবেও রাহুল বদলে ফেলার চেষ্টা করছেন নিজেকে। তিনি জানেন, চলতি বছরের শেষে মহারাষ্ট্র, হরিয়ানা ও ঝাড়খন্ডের বিধানসভা ভোটে ‘ইন্ডিয়া’ জোট বিজেপিকে পর্যুদস্ত করলে (মহারাষ্ট্র ও হরিয়ানা বিজেপির দখলে, ঝাড়খন্ডে ইন্ডিয়া) জাতীয় রাজনীতির প্রবাহ অন্য খাতে বইতে শুরু করবে। তিন রাজ্যে বিজেপির দুর্বলতা কোথায় ও ‘ইন্ডিয়া’ কতটা শক্তিশালী, সদ্য শেষ হওয়া লোকসভার ভোট তা দেখিয়েছে।
রাহুল গত বৃহস্পতিবার হরিয়ানার কংগ্রেসিদের জানিয়ে দিয়েছেন, নিজেদের মধ্যে ঝগড়া মেটানোর সময় এসে গেছে। বিজেপিকে সরানো না গেলে অন্য সব দল নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। যেমন হয়েছে অকালি দল, শিবসেনা, এআইএডিএমকে, বিআরএস। এতকাল যা আড়ালে করতেন, সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গেকে সঙ্গে নিয়ে রাহুল এখন তা প্রকাশ্যেই করছেন। লোকসভার ভোট তিনি যেভাবে লড়েছেন এবং যে সাফল্য পেয়েছেন, তা তাঁকে এই সাহস অর্জনে সাহায্য করেছে।
শুধু দল নয়, শরিকদের কাছেও নিজেকে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে সচেষ্ট রাহুল। স্পিকার নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে কিছুটা ভুল–বোঝাবুঝি সৃষ্টি হয়েছিল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে কথা না বলেই ঘোষিত হয়েছিল স্পিকার পদে কংগ্রেসের কে সুরেশের নাম। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় প্রকাশ্যে অসন্তোষ প্রকাশ করার সঙ্গে সঙ্গে রাহুল তাঁর সঙ্গে কথা বলেন। ভুল স্বীকার করেন। কোন পরিস্থিতিতে তেমনটা করতে হয়েছিল, ব্যাখ্যা করেন।
রাহুল তৃণমূল নেতা অভিষেকের ফোন থেকেই কথা বলেন মমতার সঙ্গে। একজোট থাকার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন। গজদন্ত মিনারে অবস্থান করে দলীয় বা জোট রাজনীতি যে করা যায় না, এই বোধ তাঁর এসেছে। যোগেন্দ্র যাদব তাই বলেন, এ এক নতুন রাহুল। ভারত জোড়ো যাত্রা এই নতুন রাহুল গান্ধীর জন্ম দিয়েছে।
শুধু নরেন্দ্র মোদি নন, রাহুল গান্ধী নিজেও এখন নিজের চ্যালেঞ্জার।