আদানি–কাণ্ডের পর শেয়ারবাজারে লগ্নিকারকদের স্বার্থরক্ষায় সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শ মেনে বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠনের প্রস্তাবে শর্ত সাপেক্ষে কেন্দ্রীয় সরকার সায় দিয়েছে।
প্রথমত, সেই কমিটির বিশেষজ্ঞরা কারা হতে পারেন, সরকার তা মুখবন্ধ খামে সুপ্রিম কোর্টের কাছে জমা দেবে। দ্বিতীয়ত, কমিটির বিচার্য বিষয়ও সরকার ঠিক করে দেবে। তৃতীয়ত, বাজার নিয়ন্ত্রণের বিধি ও ‘সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ বোর্ড অব ইন্ডিয়াসহ’ (সেবি) নিয়ন্ত্রকেরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না, এমন কোনো বার্তা যেন না যায়, তা নিশ্চিত করতে হবে।
হিনডেনবার্গ রিসার্চের প্রতিবেদনের পর সুপ্রিম কোর্টে দুই আইনজীবী বিশাল তিওয়ারি ও এম এল শর্মা দুটি জনস্বার্থ মামলা করেন। তাতে লগ্নিকারকদের স্বার্থ নিশ্চিত করার পাশাপাশি হিনডেনবার্গের প্রতিবেদনে উঠে আসা আদানি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে শেয়ারবাজারে কারচুপির তদন্তের নির্দেশ দিতে অনুরোধ করা হয়। আবেদনকারীদের আরজি, সুপ্রিম কোর্টের কোনো অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিকে দিয়ে সেই কমিটি তৈরি করা হোক।
সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়, বিচারপতি পি এস নরসিংহ ও বিচারপতি জে বি পর্দিওয়ালার এজলাসে সলিসিটর জেনারেল তুষার মেহতা সেই কমিটি গঠনের প্রস্তাবে সায় দেন। সলিসিটর জেনারেল সরকারের পক্ষে বলেন, সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত কোনো বিচারপতিকে দিয়ে বিষয়টি খতিয়ে দেখার প্রস্তাবে সরকার সহমত। তবে তাঁর প্রস্তাব, বিশেষজ্ঞদের কিছু নাম সিল করা খামে সরকার সুপ্রিম কোর্টে জমা দেবে। সেসব নামের কোনোটি গ্রহণযোগ্য হতে পারে, কোনোটি নাও হতে পারে। তবে সেগুলো নিয়ে যেন আলোচনা না হয়। আবেদনকারীরাও যেন আপত্তি না তোলেন। সুপ্রিম কোর্ট তাঁদের মধ্য থেকে বিশেষজ্ঞদের বেছে নেবেন।
তুষার মেহতা বলেন, কমিটি মোটামুটিভাবে কী বিচার করতে পারবে, সেই সুপারিশও সরকার করবে। সুপ্রিম কোর্টকে দেখতে হবে, কোনোভাবেই যেন বাজারে এই বার্তা না যায় যে বাজার নিয়ন্ত্রকেরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না। তাতে বাজার ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সরকার মনে করে, পরিস্থিতি মোকাবিলায় সংশ্লিষ্ট সংস্থা ও ব্যবস্থা যথেষ্ট উপযুক্ত। আগামী শুক্রবার সুপ্রিম কোর্টে এই মামলার পরবর্তী শুনানি অনুষ্ঠিত হবে।
কেন্দ্রীয় সরকারের এসব শর্ত নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিরোধীরা। প্রশ্ন উঠেছে, এসব শর্ত মেনে গঠিত কমিটি কি আদৌ আদানি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে উঠা শেয়ারবাজারে ‘কারচুপি ও জালিয়াতির’ তদন্ত করতে পারবে? কংগ্রেস দলীয় সংসদ সদস্য ও দলীয় মুখপাত্র জয়রাম রমেশ সরাসরি জানতে চেয়েছেন, সুপ্রিম কোর্টের প্রস্তাবে সরকার সম্মত হলে বিরোধীদের দাবি মেনে যৌথ সংসদীয় কমিটির তদন্তে এত আপত্তি কেন? বিরোধী নেতারা মনে করছেন, সরকার কিছুতেই চায় না সুপ্রিম কোর্টের গড়ে দেওয়া কমিটি আদানির জালিয়াতি, কারচুপি ও প্রতারণার অভিযোগ খতিয়ে দেখুক। সে কারণেই তাদের এত শর্ত।
রাফাল ও পেগাসাস মামলায়ও কেন্দ্রীয় সরকার এ ধরনেরই কৌশল নিয়েছিল। রাফাল মামলায় কেন্দ্রের তরফ থেকে যেসব তথ্য সুপ্রিম কোর্টে পেশ করা হয়েছিল, তা গোপন রাখা হয়েছিল। নিরাপত্তা ও জাতীয় স্বার্থে সেসব তথ্য সিল করা খামে সুপ্রিম কোর্টে পেশ করে সরকার বলেছিল, ওইসব তথ্য যেন জনসমক্ষে না আসে। পেগাসাস মামলায়ও ওই এক কারণ দেখিয়ে সুপ্রিম কোর্ট নিযুক্ত কমিটির সঙ্গে সহযোগিতা করেনি সরকার। কমিটি নিজেই সেই অসহযোগিতার কথা সুপ্রিম কোর্টকে জানিয়েছিল। এ ক্ষেত্রেও সরকার সেই ঢালের আড়ালে থাকতে চাইছে। বিরোধীরা মনে করছেন, স্পষ্টতই সরকার অনেক কিছু আড়াল করতে সচেষ্ট।
সংসদে কংগ্রেস সদস্য রাহুল গান্ধী, মল্লিকার্জুন খাড়গের মতো তৃণমূল সদস্য মহুয়া মৈত্রসহ অনেকেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও গৌতম আদানির ‘সখ্য ও সম্পর্ক’ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তাঁদের অভিযোগ, আদানিদের স্বার্থে সরকার বাড়তি আগ্রহ দেখিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নিজে উদ্যোগী হয়েছেন। রাহুল এই প্রসঙ্গে মোদির বাংলাদেশ সফরের প্রসঙ্গ টেনেছেন। সে দেশের সঙ্গে আদানির বিদ্যুৎ চুক্তিতে প্রভাব বিস্তারের অভিযোগ এনেছেন। শ্রীলঙ্কা সফরেরও উল্লেখ করেছেন। রাজ্যসভার তৃণমূল সদস্য জহর সরকার গতকাল এই বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করকে লেখা এক চিঠিতে এই অভিযোগ নিয়ে তাঁর বক্তব্য জানতে চেয়েছেন। অবশ্য তিনি জানিয়েছেন, এর আগে দুবার চিঠি লিখেও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর উত্তর পাননি।
আদানিকে অন্যায়ভাবে সুযোগ করে দেওয়ার নতুন অভিযোগ এনেছেন লোকসভার কংগ্রেস সদস্য মনীশ তিওয়ারি। পাঞ্জাব থেকে নির্বাচিত এই সংসদ সদস্য গতকাল লোকসভায় বলেন, কেন্দ্রীয় বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয় ওডিশার মহানদী কয়লাখনির কয়লা সরাসরি রেলপথে পাঞ্জাবে আনতে বাধা দিচ্ছে। তারা পাঞ্জাব সরকারকে গত বছরের ৩০ নভেম্বর চিঠি লিখে বলেছে, মহানদী কয়লাখনির কয়লা ওডিশার পারাদ্বীপ বন্দর থেকে জাহাজে করে শ্রীলঙ্কা ঘুরে যাবে গুজরাটে আদানি নিয়ন্ত্রিত দহেজ ও মুন্দ্রা বন্দরে। সেখান থেকে কয়লা রেলপথে পাঞ্জাবে নিতে হবে।
মনীশের অভিযোগ, যেখানে ওডিশা থেকে রেলপথে সরাসরি পাঞ্জাবে এলে ১ হাজার ৮৩০ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করতে হয়, সেখানে দেড় হাজার কিলোমিটার পথ বাড়তি পাড়ি দিতে হচ্ছে। এতে কয়লার দাম টনপ্রতি ৪ হাজার ৩৫০ রুপি থেকে বেড়ে হয়েছে ৬ হাজার ৭৫০ রুপি। বিদ্যুতের দাম ইউনিটপ্রতি ৩ রুপি ৬০ পয়সা থেকে বেড়ে হয়েছে ৫ রুপি। ভুগছে পাঞ্জাবের মানুষ।