একের পর এক মানুষ চিতার শিকার, আতঙ্কে ভারতের বিজনোরের বাসিন্দারা

চিতাবাঘ
ফাইল ছবি: রয়টার্স

‘চিতাটিকে বাড়ির আঙিনার সামনের দিকে আসতে দেখলাম। তারপর সেটি আমার মেয়েকে ধরে নিয়ে পালিয়ে গেল। ওই শেষবার মেয়েকে আমি জীবিত দেখেছিলাম,’ কথাগুলো বলছিলেন ভারতের উত্তর প্রদেশ রাজ্যের বিজনোর জেলার বাসিন্দা মনীষা সিং। সেদিনের কথা এখনো ভুলতে পারছেন না তিনি।

মনীষার মেয়ের বয়স ছিল ছয় বছর। নাম ইয়াশি। চিতাবাঘের কবলে পড়ার কয়েক ঘণ্টা পর বাসার কাছের একটি আখখেতে তার মরদেহ পাওয়া যায়। শুধু ইয়াশিই নয়, গত তিন মাসে বিজনোরে চিতাবাঘের হামলায় সাতজনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে পাঁচটি হামলার ঘটনা ঘটেছে গত এপ্রিলের ১৯ থেকে ২৬ তারিখের মধ্যে। এ নিয়ে আতঙ্কে রয়েছেন জেলার বাসিন্দারা।

বন বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, এই এলাকায় চিতাবাঘের হামলার ঘটনা বিরল নয়। তবে গত কয়েক সপ্তাহে হঠাৎ করেই এই সংখ্যা বেড়েছে। হামলাগুলো আগের চেয়ে বেশি নৃশংস হয়ে উঠেছে বলে জানান বন কর্মকর্তা মহেশ চাঁদ গৌতম। তিনি বলেন, হামলাগুলো এখন কেন হচ্ছে তা বের করতে হবে।

বিজনোরও ব্যতিক্রম নয়। এই জেলায় ঘাসের জমি, জলাভূমি ও ঘন জঙ্গল রয়েছে। এগুলো চিতাবাঘের প্রাকৃতিক আবাসস্থল।

এ নিয়ে ভারতে প্রাণী সংরক্ষণ নিয়ে কাজ করা সংস্থা ওয়াইল্ড লাইফ ট্রাস্ট অব ইন্ডিয়ার প্রধান পশুচিকিত্সক এনভিকে আশরাফ বলেন, ‘কোন পরিস্থিতিতে মানুষের ওপর হামলার ঘটনাগুলো ঘটছে, তা আমাদের বের করতে হবে। দিনের কোন সময়ে হামলাগুলো হচ্ছে, শিকার কারা এবং হামলার সময় তারা কী অবস্থায় ছিল, তা বের করাও দরকার।’

চিতাবাঘ সাধারণত লোকচক্ষুর আড়ালে থাকে। তবে বছরের পর বছর ধরে প্রাণীটির আবাসস্থল সংকুচিত হয়ে আসছে। ফলে শিকারের সন্ধানে সেগুলোর শহর বা গ্রামে ঢুকে পড়ছে। বিজনোরও ব্যতিক্রম নয়। এই জেলায় ঘাসের জমি, জলাভূমি ও ঘন জঙ্গল রয়েছে। এগুলো চিতাবাঘের প্রাকৃতিক আবাসস্থল বলে জানান এন ভি কে আশরাফ।

বিজনোরে বন বিভাগের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তা একে সিং বললেন, এখন পর্যন্ত তাঁরা ১০টি চিতা ধরতে পেরেছেন।

বিজনোরে বর্তমানে চিতাবাঘের সংখ্যা কত, তা নির্দিষ্ট করে বলা কঠিন। প্রাণীটির সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে বলেই বন কর্মকর্তাদের ধারণা। এন ভি কে আশরাফ বললেন, এই এলাকায় হাজার হাজার একর জমিতে আখের খেত রয়েছে। খেতগুলো চিতাবাঘের লুকানো ও শিকারের জন্য উৎকৃষ্ট জায়গা। চিতাবাঘের সন্তান জন্মদানের জন্যও উপযুক্ত। ফলে সেগুলোর সংখ্যা বাড়তির দিকে রয়েছে।

এদিকে সময়ের সঙ্গে চিতাবাঘের প্রাকৃতিক আবাসস্থলে মানুষের অনুপ্রবেশ বাড়ছে বলে জানান বিশেষজ্ঞ অনেকে। ফলে বাঘগুলো তাদের আবাসস্থল ছেড়ে যেতে বাধ্য হচ্ছে। বন কর্মকর্তা মহেশ চাঁদ গৌতমের কথায়, ‘চিতাবাঘগুলো আখখেতকে তাদের আবাসস্থল বলে মনে করছে। খেতে মানুষ কাজ করতে গেলে, বাঘগুলো হামলার সুযোগ পাচ্ছে।’

এমন ঘটনাও ঘটতে পারে যে চিতাবাঘগুলো নরখাদকে পরিণত হয়েছে। এমন নয়, মানুষের রক্তের স্বাদ সেগুলোকে এ পথে এনেছে। এই ধারণাটা প্রচলিত হলেও ভুল। আসল কারণটা হলো, দাঁত ও থাবা ক্ষতিগ্রস্ত হলে চিতাবাঘ শিকারের সক্ষমতা হারায়। তখন সহজ শিকার হিসেবে সেগুলো মানুষকে বেছে নেয়
এনভিকে আশরাফ, প্রধান পশুচিকিত্সক, ওয়াইল্ড লাইফ ট্রাস্ট অব ইন্ডিয়া  

প্রাকৃতিক আবাসস্থল কমে যাওয়ার কারণে চিতাবাঘের হামলা বেড়ে যেতে পারে বলে মনে করেন ভারতের ওয়াইল্ডলাইফ কনজারভেশনের প্রধান অনিশ আন্ধেরিয়াও। তিনি বলেন, ‘যখন বড় মাংসাশী প্রাণীগুলো মানুষের পাশাপাশি বসবাস করা শুরু করে, তখন প্রজন্ম বদলের সঙ্গে সঙ্গে সেগুলোর আচরণেও বদল আসে। মানুষকে বাস্তুসংস্থানের অংশ ও শিকার হিসেবে মনে করা শুরু করে সেগুলো।’

চিতাবাঘের মানুষের ওপর হামলার ঘটনা বিরল। এন কে ভি আশরাফ বলেন, এমন ঘটনাও ঘটতে পারে যে চিতাবাঘগুলো নরখাদকে পরিণত হয়েছে। এমন নয় মানুষের রক্তের স্বাদ সেগুলোকে এ পথে এনেছে। এই ধারণাটা প্রচলিত হলেও ভুল। আসল কারণটা হলো, দাঁত ও থাবা ক্ষতিগ্রস্ত হলে চিতাবাঘ শিকারের সক্ষমতা হারায়। তখন সহজ শিকার হিসেবে সেগুলো মানুষকে বেছে নেয়।

বিজনোরের বাসিন্দারা বললেন, আগে তাঁরা যখন ফসলের খেতে চিতাবাঘ দেখতেন, ভয় পেতেন না। তবে সাম্প্রতিক হামলা পরিস্থিতি বদলে দিয়েছে। লোকজন এখন খেতে একা কাজে যান না। এমনকি অনেকে তাঁদের সন্তানদের বাড়ির বাইরে যেতে মানা করছেন। যেমন ফাইয়াজ নামের একজন বলেন, ‘নিজেদের রক্ষা করতে আমরা সব সময় সঙ্গে লাঠি রাখি।’

এদিকে চিতাবাঘগুলো ধরতে তৎপরতা শুরু করেছেন বন বিভাগের স্থানীয় কর্মকর্তারা। যেসব স্থানে হামলা হয়েছে, তার আশপাশে বেশ কয়েকটি ফাঁদ পেতেছেন তাঁরা। বিজনোরে বন বিভাগের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তা একে সিং বলেন, এখন পর্যন্ত তাঁরা ১০টি চিতা ধরতে পেরেছেন।

ওই চিতাগুলোকে ২০ কিলোমিটার দূরে আমানগড় সংরক্ষিত জঙ্গলে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। এর আগেও এ পদ্ধতিতে হামলার সংখ্যা কমানো হয়েছে বলে জানান বন কর্মকর্তারা। বন কর্মকর্তা মহেশ চাঁদ গৌতম বলেন, ‘হামলা রুখতে তাঁরা স্থানীয় লোকজনকে ফসলের খেতে বসে থাকতে নিষেধ করেছেন। কারণ, এভাবে থাকলে চিতাবাঘ তাঁদের শিকার মনে করতে পারে।’

হামলা ঠেকাতে বন বিভাগসহ অন্যরা কাজ করছে, এটা সত্য। তবে বিজনোরের মানুষের ভয় কমছে না। শুরু ইয়াশি নামের যে শিশুটির কথা বলা হয়েছিল, তার বাবা টেকচাঁদ কাছের একটি বাজারে যাচ্ছিলেন। তিনি বলেন, ‘গ্রামের সবাই আতঙ্কে রয়েছেন। পরিবার নিরাপদে আছে তা নিশ্চিত করতে আমাকে সূর্য ডোবার আগেই ফিরতে হবে।’