ভারতের অন্তর্বর্তী বাজেটে মোদির আস্থার কথাই যেন ফুটে উঠল

ভারতের পার্লামেন্টে বাজেট পেশ করছেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন। ১ ফেব্রুয়ারিছবি: এএনআই

সংসদের বাজেট অধিবেশন শুরুর দিনেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি জানিয়েছিলেন, লোকসভার পরবর্তী ভোটে জেতার পর তাঁর সরকার পূর্ণাঙ্গ বাজেট পেশ করবে। সেই কথায় তাঁর নিজের প্রতি যে আস্থার বিচ্ছুরণ ঘটেছিল, আজ বৃহস্পতিবার অন্তর্বর্তী বাজেটে বা ‘ভোট অন অ্যাকাউন্ট’–এ তারই প্রতিফলন ঘটালেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন।

লোকসভার ভোটের বছরে পূর্ণাঙ্গ বাজেট পেশ হয় নতুন সরকার গঠনের পরেই। সেটিই ভারতের রীতি। তার আগে সরকারি খরচ ও কাজ চালানোর অনুমতি নিতে পেশ করা হয় অন্তর্বর্তী বাজেট বা ভোট অন অ্যাকাউন্ট, যাতে সরকারি খরচে কোনো বাধা না আসে। সাধারণত এই বাজেটে তাই বড় ধরনের কোনো জনমুখী ঘোষণা হয় না।
অবশ্য সেই প্রথা থেকে বের হয়ে ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটের বছরে মোদি সরকার মধ্যবিত্তের মন জয় করতে আয়কর ছাড়ের সীমা বাড়িয়ে দিয়েছিল। এবার তেমন ধরনের কোনো জনমুখী সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হয়নি। এর মধ্য দিয়ে এটাই বোঝা গেল, জয়ের হ্যাটট্রিক নিয়ে প্রধানমন্ত্রী কতটা নিশ্চিত। গত বুধবার বাজেট অধিবেশন শুরুর দিন সম্ভবত সেই কারণে তিনি বলেছিলেন, ভোটে জেতার পর পূর্ণাঙ্গ বাজেট পেশ করবেন।

তবে নির্মলার বাজেট ভাষণে শাসক দল বিজেপির রাজনৈতিক লক্ষ্য স্পষ্ট হয়ে গেছে। ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিজেপি একাই পেয়েছিল ২৮২ আসন, এনডিএর প্রাপ্য ছিল ৩৩৬। পাঁচ বছর পর ২০১৯ সালের ভোটে বিজেপি জিতেছিল ৩০৩ আসন, জোট হিসেবে ৩৫৩। ২০২৪ সালের ভোটে বিজেপি ৪০০ আসন পাওয়ার স্লোগান দিয়ে রেখেছে। বারবার বলেছে, ‘আসছে বার ৪০০ পার।’

এনডিএকে ৪০০ আসন জিততে হলে বিজেপিকে পূর্বাঞ্চলের পশ্চিমবঙ্গ ও ওডিশা এবং উত্তর–পূর্বাঞ্চলের দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। সম্ভবত সেই কারণেই নির্মলা সীতারামন তাঁর ভাষণে পূর্বাঞ্চলের উল্লেখ করে বলেছেন, এই দিকের প্রবৃদ্ধির প্রতি আমরা বিশেষ দৃষ্টি দিতে চাই। সে জন্য বিশেষ পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’

পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর মধ্যে বিহার ও ঝাড়খন্ডে গত নির্বাচনে বিজেপি দুর্দান্ত ফল করলেও পশ্চিমবঙ্গ ও ওডিশায় তুলনামূলক ভালো করতে পারেনি। পশ্চিমবঙ্গে ৪২ আসনের মধ্যে পেয়েছিল ১৮, ওডিশায় ২১টির মধ্যে ৮টি। বিহারে গতবারের মতো ভালো ফলের সম্ভাবনা উজ্জ্বল করতে জেডিইউ নেতা নীতিশ কুমারকে তারা জোটে ফিরিয়েছে। ঝাড়খন্ডের মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সোরেনকে গ্রেপ্তার করেছে। রাজনৈতিক এই সিদ্ধান্তের পাশাপাশি মনে করা হচ্ছে, নির্মলা তাঁর ভাষণে অনুকূল অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তের আগাম ঘোষণাও করে রাখলেন।

ভোটে জেতার ক্ষেত্রে নারীদের ভূমিকা সব রাজনৈতিক দলই ইদানীং স্বীকার করছে। নানাভাবে তাই নারীদের ক্ষমতায়ন ও আর্থিক উন্নয়নের দিকে নজর দেওয়া হয়। নারীদের মন জিততে বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমার রাজ্যে মদ নিষিদ্ধ করেছিলেন। নির্বাচনে তার ফলও পেয়েছিলেন। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’ প্রকল্প চালু করেছিলেন। মাসিক অর্থিক অনুদানের প্রকল্প ঘোষণা করে সম্প্রতি মধ্য প্রদেশ বিধানসভা ভোটে বিপুল জয় পেয়েছে বিজেপি। যদিও সেই প্রকল্পের কারিগর মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিং চৌহানকে এবার ক্ষমতাসীন করেনি বিজেপি।

নির্মলা সীতারামন অন্তর্বর্তী বাজেটে নারীদের বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। দেশে ‘লাখপতি দিদি’র সংখ্যা (এই প্রকল্পে গ্রামীণ এলাকার নারীদের কারিগরি প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, যাতে তাঁরা বছরে এক লাখ রুপি রোজগারের মাধ্যমে স্বাবলম্বী হতে পারেন) এক কোটি থেকে বাড়িয়ে দুই কোটি করার কথা বলেছেন।

ভাষণে সীতারামন বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনায় তৈরি মোট বাড়ির ৭০ শতাংশের মালিকানা নারীদের। আগামী পাঁচ বছরে ওই প্রকল্পে গ্রামীণ এলাকায় আরও দুই কোটি গৃহ নির্মাণ করা হবে। কর্মজীবী নারীর সংখ্যাও ২৮ শতাংশ বেড়েছে বলে দাবি করেছেন। মোটের ওপর বুঝিয়েছেন, তাঁদের সরকারের লক্ষ্য নারীর ক্ষমতায়ন ও দরিদ্র নারীদের উপার্জনের ব্যবস্থা করা।

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ইদানীং বক্তৃতায় নারীদের পাশাপাশি তরুণ, কৃষক ও দরিদ্রদের কল্যাণের বিষয় বারবার উল্লেখ করে আসছেন। নির্মলার বাজেট ভাষণেও ছিল তার প্রতিফলন। প্রযুক্তিনির্ভর যুব সম্প্রদায়কে আত্মনির্ভর করে তুলতে তিনি বলেন, এক লাখ কোটি রুপির এক তহবিল গড়া হবে, যা থেকে যুব সম্প্রদায়কে নামমাত্র সুদে অথবা বিনা সুদে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ দেওয়া হবে। লক্ষ্য, স্বাবলম্বী করে তোলা।

কৃষকদের আয় বাড়ানোর ক্ষেত্রেও সীতারামন একগুচ্ছ প্রকল্পের কথা জানিয়েছেন। জয় সম্পর্কে পুরোপুরি নিশ্চিত বলেই মোদি সরকারের এই অন্তর্বর্তী বাজেটে জনমুখী ঘোষণা অনুচ্চারিত থাকল। কিন্তু সরকার যে নারী, যুব, কৃষক ও দরিদ্রদের মঙ্গলে কাজ করবেন, সেই রাজনৈতিক বার্তা স্পষ্ট দেওয়া হলো।