ভারতে তৃতীয় দফায়ও ভোটের হার বাড়ল না কেন, কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা

লোকসভা ভোটের তৃতীয় দফার ভোটারদের কেন্দ্রে আনতে বিনা মূল্যে পরিবহনের ব্যবস্থা করা হয়। তবু বিহার রাজ্যে ভোটের হার কম। আজ ৭ মে রাজ্যের সুপাউলেছবি: এএনআই

ভারতের লোকসভা নির্বাচনে প্রথম দুই দফার ভোটের প্রাথমিক হার যেমন ছিল, তৃতীয় দফাতেও তার বিশেষ হেরফের হলো না। আজ মঙ্গলবার ১০ রাজ্য ও ২ কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের ৯৩টি আসনে ভোট হলো। বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত এসব আসনে ভোট পড়েছে ৬০ দশমিক ১৯ শতাংশ। ভোট গ্রহণ শেষে যা আরও কিছুটা বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বিহার (৫৬), মহারাষ্ট্র (৫৩), গুজরাট (৫৫) ও উত্তর প্রদেশের (৫৫) ভোটের হার এই দফায়ও আশানুরূপ নয়। এই দফায়ও যথারীতি আসাম ও পশ্চিমবঙ্গে ভোট বেশি পড়েছে।

নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি ভোট পড়েছে আসামে, ৭৪ দশমিক ৮৬ শতাংশ। সবচেয়ে কম মহারাষ্ট্রে, ৫৩ দশমিক ৪০ শতাংশ। পশ্চিমবঙ্গের হার প্রায় ৭৪ শতাংশ।

ভোটের হার কেন সেভাবে বাড়ছে না, মানুষের মধ্যে উদ্দীপনা কেন অতীতের তুলনায় কম, তা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে বিশ্লেষণ অব্যাহত। এরই মধ্যে ভোটের হার নিয়ে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সংশোধিত পরিসংখ্যান ঘিরে ঘোরতর সংশয় প্রকাশ করেছে কংগ্রেস ও তৃণমূল কংগ্রেস। কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গে এই বিষয়ে ‘ইন্ডিয়া’ জোটের নেতাদের চিঠি লিখে ইসির ‘অভিসন্ধির’ বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়ে সম্মিলিত আওয়াজ তোলার কথা বলেছেন।

তৃণমূল কংগ্রেস ইসিকে চিঠি পাঠিয়ে ভোটের হার বৃদ্ধি নিয়ে গুরুতর সন্দেহ প্রকাশ করেছে। বিরোধীরা এ নিয়ে প্রশ্ন তুললেও ইসি যথারীতি চুপ। ভোট মিটে যাওয়ার ১১ দিন পর কেন তারা প্রথম দুই দফার সংশোধিত পরিসংখ্যান পেশ করল, তার কোনো ব্যাখ্যা ইসি আজও দেয়নি।

আজ মঙ্গলবার ভোট হলো গুজরাটের ২৫ আসনেই। ওই রাজ্যের সুরাট আসনে বিজেপি প্রার্থী আগেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সকাল সকাল আহমেদাবাদে ভোট দিয়ে প্রচারে চলে যান। ওই রাজ্যের গান্ধীনগর আসনে প্রার্থী কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। গতবারের চেয়েও (৬ লাখ) এবার তিনি বেশি ভোটে জেতেন কি না, ওই কেন্দ্রে সেটাই মূল আকর্ষণ। গুজরাটের ২৬ আসনই বিজেপির দখলে। এবার কংগ্রেস লড়াইয়ে আছে দুটি আসনে।

ভোট নিতান্তই একপেশে বলে গুজরাটে ভোটারদের মধ্যে আগ্রহও হয়তো স্বাভাবিক কারণে কম। কিন্তু এই দফায়ও বিহার (৫), মহারাষ্ট্র (১১) ও উত্তর প্রদেশে (১০) কেন কম ভোট পড়ল, তা নিয়ে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ চলছে। কোন হারে ভোট পড়লে তা সরকারবিরোধী বলে গণ্য হয়, কোন হার আবার সরকারের পক্ষে—এ নিয়ে প্রথম দফা থেকেই চলছে বিস্তর কাটাছেঁড়া।

প্রথম দুই দফার ভোটের পরেই বিজেপির প্রচারে আচমকা চলে আসে হিন্দু-মুসলমান বিভাজন। এখনো যা অব্যাহত রয়েছে। কাজেই মনে করা হচ্ছে, প্রথম দুই দফার ভোটের কম হারে বিজেপি বেশি চিন্তিত।  

তৃতীয় দফায় ভোটারদের বুথমুখী করে তুলতে গত রোববার প্রচারের শেষ দিনে প্রধানমন্ত্রী মোদি অযোধ্যায় রোড শোয়ে অংশ নিয়েছিলেন। সঙ্গে ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ। তাঁর অযোধ্যা সফর সারা দিন ধরে টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়েছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখা যায়নি। লক্ষণীয়, যে চার রাজ্যে ভোটের হার সবচেয়ে কম, সেখানে বিজেপি হয় একা, নয়তো শরিকদের সঙ্গে ক্ষমতায়।

কর্ণাটক (৬৬), ছত্তিশগড় (৬৭) ও মধ্যপ্রদেশে (৬২) ভোটের হার তুলনামূলক ভালো। যদিও সবচেয়ে ভালো ভোটের হার পশ্চিমবঙ্গ ও আসামে। প্রথম দুই দফায়ও পশ্চিমবঙ্গ সবাইকে টেক্কা দিয়েছিল। তা দেখে বিজেপিও আশায় বুক বেঁধেছে।

কর্ণাটকের (২৮ আসন) প্রথম পর্বের ভোট শেষ হওয়ার পর জেডিএস নেতা ও হাসনের সংসদ সদস্য প্রোজ্জ্বল রেভান্নার বিরুদ্ধে যৌন কেলেঙ্কারির মারাত্মক অভিযোগ ওঠে। এই দফার ভোট হলো সেই আবহে। ওই কেলেঙ্কারি বিজেপির কতটা ক্ষতি করতে পারে, আজ মঙ্গলবার ১৪ আসনের ভোটেই তা নির্ধারিত হয়ে যাবে। আজ ভোট ছিল রাজ্যের উত্তরাঞ্চলে, যেখানে বিজেপির প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ক্ষমতাসীন কংগ্রেস।

এবার মহারাষ্ট্রের ভোটের মূল আকর্ষণ শিবসেনা ও এনসিপির বিভাজন বিজেপির ঝুলি গতবারের মতো ভরিয়ে দিতে পারে কি না। ২০১৯ সালে রাজ্যের ৪৮ আসনের মধ্যে শিবসেনা ও বিজেপি ৪১টি জিতেছিল। জনপ্রিয় ধারণা, শিবসেনার শিন্ডে গোষ্ঠী ও এনসিপির অজিত পাওয়ারের সঙ্গে অধিকাংশ বিধায়ক চলে গেলেও জনসমর্থন রয়ে গেছে উদ্ধব ঠাকরে ও শারদ পাওয়ারের দিকে।

মহারাষ্ট্রের বারামতি আসনে আজ মঙ্গলবারের আকর্ষণ শারদকন্যা সুপ্রিয়া সুলে ও অজিত-জায়া সুনেত্রা পাওয়ারের লড়াই। মধ্যপ্রদেশে দুর্বল কংগ্রেস এবারও বিজেপিকে সেভাবে বেগ দিতে পারছে না। ওই রাজ্যে গুনা থেকে দাঁড়িয়েছেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়া, বিদিশায় প্রার্থী সাবেক মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিং চৌহান, রাজগড়ে ভাগ্য পরীক্ষায় নেমেছেন সাবেক কংগ্রেস মুখ্যমন্ত্রী দিগ্বিজয় সিং।

মণিপুর রাজ্যে লোকসভা নির্বাচনে ভোট দেওয়ার পর কালিমাখা আঙুল দেখাচ্ছেন ভোটাররা। আজ ৭ মে
ছবি: এএনআই

নির্বাচনের ১১ দিন পর ভোটের হারের সংশোধিত পরিসংখ্যান প্রকাশ বিরোধীরা মোটেই স্বাভাবিকভাবে নিচ্ছে না। কংগ্রেস সভাপতি খাড়গে ‘ইন্ডিয়া’ নেতাদের সেটাই মনে করিয়ে চিঠিতে লিখেছেন, ‘আমি ৫২ বছর ধরে ভোট দিচ্ছি। কখনো ভোটের হারে এমন হেরফের দেখিনি।’

খাড়গের প্রশ্ন, ‘যে কমিশন ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ভোটের হার প্রকাশ করে এসেছে, তারা কেন এত দেরিতে জাগল? তবে কি ইভিএমে সমস্যা হয়েছে? কোন আসনে কত ভোট পড়েছে, তা জানানো হয়নি। এমন নয় তো ২০১৯ সালে বিজেপি যেসব আসনে পিছিয়ে ছিল, শুধু সেখানেই এবার ভোটের হার বেড়ে গেল? এর মধ্য দিয়ে কি চূড়ান্ত ফল পরিবর্তনের ষড়যন্ত্র চলছে?’

একই প্রশ্ন তুলে এবং একই ধরনের সন্দেহ প্রকাশ করে কমিশনকে লেখা চিঠিতে তৃণমূল নেতা ডেরেক ও’ব্রায়ান তিনটি দাবি জানিয়েছেন। এক. লোকসভাভিত্তিক কত ভোটদাতা জানাতে হবে। দুই. কত বৈধ ভোটার অংশ নিয়েছেন। এবং তিন. দুই দফায় ভোটার পিছু কতগুলো ইভিএম ব্যবহার হয়েছে।

গত ১৯ এপ্রিল প্রথম দফার ভোটের পর ইসি জানিয়েছিল ভোটের গড় হার ৬০ শতাংশ। ২৬ এপ্রিল দ্বিতীয় দফার ভোটের পর বলা হয়, ভোট পড়েছে ৬০ দশমিক ৯৬ শতাংশ। অথচ ৩০ এপ্রিল ইসি সংশোধিত হার পেশ করে জানায়, প্রথম দফায় ভোট পড়েছে ৬৬ দশমিক ১৪ শতাংশ, দ্বিতীয় দফায় ৬৬ দশমিক ৭১ শতাংশ।

ইসির হিসাবে ভোটের হার আচমকাই ৬ শতাংশ করে বেড়ে যায়! সন্দেহ সেখানেই। ইসির নিরপেক্ষতা মারাত্মকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ। বিজেপির শীর্ষ নেতাদের ঘৃণা ভাষণ বন্ধে তারা এখনো কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।