মুরিদকেতে ভারত কি ‘সন্ত্রাসীদের ঘাঁটি’তে হামলা চালিয়েছে, নাকি মসজিদে

পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের মুরিদকে শহরে একটি সরকারি স্বাস্থ্য ও শিক্ষা কমপ্লেক্সে ভারতের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পর উদ্ধারকাজ চলছে। ৭ মে ২০২৫ছবি: এএফপি

বিপজ্জনকভাবে ঝুলছিল ভবনের ছাদ। এর একটি গর্ত দিয়ে সূর্যের আলো ভেতরে প্রবেশ করছিল। মাটিতে ছড়িয়ে ছিল ধ্বংসাবশেষ এবং ঘরের দরজাগুলো উড়ে গিয়েছিল বিস্ফোরণে।

এটা ছিল ভারতের পক্ষ থেকে পাকিস্তানকে পাঠানো একটি বার্তা। ৭ মে গভীর রাতে ভারতের চালানো একাধিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলার এটি ছিল একটি। গত ২২ এপ্রিল ভারত-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পেহেলগামে পর্যটকদের ওপর বন্দুকধারীদের প্রাণঘাতী হামলার প্রতিশোধ হিসেবে চালানো হয় এ ক্ষেপণাস্ত্র হামলা।

পেহেলগামে হামলায় ২৬ জন নিহত হন। ভারত হামলার জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করলেও, ইসলামাবাদ এতে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করে নিরপেক্ষ তদন্তের আহ্বান জানিয়েছে।

ওপরে যে ভবনের বর্ণনা দেওয়া হলো, সেটি পাকিস্তানে মুরিদকেতে অবস্থিত। ভারতের এ হামলা ছিল ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর অংশ, যা পাকিস্তানে চালানো সবচেয়ে বড় পরিসরের বিমান হামলা। পারমাণবিক অস্ত্রধারী দুই প্রতিবেশীর মধ্যে চারটি যুদ্ধের বাইরে সবচেয়ে বড় হামলা এটি। ভারত যেসব স্থান নিশানা করেছে, সেসবের মধ্যে মুরিদকে ছিল বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।

দীর্ঘদিন ধরে ধারণা করা হয়, মুরিদকে হলো লস্কর-ই-তাইয়েবা (এলইটি) নামের সশস্ত্র সংগঠনের ঘাঁটি। সংগঠনটিকে ভারত তার ভূখণ্ডে চালানো বিভিন্ন প্রাণঘাতী হামলার জন্য দায়ী করে থাকে; যার মধ্যে রয়েছে ২০০৮ সালের নভেম্বরে চালানো মুম্বাই হামলাও।

তবে ভারতের নিরাপত্তা কর্মকর্তারা ও দেশটির পররাষ্ট্রসচিব বিক্রম মিশ্রি গত বুধবার জোর দিয়ে দাবি করেন, তাঁরা শুধু ‘সন্ত্রাসবাদী স্থাপনা’ নিশানা বানিয়েছেন এবং ভারতীয় ক্ষেপণাস্ত্রগুলো কেবল সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে আঘাত করেছে। অন্যদিকে, পাকিস্তান জানিয়েছে, হামলায় অন্তত ২ শিশুসহ ৩১ বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছেন।

মুরিদকেতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলার কয়েক ঘণ্টা পর দেখা যায়, ধসে পড়া ছাদটি ছিল একটি বড় প্রশাসনিক ভবনের, নাম ‘গভর্নমেন্ট হেলথ অ্যান্ড এডুকেশনাল কমপ্লেক্স’। এখানে একটি হাসপাতাল, দুটি স্কুল, একটি হোস্টেল ও একটি বড় মাদ্রাসা রয়েছে। মাদ্রাসায় প্রায় তিন হাজার শিক্ষার্থী পড়াশোনা করেন। এ ছাড়া এখানে রয়েছে ৮০টি বাড়ি, যেখানে প্রায় ৩০০ মানুষের বসবাস, যাঁদের অধিকাংশ সরকারি কর্মচারী।

মুরিদকেতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলার কয়েক ঘণ্টা পর দেখা যায়, ধসে পড়া ছাদটি ছিল একটি বড় প্রশাসনিক ভবনের, নাম ‘গভর্নমেন্ট হেলথ অ্যান্ড এডুকেশনাল কমপ্লেক্স’। এখানে একটি হাসপাতাল, দুটি স্কুল, একটি হোস্টেল ও একটি বড় মাদ্রাসা রয়েছে। মাদ্রাসায় প্রায় তিন হাজার শিক্ষার্থী পড়াশোনা করেন। এ ছাড়া এখানে রয়েছে ৮০টি বাড়ি, যেখানে প্রায় ৩০০ মানুষের বসবাস; যাঁদের অধিকাংশ সরকারি কর্মচারী।

বুধবার এই প্রশাসনিক ভবন ও এটি সংলগ্ন এক বড় বারান্দা দিয়ে আলাদা করা একটি মসজিদেও আঘাত হেনেছে ক্ষেপণাস্ত্র। হামলায় ২০ থেকে ৩০ বছর বয়সী তিন কর্মচারী নিহত হন। আহত হন একজন।

একজন উদ্ধারকারী আল–জাজিরাকে জানান, তিনি হামলার আধা ঘণ্টার মধ্যে ঘটনাস্থলে পৌঁছান। ‘প্রথম মৃতদেহটি আমি-ই খুঁজে পাই’, প্রশাসনিক ভবনের একটি কক্ষের দিকে ইঙ্গিত করে বললেন তিনি।

ভারতের হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত বিলাল মসজিদের সামনে পাকিস্তানের এক সেনা। ৭ মে ২০২৫, পাকিস্তান-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের রাজধানী মুজাফফরাবাদে
ছবি: রয়টার্স

‘আমরা এর জন্য আগেই প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম’

২ লাখ ৫০ হাজারের বেশি জনসংখ্যার ছোট শহর মুরিদকে। পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদ থেকে চার ঘণ্টার পথ ও ভারতের সীমানার কাছাকাছি অবস্থিত পাঞ্জাব প্রদেশের রাজধানী লাহোর থেকে এটি প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে।

সরকারি কর্মকর্তা তৌসিফ হাসান আল–জাজিরাকে বলেন, ওই রাতে প্রথম মুরিদকে টার্গেট করেই ভারতের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা শুরু হয়।

‘ঠিক মধ্যরাতের একটু পর বিকট বিস্ফোরণের দুটি শব্দ শুনি, দুই মিনিটের ব্যবধানে। আমরা আগেই জানতাম, এমন কিছু হতে পারে। তাই বুঝে যাই, কী হয়েছে’, বললেন হাসান।

ওই দিন রাতে প্রথম মুরিদকে টার্গেট করেই ভারতের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা শুরু হয়।
-তৌসিফ হাসান, পাকিস্তানের সরকারি কর্মকর্তা

বারান্দার অন্য পাশে মসজিদ জামিয়া উম্মুল কুরা’র বড় নামাজ ঘরের ছাদ আংশিক ধসে পড়েছে। ছাদের দুটি বড় গর্ত চিহ্নিত করছে ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতের স্থান।

হাসান ও তাঁর সহকর্মী উসমান জালিস বলেন, পেহেলগামে হামলার পর থেকেই মুরিদকে নিয়ে ভারতের প্রচার এবং এ কমপ্লেক্সকে এলইটির সদর দপ্তর হিসেবে দেশটি চিহ্নিত করায় পাকিস্তান হামলার আশঙ্কা করছিল।

‘আমাদের আগেই সতর্ক করে দেওয়া হয়েছিল, মুরিদকে লক্ষ্যবস্তু হতে পারে। তাই আমরা কর্মচারী ও বাসিন্দাদের কমপ্লেক্স ত্যাগ করতে বলেছিলাম’, আল–জাজিরাকে বলেন জালিস। নিহত ব্যক্তিরা ছিলেন সেই কর্মীদের মধ্যে যাঁরা শেষ পর্যন্ত থেকে গিয়েছিলেন।

বারান্দার পাশে একটি বড় টেবিলে ক্ষেপণাস্ত্রের ধ্বংসাবশেষ সাজানো ছিল। ধাতব টুকরাগুলোর গায়ে তখনো বারুদের গন্ধ, লাগছিল গরম।

যদিও হাসান ও জালিস জোর দিয়ে বলেন যে মাদ্রাসা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সম্পূর্ণভাবে সরকারি নিয়ন্ত্রণে, তবে এ কমপ্লেক্সের উৎপত্তি আরও জটিল কাহিনির কথা বলে।

পাঞ্জাবের লাহোর শহর থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরের মুরিদকের সড়কে ট্রাকের ওপরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে সেনাবাহিনীর ট্যাংক। ভারত পাকিস্তানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানোর পরদিন এ চিত্র দেখা গেছে। ৭ মে ২০২৫
ছবি: এএফপি
আরও পড়ুন

শিক্ষা নাকি সশস্ত্র কর্মকাণ্ড

১৯৮৮ সালে এ কম্পাউন্ড প্রতিষ্ঠা করেন জামাত-উদ-দাওয়া (জেইউডি)-এর প্রতিষ্ঠাতা হাফিজ সাঈদ। দাতব্য সংগঠন ‘জামাত-উদ-দাওয়া’কে এলইটির সম্মুখভাগ হিসেবে ব্যাপকভাবে বিবেচনা করা হয়। কমপাউন্ডে অবস্থিত মাদ্রাসা ‘জামিয়া দাওয়া ইসলামি’ ওই সংগঠনের নামেই নামকরণ করা হয়েছে।

ভারত হাফিজ সাঈদ ও এলইটিকে দেশটিতে সংঘটিত অনেক হামলার জন্য দায়ী করে থাকে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ২০০৮ সালের মুম্বাই হামলা। কয়েক দিন ধরে চলা এ হামলায় ১৬০ জনের বেশি নিহত হন।

শিক্ষার্থীদের সাঁতার শেখা, ঘোড়সওয়ারি হওয়া বা শারীরিক প্রশিক্ষণ নেওয়ার সুযোগ দিলে তা কীভাবে সন্ত্রাসীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়?
-আবিদ হোসেন, মুরিদকের বাসিন্দা ও ধর্মীয় শিক্ষক

৫১ বছর বয়সী ধর্মীয় শিক্ষক আবিদ হোসেন এ কম্পাউন্ডেই থাকেন। এটি ‘সন্ত্রাসীদের প্রশিক্ষণ শিবির’ বা ‘কোনো সন্ত্রাসী সংগঠনের সদর দপ্তর’ হিসেবে কাজ করার ভারতীয় দাবি উড়িয়ে দেন তিনি। বলেন, ‘এটি কোনো সন্ত্রাসী ঘাঁটি নয়।’

‘এ কম্পাউন্ড সব সময় শিশুদের শিক্ষাকেন্দ্র ছিল, ছেলে ও মেয়ে—উভয়ের জন্য। আমি নিজে তিন দশক ধরে এখানে শিক্ষকতা করছি’, আল–জাজিরাকে বলেন ছোটখাটো গড়নের, শ্মশ্রুমণ্ডিত আবিদ হোসেন।

কম্পাউন্ডটি ‘সন্ত্রাসীদের’ প্রশিক্ষণ শিবির হিসেবে ব্যবহৃত হতো, এমন যেকোনো অভিযোগের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেন এই শিক্ষক। তিনি প্রশ্ন করেন, ‘শিক্ষার্থীদের সাঁতার শেখা, ঘোড়সওয়ারি হওয়া বা শারীরিক প্রশিক্ষণ নেওয়ার সুযোগ দিলে তা কীভাবে সন্ত্রাসীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়?’

হাফিজ সাঈদ ও এলইটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে পাকিস্তান সরকার ২০১৯ সালে জেইউডির কাছ থেকে এ স্থাপনার নিয়ন্ত্রণ নেয়। না হলে ‘গ্রে লিস্ট’ভুক্ত দেশের তালিকায় পড়ে যাওয়ার ঝুঁকি ছিল পাকিস্তানের। সশস্ত্র সংগঠনের অর্থায়ন বন্ধ করা বা সেগুলো নিষিদ্ধ করতে যথেষ্ট পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ বলে বিবেচিত হওয়া দেশগুলোকে এ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়ে থাকে।

ভারতের হামলায় মুজাফফরাবাদের বিলাল মসজিদের একাংশ ধসে পড়েছে। ৭ মে ২০২৫
ছবি: রয়টার্স
আরও পড়ুন

‘সাঈদ একসময় নিয়মিত আসতেন’

মসজিদের পেছনের রাস্তায় দুটি বাড়ি পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে। সৌরবিদ্যুতের প্যানেল ও ভাঙা ইট ছড়িয়ে ছিল।

হামলার রাতের ঘটনা স্মরণ করে আলী জাফর নামের একজন বাসিন্দা জানান, তিনি ওই এলাকায়ই থাকতেন। তবে সপরিবার আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তিনি বলেন, অন্তত সাত কিলোমিটার দূরের এ বাড়ি থেকেও বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে।

সরকারি কর্মকর্তা হাসান বলেন, মাদ্রাসা ও স্কুল বন্ধ থাকলেও পুরো কম্পাউন্ড কড়া নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়েছিল।

‘২০১৯ সালে সরকার প্রতিষ্ঠানটি নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার পর থেকেই আমরা নিশ্চিত করি যে পাঠ্যক্রম ও শিক্ষাদান পুরোপুরি সরকারি তদারকিতে চলছে’, বলেন হাসান। তিনি জানান, সরকার প্রতিষ্ঠানটির দায়িত্ব নেওয়ার পর হাফিজ সাঈদ এখানে আসা বন্ধ করে দেন। তিনি ৯০ দশকের শেষদিকে ও ২০০০–এর দশকের শুরুতে এখানে নিয়মিত আসতেন।

৭০ বছর বয়স পেরোনো হাফিজ সাঈদ বর্তমানে ২০১৯ সালের একটি মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন। ২০২২ সালে পাকিস্তানের আদালত তাঁকে ‘সন্ত্রাসবাদে’ অর্থায়ন করার অভিযোগের ২ মামলায় ৩১ বছরের কারাদণ্ড দেন। এর আগে ২০২০ সালে একই অভিযোগের আরেকটি মামলায় তাঁকে ১৫ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

আরও পড়ুন