খাবারে বিষ দেওয়ার অভিযোগ করলেও মুখতারের চিকিৎসায় ব্যবস্থা নেয়নি যোগীর সরকার

মুখতার আনসারিছবি: এএনআই ফাইল ছবি

ভারতের উত্তর প্রদেশের সাবেক বিধায়ক মুখতার আনসারি মৃত্যুর আগে একটি বিশেষ আদালতে অভিযোগ করেছিলেন, তাঁকে কারাগারে বিষ মেশানো খাবার খাওয়ানো হয়েছে। ৪০ দিনে অন্তত দুবার তাঁকে বিষ মেশানো খাবার দেওয়া হয়েছে। এমন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত বান্দা শহরের কারা কর্মকর্তাদের জবাব চেয়েছিলেন। সেই মুখতার আনসারি গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে মারা গেছেন।

কারাগারে অসুস্থ হয়ে পড়লে মুখতারকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। এর কয়েক ঘণ্টা পর তিনি মারা যান। চিকিৎসকেরা বলছেন, হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হয়ে তাঁর মৃত্যু হয়েছে। আর পরিবার বলছে, জেলে তাঁকে ধীরে ধীরে বিষ প্রয়োগ করা হয়েছে। ঘটনার এক সপ্তাহ আগেও পেটে ব্যথা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন সাবেক এ বিধায়ক।

উত্তর প্রদেশের বারাবাঁকির পার্লামেন্ট সদস্য ও বিধায়কদের জন্য গঠিত বিশেষ আদালতের বিচারপতি কমল কান্ত শ্রীবাস্তব ২১ মার্চ  মুখতার আনসারির করা আবেদনের শুনানি করেন। বিচারপতি ওই শুনানি শেষে বান্দা কারাগারের তত্ত্বাবধায়ককে নির্দেশ দিয়েছিলেন, যেন তিনি ২৯ মার্চের মধ্যে মুখতারের শারীরিক ও নিরাপত্তা-সংক্রান্ত বিষয়ে প্রতিবেদন দেন। আদালতের ওই আদেশের একটি অনুলিপি হাতে পেয়েছে দ্য ওয়্যার।

২১ মার্চ বারাবাঁকি আদালতে জমা দেওয়া আবেদনে মুখতার অভিযোগ করেন, ১৯ মার্চ রাতে তাঁকে কারাগারে যে খাবার দেওয়া হয়েছিল, তাতে বিষাক্ত উপাদান মেশানো হয়েছিল। আর সে কারণে তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন।

মুখতার আনসারি বলেছিলেন, ওই খাবার খাওয়ার পর তাঁর অস্বস্তি হচ্ছিল। শুরুতে তাঁর হাত-পায়ে ব্যথা হয়। পরে পুরো শরীরে ব্যথা ছড়িয়ে পড়ে। আবেদনে তিনি বলেন, ‘আমার হাত আর পা ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিল। মনে হচ্ছিল, আমি মারা যাচ্ছি। অস্বস্তি বোধ হচ্ছিল। এর আগে আমার শরীর পুরোপুরি ঠিক ছিল।’  

মুখতার তাঁর দুই পৃষ্ঠার আবেদনে আরও অভিযোগ করেন, ওই ঘটনার প্রায় ৪০ দিন আগে তাঁকে খাবারের সঙ্গে ‘বিষ’ দেওয়া হয়েছিল। ওই খাবার মুখতারকে দেওয়ার আগে ওই খাবারের স্বাদ নিয়েছিলেন এমন একজনও অসুস্থ বোধ করেছিলেন। এ ছাড়া কারাগারের আরও কয়েকজন সদস্য অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁদের সবারই চিকিৎসা করতে হয়েছে।

মুখতার আদালতের কাছে আবেদন জানিয়েছিলেন যেন পুরো ঘটনাটির তদন্ত হয় এবং তাঁর চিকিৎসার জন্য যেন একটি মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়। নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণেরও আবেদন জানিয়েছিলেন তিনি।

আরও পড়ুন

মুখতার বলেন, ‘কারাগারে আমার প্রাণনাশের হুমকি বেড়েছে। যেকোনো সময় আমার সঙ্গে অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু ঘটে যেতে পারে।’ সাবেক এই বিধায়ক অভিযোগ করেছিলেন, বড় কোনো ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে তাঁকে বিষ প্রয়োগ করা হচ্ছে।

মুখতারের করা গুরুতর অভিযোগগুলো আমলে নিয়ে বান্দা জেলা কারাগারের তত্ত্বাবধায়ককে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন বিচারপতি শ্রীবাস্তব। কারাবিধি মেনে মুখতারের স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও চিকিৎসা করানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন।

মুখতারের নিরাপত্তা নিশ্চিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতেও কারা কর্মকর্তাকে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। এ ঘটনায় কারাগারের তত্ত্বাবধায়ককে ২৯ মার্চের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। আদালতের আদেশের একটি অনুলিপি প্রয়াগরাজের কারা উপমহাপরিদর্শকের কাছে পাঠানো হয়। প্রয়াগরাজের আওতাভুক্ত বান্দা কারাগার।

২১ মার্চ বান্দা জেলা কারাগারের উপ-তত্ত্বাবধায়ক মাহেন্দ্র সিং আদালতকে বলেন, ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে মুখতার আনসারিকে আদালতে উপস্থাপন করা যাচ্ছে না। কারণ তিনি অসুস্থ। ওই কর্মকর্তা আদালতে আরও বলেন, আনসারির স্বাস্থ্যের অবনতি হয়েছে। তাঁর চিকিৎসা চলছে।

ছেলে যা বলছেন
মুখতার আনসারির ছেলে উমর আনসারি গত বছর সুপ্রিম কোর্টে একটি আবেদন দাখিল করেছিলেন। সেখানে তিনি বলেছিলেন, রাজ্য সরকার বান্দা কারাগারের ভেতর মুখতার আনসারিকে হত্যা করার পরিকল্পনা করছে। বিভিন্ন ফৌজদারি মামলায় অভিযুক্ত মুখতার ওই কারাগারেই বন্দী ছিলেন।

গতকাল তাঁর মৃত্যুর পর ছেলে উমর আবারও একই অভিযোগ সামনে এনেছেন। আদালতে মুখতারের করা অভিযোগের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, ‘আমি অভিযোগ করার মতো কেউ নই। যাকে (মুখতার) বিষ প্রয়োগ করা হয়েছে, তিনি নিজেই অভিযোগ করে গেছেন, তাঁকে ১৯ মার্চ রাতের খাবারের সঙ্গে বিষ মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে।’

উমর আরও বলেন, মৃত্যুর দুদিন আগেও মুখতার আনসারিকে পেটে ব্যথার কারণে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। কিন্তু উমরকে তখন বাবার সঙ্গে দেখা করার অনুমতি দেওয়া হয়নি। গণমাধ্যম সূত্রে তিনি বাবার মৃত্যুর খবর পেয়েছেন।

উমর মনে করেন, মুখতারের মৃত্যুর ঘটনায় তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। বাবার মৃত্যুর ঘটনায় আইনি লড়াই চালাতে চান তিনি।

আরও পড়ুন
মুখতার আনসারি
ছবি: এএনআই ফাইল ছবি

২০১৭ সালে উত্তর প্রদেশ রাজ্যে যোগী আদিত্যনাথের নেতৃত্বে ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) সরকার গঠন করে। এর পর থেকে আদিত্যনাথ সরকারের নজরদারিতে ছিলেন মুখতার আনসারি। গতকাল বৃহস্পতিবার রাত ৮টা ২৫ মিনিটের দিকে মুখতার তাঁর কারাকক্ষে অজ্ঞান হয়ে পড়েন। এর আগে তাঁর বমি হয়। অজ্ঞান হওয়ার পর মুখতারকে রানি দুর্গাবতী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। মেডিকেল কলেজটির এক বিবৃতিতে এ কথা জানানো হয়েছে।

উত্তর প্রদেশের কারা বিভাগ বলেছে, মঙ্গলবার রাতে হঠাৎই মুখতারের শারীরিক অবস্থা খারাপ হয়ে পড়ায় তাঁকে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তিনি শৌচাগারে পড়ে গিয়েছিলেন। কারা অধিদপ্তরের এক মুখপাত্র বলেন, কারাগারের চিকিৎসকেরা প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়ার পর মধ্যরাতে তাঁকে বান্দা মেডিকেল কলেজে স্থানান্তর করা হয়েছিল।

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, ২৬ মার্চ রাত ৩টা ৫৫ মিনিটের দিকে মুখতারকে ভর্তি করা হয়েছিল। তিনি পেটে ব্যথার কথা বলেছিলেন। তাঁর পায়খানা হচ্ছিল না এবং ৪-৫ দিন ধরে পেটে গ্যাস জমে ছিল। মুখতারকে হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছিল। আইসিইউ থেকে ছাড়া পাওয়ার পর তাঁকে আবার জেলে পাঠানো হয়েছিল। সেদিন মুখতারের ভাই আফজাল আনসারি অভিযোগ করেন, তাঁর ভাইকে খাবারের সঙ্গে বিষাক্ত কিছু মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে। কারাগারে তাঁকে মেরে ফেলার ষড়যন্ত্র চলছে।

আদালতে গিয়েছিলেন উমরও  
গত ডিসেম্বরে উমর আনসারি সুপ্রিম কোর্টে একটি রিট আবেদন করেন। বাবাকে উত্তর প্রদেশের কারাগার থেকে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার আরজি জানান তিনি। ২০২৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর আদিত্যনাথ সরকার সুপ্রিম কোর্টকে আশ্বস্ত করেছিল, হেফাজতে থাকা অবস্থায় মুখতারের যেন কোনো ক্ষতি না হয়, তা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সুপ্রিম কোর্টে করা আবেদনে উমর লোকসভার সদস্য এবং রাজনীতিবিদ আতিক আহমদ ও তাঁর ভাই আশরাফ আহমদের মৃত্যুর প্রসঙ্গও উল্লেখ করেছিলেন। ২০২৩ সালের এপ্রিলে পুলিশি পাহারায় এই দুই ভাইকে নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য নেওয়ার সময় হাসপাতাল প্রাঙ্গণে গুলি করে হত্যা করা হয়। ঘটনার সময় তাঁরা সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলছিলেন। দুর্বৃত্তরা সাংবাদিক সেজে টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে তাঁদের গুলি করে হত্যা করে।

আদালতে করা আবেদনে উমর অভিযোগ করেন, আদিত্যনাথ সরকার তাঁর বাবার বিরুদ্ধে ‘বিদ্বেষপূর্ণ’ অবস্থান নিয়েছে। কারাগারে থাকাকালে তাঁকে নির্মূল করতে বড় ষড়যন্ত্র চলছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি।

২০২৪ সালের ১৬ জানুয়ারি বিচারপতি ঋষিকেশ রায় এবং প্রশান্ত কুমার মিশ্রর ডিভিশন বেঞ্চ উত্তর প্রদেশ সরকারকে নির্দেশ দেয়, তারা যেন মুখতারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়।

ভিম আর্মির নেতা চন্দ্রশেখর আজাদ সাবেক বিধায়ক মুখতারের মৃত্যুর ঘটনায় কেন্দ্রীয় তদন্ত ব্যুরোর (সিবিআই) মাধ্যমে তদন্ত দাবি করেন।

এআইএমআইএমের সভাপতি আসাদউদ্দিন ওয়াইসি বলেছেন, এই মৃত্যুর ঘটনা ‘নিন্দনীয়’। মুখতার কারা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে তাঁকে বিষ প্রয়োগ করা হচ্ছে বলে ‘গুরুতর অভিযোগ’ আনার পরও রাজ্য সরকার তাঁর চিকিৎসায় কোনো মনোযোগ দেয়নি।