‘হঠাৎ বিচ্ছিন্ন হওয়ায় ওরা ট্রমায় ভুগছে, ঘুমের মধ্যে মাকে ডাকছে’

মা ইরামকে জড়িয়ে ধরে আছে মোহাম্মদ শেহবাজের ছেলে আলমির। গত ২৯ এপ্রিল ইরামকে যখন পাকিস্তানে ফেরত পাঠানো হচ্ছিল, সেই সময়ের দৃশ্যছবি: আল-জাজিরার প্রতিবেদন থেকে নেওয়া স্ক্রিনশট

ফেরিওয়ালাদের হাঁকডাক আর দুই শিশুর বিরামহীন কান্না নীরবতা ভেঙে দেয় ভারতশাসিত কাশ্মীরের প্রধান শহর শ্রীনগরের সরু গলির। ‘আন্টি, আমাকে মায়ের কাছে নিয়ে যান; পুলিশ তাঁকে নিয়ে গেছে’—চিৎকার করে কাঁদছিল তিন বছরের হুসাইন। সঙ্গে তার বোন নুরি। সে তার চেয়ে এক বছরের ছোট। দুজনই এক কামরার ছোট ঘরের জানালা ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। মরচে ধরা লোহার গ্রিলের ফাঁকে তাদের মুখ চেপে আছে।

হুসাইন ও নুরির বাবা মজিদ বলেন, সাত মাসের বেশি সময় ধরে প্রায় প্রত্যেক পথচারীকেই এভাবে ডাকছে দুই শিশু। ওদের মা সামিনা পাকিস্তানের নাগরিক। ভারতীয় কর্তৃপক্ষ জোর করে তুলে নিয়ে গিয়ে যখন সামিনাকে দেশ থেকে বের করে দিল, তখন থেকেই ওরা কাঁদছে।

পরিবারটির দুর্ভোগের শুরু হয় একটি ভয়াবহ ঘটনার পর। ছয় বন্দুকধারী গত ২২ এপ্রিল ভারতশাসিত কাশ্মীরের পেহেলগাম এলাকায় একটি পর্যটনকেন্দ্রে হামলা চালায়। হামলায় ২৬ জন নিহত হন। বন্দুকধারীদের দুজন পাকিস্তানি বলে অভিযোগ ভারতের।

মুসলিম-অধ্যুষিত অঞ্চল কাশ্মীর ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বিভক্ত। দুই প্রতিবেশীই পুরো অঞ্চল নিজেদের দাবি করে থাকে। আঞ্চলিক পরাশক্তি চীনও কাশ্মীরের একটি ছোট অংশ নিয়ন্ত্রণ করে। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে স্বাধীনতা লাভ করার পর ১৯৪৭ সাল থেকে দুই দেশ (ভারত-পাকিস্তান) তাদের তিনটি বড় যুদ্ধের দুটিতেই লড়েছে কাশ্মীর নিয়ে।

পেহেলগাম হামলার পর ভারত সে দেশে থাকা পাকিস্তানের নাগরিকদের চিকিৎসা, কূটনৈতিক ভিসাসহ সব ধরনের ভিসা বাতিল করে। তাঁদের গত ২৯ এপ্রিলের মধ্যে দেশ ছাড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। ১ মে বন্ধ করে দেওয়া হয় পাঞ্জাবের অমৃতসরের আটারি-ওয়াঘা সীমান্ত।

১৯৮০-এর দশকের শেষ দিকে জম্মু ও কাশ্মীরে ভারতীয় শাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহ শুরু হয়। তখন থেকে ১০ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন, যাঁদের বেশির ভাগই সাধারণ মানুষ। বিদ্রোহ দমনে প্রায় ১০ লাখ ভারতীয় সেনা মোতায়েন করা হয়, যা এটিকে বিশ্বের সবচেয়ে সামরিকীকরণ করা অঞ্চলের একটিতে পরিণত করে। বিদ্রোহীদের লক্ষ্য ছিল, স্বাধীন কাশ্মীর গড়া বা অঞ্চলটিকে পাকিস্তানের সঙ্গে একত্র করা।

২০১৯ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির হিন্দুত্ববাদী সরকার কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল করে। এ মর্যাদার অধীন অঞ্চলটি ভূমির মালিকানা ও জীবিকা–সংক্রান্ত কিছু বিষয়ে আংশিক স্বায়ত্তশাসন পেত। এ মর্যাদা বাতিল করে অঞ্চলটিকে দুটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে ভাগ করা হয়, যেগুলো সরাসরি নয়াদিল্লি থেকে পরিচালিত হচ্ছে। এর পর থেকেই সন্দেহভাজন কাশ্মীরী বিদ্রোহীরা ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনী ও সরকারি কর্মীদের ওপর হামলা বাড়ান। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে এই বিদ্রোহীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া ও আর্থিক সহায়তা করার অভিযোগ তোলে ভারত। পাকিস্তান তা অস্বীকার করে এবং বলে, তারা শুধুই কাশ্মীরের জনগণের সংগ্রামে কূটনৈতিক সমর্থন দেয়।

ভারত পেহেলগাম হামলার জন্যও পাকিস্তানকে দায়ী করে। এরপর দ্রুত কূটনৈতিক সম্পর্ক কমিয়ে ফেলে, দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য স্থগিত করে এবং গুরুত্বপূর্ণ এক পানিবণ্টন চুক্তি ঝুলিয়ে দেয়। হত্যাকাণ্ডের দুই সপ্তাহ পর মে মাসের শুরুতে দুই দেশ চার দিনের সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে। এ সময় একে অপরের সামরিক ঘাঁটিতে হামলা হয়। দুই পক্ষেই অনেকে নিহত হন। ভারত দাবি করে, তারা শুধু ‘সন্ত্রাসীদের’ লক্ষ্য করেছে; আর পাকিস্তান বলে, বেশির ভাগ নিহত ব্যক্তিই ছিলেন সাধারণ মানুষ। পরে দুই দেশ যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়।

কখনো কখনো মনে হয়, জীবন শেষ করে দিই। কিন্তু থেমে যাই। আমার পরে ওদের দেখভাল করবে কে?
—মজিদ, শিশু হুসেইন ও নুরির ভারতীয় বাবা

কিন্তু সাত মাস পরও ওই যুদ্ধবিরতি মজিদ ও সামিনার পরিবারের মতো শত শত ভাঙা পরিবারের জন্য কোনো স্বস্তি আনতে পারেনি।

পেহেলগাম হামলার পর ভারত সে দেশে থাকা পাকিস্তানের নাগরিকদের চিকিৎসা, কূটনৈতিক ভিসাসহ সব ধরনের ভিসা বাতিল করে। তাঁদের গত ২৯ এপ্রিলের মধ্যে দেশ ছাড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। ১ মে বন্ধ করে দেওয়া হয় পাঞ্জাবের অমৃতসরের আটারি-ওয়াঘা সীমান্ত।

এ নির্দেশের ফলে প্রায় ৮০০ পাকিস্তানি বহিষ্কৃত হন। তাঁদের অনেকেই কাশ্মীর ও ভারতের অন্যান্য জায়গায় ভারতীয় স্বামী-স্ত্রীসহ বসবাস করতেন। তাঁদের আবার একত্র হওয়া নিয়ে কর্তৃপক্ষ কোনো স্পষ্ট নির্দেশনা দেয়নি। এ কারণে সীমান্তের দুদিকেই পরিবারগুলো অনিশ্চয়তায় দিন কাটাচ্ছে এখনো।

‘আমি ভাবি, জীবন শেষ করে দিই’

ভারতীয় নাগরিক মজিদ ২০১৮ সালে তাঁর পাকিস্তানি চাচাতো বোন সামিনাকে (৩৮) বিয়ে করেন।

দুই দেশের মধ্যে টানাপোড়েন থাকলেও এমন বিয়ে অস্বাভাবিক নয়। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় লাখো মুসলমান পাকিস্তানে এবং বহু হিন্দু ভারতে চলে যান। আবার দুই পাশেই থেকে যান তাঁদের অনেক আত্মীয়। সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে এ আত্মীয়তার সূত্রে দুই দেশের নাগরিকদের মধ্যে গড়ে ওঠে সীমান্তপারের বিয়ের সম্পর্কও।

গত ২৮ এপ্রিল, সামিনাকে শ্রীনগরের ডালগেট এলাকার থানায় ডাকা হয়। নুরি ও হুসাইন মা–বাবার কোলে ঘুমাচ্ছিল। জেগে উঠে তারা দেখে, তারা বাবার সঙ্গে বাড়িতে ফিরে এসেছে; মা নেই। সামিনাকে পুলিশ আটক করে জানায়, পরদিনই তাঁকে পাকিস্তানে ফেরত পাঠানো হবে। তিনি মূলত লাহোরের বাসিন্দা।

কিন্তু গত ২৮ এপ্রিল সামিনাকে শ্রীনগরের ডালগেট এলাকার থানায় ডাকা হয়। নুরি ও হুসাইন মা–বাবার কোলে ঘুমাচ্ছিল। জেগে উঠে দেখে, তারা বাবার সঙ্গে বাড়িতে ফিরে এসেছে; মা নেই।

সামিনাকে পুলিশ আটক করে জানায়, পরদিনই তাঁকে পাকিস্তানে ফেরত পাঠানো হবে। তিনি মূলত লাহোরের বাসিন্দা।

অন্ধকার ছোট ঘরে বসে মজিদ বলেন, এখনো তিনি এ অঘটন মানতে পারেন না।

মজিদ একটি স্থানীয় রেস্তোরাঁয় ওয়েটারের কাজ করতেন। মাসে প্রায় ৭০ ডলার আয় করতেন। কিন্তু স্ত্রীকে হারানোর পর তিনি দুই শিশুকে একা রেখে কাজে যেতে পারেন না। এখন তাঁর কোনো আয়ের পথ নেই।

মজিদ বলেন, ‘ছয় মাস ধরে ঠিকমতো ঘুমাতে পারছি না। সারাক্ষণ সন্তানদের দেখাশোনা করছি। অন্য কিছু ভাবার অবকাশ নেই।’

আল-জাজিরার ‘অশুভ উদ্দেশ্য’ রয়েছে। আপনারা ভারত ও ভারত সরকারের বিরুদ্ধে কিছু খুঁজতে চান। তা সফল হবে না।
—শাজিয়া ইলমি, বিজেপির মুখপাত্র

ঘরবন্দী জীবন। বাসার বাইরে গিয়ে বাজারও করতে পারেন না, ‘কখনো কখনো মনে হয়, জীবন শেষ করে দিই; কিন্তু থেমে যাই। আমার পরে ওদের দেখভাল করবে কে?’

মজিদের দুই শিশুসন্তান হুসাইন ও নুরি জানে না, তারা কবে মাকে দেখতে পাবে। মজিদ বলেন, ‘হঠাৎ বিচ্ছিন্ন হওয়ায় ওরা ট্রমায় ভুগছে। ঘুমের মধ্যে মাকে ডাকছে।’

আল-জাজিরাকে মজিদ জানান, মুঠোফোনে কার্টুন দেখিয়ে সন্তানদের মনোযোগ সরানোর চেষ্টা করলেও কাজ হয় না। তিনি আরও বলেন, ‘ওরা শুধু জানে, পুলিশ মাকে নিয়ে গেছে। কোনো পুলিশ বা সেনা কর্মকর্তাকে দেখলেই বলে, “আমার মাকে ফিরিয়ে দিন।”’

‘সন্তানদের থেকে বিচ্ছিন্ন সামিনাও পাকিস্তানে মানসিক চাপে ভুগছেন। তাঁর রক্তচাপ ওঠানামা করছে। ঘন ঘন হাসপাতালে নিতে হচ্ছে। রক্তচাপ স্থির হচ্ছে না,’ বলেন মজিদ।

ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপির মুখপাত্র শাজিয়া ইলমিকে পাকিস্তানিদের বহিষ্কার করা নিয়ে প্রশ্ন করেছিল আল-জাজিরা। জবাবে তিনি বলেছেন, ‘বিষয়টি জাতীয় নিরাপত্তার সঙ্গে সম্পর্কিত।’ তিনি দাবি করেন, বহিষ্কৃত ব্যক্তিদের অনেকেই ভারতে এমন লোকদের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ ছিলেন, যাঁদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ বা রাষ্ট্রবিরোধী কাজে যুক্ত থাকার তথ্য পাওয়া গেছে।

দুই দেশের মধ্যে টানাপোড়েন থাকলেও এমন বিয়ে অস্বাভাবিক নয়। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় লাখো মুসলিম পাকিস্তানে এবং বহু হিন্দু ভারতে চলে যান। আবার দুই পাশেই থেকে যান তাঁদের অনেক আত্মীয়। সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে এ আত্মীয়তার সূত্রে দুই দেশের নাগরিকদের মধ্যে গড়ে ওঠে সীমান্তপারের বিয়ের সম্পর্কও।

শাজিয়া আরও বলেন, ‘এভাবে পাকিস্তানিরা বিয়ে করে ভারতে এসে এ ধরনের কাজ করতে পারেন না। ভারত কেন পাকিস্তানি নাগরিকদের রাখবে?’ এ অভিযোগের প্রমাণ চাইলে, তিনি বলেন, ‘আল-জাজিরার “অশুভ উদ্দেশ্য”রয়েছে। আপনারা ভারত ও ভারত সরকারের বিরুদ্ধে কিছু খুঁজতে চান। তা সফল হবে না।’

কয়েক বছর পর মিললেও ১২ দিনের মাথায় আবার বিচ্ছেদ

মোহাম্মদ শেহবাজ দিল্লির ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা দারিয়াগঞ্জের বাসিন্দা। বয়স ৩২। ২০১৪ সালে পাকিস্তানি আত্মীয় ২৭ বছর বয়সী ইরামকে বিয়ে করেন তিনি। এরপর ইরাম দীর্ঘমেয়াদি ভিসায় ভারতে থাকতেন। ২০২০ সালের মার্চে তাঁদের তিন বছরের ছেলে আলমিরকে নিজ পরিবারের কাছে পরিচয় করাতে পাকিস্তান যেতে হয়।

ঠিক ১০ দিনের মাথায় কোভিড-১৯ বিধিনিষেধ শুরু হয়। ইরাম তখন পাকিস্তানে আটকে পড়েন এবং তাঁর ভারতীয় ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যায়।

বিধিনিষেধ শেষে শেহবাজ বহুবার চেষ্টা করেও স্ত্রীর ভিসা করাতে পারেননি। পাঁচ বছর পর অবশেষে গত এপ্রিল মাসে ইরাম নতুন ভিসা পান। পাঁচ বছরের বিচ্ছেদ শেষে শেহবাজের পরিবারে পুনর্মিলন ঘটেছিল।

ইরাম গত ১৭ এপ্রিল দিল্লিতে পৌঁছান। কিন্তু এর ১২ দিন পরই পেহেলগাম হামলার ঘটনাকে ঘিরে ২৯ এপ্রিল পাকিস্তানে ফেরত পাঠানো হয় তাঁকে।

সাধারণ মানুষ পরস্পরের শত্রু নয়। তবে কেন রাজনৈতিক বিবাদের শিকার হবে? কোনো সংঘাতে সাধারণ জনগণ কখনোই বলি হওয়া উচিত নয়। মাকে সন্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করা নির্মম, অমানবিক ও মানবাধিকারের লঙ্ঘন।
—শবনম হাশমি, নয়াদিল্লিভিত্তিক অধিকারকর্মী

শেহবাজ বলেন, ‘অনেক বছরের অপেক্ষা, দৌড়াদৌড়ি, কষ্ট—সব মিলিয়ে তিনি (ইরাম) ঘরে ফিরেছিলেন। মনে হয়েছিল, জীবন আলোয় ভরে উঠেছে। আর চোখের পলকে আবার সব ভেঙে পড়ল। পুলিশ এসে ইরামকে বহিষ্কার করার খবর দিলে আমি স্তব্ধ হয়ে যাই। আমার ছেলে হাউমাউ করে কাঁদছিল। সবই যেন বৃথা হয়ে গেল।’

এখন আলমিরের বয়স ৯। ছোটবেলায় বাবাকে দেখেনি (জন্মের পর পাকিস্তানে মায়ের কাছে থাকায়); এখন আবার মাকে হারিয়েছে। শেহবাজ ছোট একটি জুয়েলারি ব্যবসা চালান। তিনি ছেলেকে নিয়ে উদ্বিগ্ন। তিনি বলেন, ‘ও একদম চুপচাপ হয়ে গেছে। বাইরে থেকে বোঝা না গেলেও ভেতরে ভেঙে পড়েছে।’

শেহবাজ প্রশ্ন করেন, ‘দুই দেশের বৈরিতায় সাধারণ মানুষ কেন ক্ষতিগ্রস্ত হবে? আমাদের দোষ কী?’

আরও পড়ুন

৪০ বছর পর প্রথমবার পাঠানো হলো পাকিস্তানে

ভারতশাসিত কাশ্মীরের ৬২ বছরের ফজল-উর-রহমান জানেন না, বেঁচে থাকতে তিনি আর স্ত্রীকে দেখতে পারবেন কি না। তাঁর স্ত্রী পারভিনা (৬৫)। তাঁকে এপ্রিলে পাকিস্তানে ফেরত পাঠানো হয়। সেটা এমন এক দেশ, যেখানে তিনি ৪০ বছরের বেশি সময় যাননি।

পারভিনা পাকিস্তানের করাচিতে জন্মেছিলেন। ১৯৮২ সালে বিয়ের পর আর কখনো ফেরেননি। স্বামী-সন্তানের সঙ্গে জীবন কাটিয়েছেন বারামুল্লা জেলায়।

ফজল বলেন, ‘আমাদের ঘর ভেঙে গেছে। সব ধ্বংস হয়ে গেছে। জানি না, আর কত দিন বাঁচব।’ কথা বলতে বলতে তাঁর গলা ধরে আসে।

এই দম্পতির দুই মেয়ে। বড় মেয়ে আফরিন বিবাহিত। ছোট মেয়ে সোলিহা (২৭) বাসায় থাকেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে মাস্টার্স করছেন।

সোলিহা বলেন, ‘জুলাইয়ে আমার মিডটার্ম পরীক্ষা ছিল। সব একা সামলাতে গিয়ে দিতে পারিনি। ওষুধ, বাজার—সব আমাকে করতে হয়।’

সোলিহা জানান, তাঁর মা কাশ্মীরে হৃদ্‌রোগের চিকিৎসা নিচ্ছিলেন। কিন্তু পাকিস্তানে কোনো নিকটাত্মীয় নেই, আর্থিকভাবে সহায়তাকারীও কেউ নেই। করাচিতে দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা এক দূরসম্পর্কের আত্মীয়ের বাড়িতে থাকছেন, যিনি নিজেও পক্ষাঘাতে আক্রান্ত।

আরও পড়ুন

সোলিহা বলেন, ‘মাকে দেখাশোনা করার কেউ নেই। মায়ের কিছু হলে ভারত সরকারই দায়ী হবে। অন্য কেউ অপরাধ করলে আমাদের কেন শাস্তি দেওয়া হচ্ছে? আমার পড়াশোনা ও ক্যারিয়ার ঝুঁকির মুখে। মায়ের নির্বাসনের কারণে আমি মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যারও সম্মুখীন হচ্ছি।’

এদিকে ফজল ক্ষুব্ধ হয়ে বলেন, ‘কাশ্মীরে সাত থেকে আট লাখ ভারতীয় সেনা আছে। তারা যদি পেহেলগাম হামলা ঠেকাতে না পারে, তবে সাধারণ মানুষকে দায়ী করা হচ্ছে কেন?’

সোলিহা ভারত সরকারের কাছে আবেদন করেন, ‘নিজেদের নাগরিকদের শাস্তি দেওয়া বন্ধ করুন। আমাদের আপনজনদের ফিরিয়ে দিন।’

আরও পড়ুন

‘কারণ তাঁরা পাকিস্তানি ও মুসলিম’

মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, দুই দেশের রাজনৈতিক উত্তেজনার কারণে নিরপরাধ সাধারণ মানুষকে এভাবে শাস্তি দেওয়ার কোনো যুক্তি নেই।

নয়াদিল্লিভিত্তিক অধিকারকর্মী শবনম হাশমি বলেন, ‘সাধারণ মানুষ পরস্পরের শত্রু নয়। তবে কেন রাজনৈতিক বিবাদের শিকার হবে? কোনো সংঘাতে সাধারণ জনগণের কখনোই বলি হওয়া উচিত নয়। মাকে সন্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করা নির্মম, অমানবিক ও মানবাধিকারের লঙ্ঘন।’

কাশ্মীরের রাজনীতিক ও পিডিপির নেতা ওয়াহিদ প্যারা বলেন, পাকিস্তানি নাগরিকদের বহিষ্কার করা অন্যায় ও দুর্ভাগ্যজনক। মোদির সরকারের দিকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, ‘কাশ্মীর কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হওয়ার পর আমাদের প্রভাব বা এমন সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা কমে গেছে। আমরা শুধু আওয়াজ তুলতে পারি, হস্তক্ষেপের চেষ্টা করতে পারি, কিন্তু সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় অন্যত্র।’

আরও পড়ুন

‘সীমান্তে গোলাবর্ষণে সাধারণ মানুষ মারা যায়। ভারত-পাকিস্তান বিরোধের সবচেয়ে বড় শিকার হয় নারী-শিশুরা। এটি খুবই দুঃখজনক,’ বলেন পিডিপির এই নেতা।

ভারতের সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মী কলিন গনসালভস বলেন, পাকিস্তানি নাগরিকদের বহিষ্কারের সঙ্গে পেহেলগাম হামলার কোনো যৌক্তিক সম্পর্ক নেই। তিনি বলেন, ‘সরকার এটিকে পেহেলগাম হামলার ফলাফল বলে দাবি করতে পারে। কিন্তু এ দাবি শুধু বিভ্রান্তিকরই নয়; বিপজ্জনকও। তাঁদের বহিষ্কার করার একটাই কারণ, তাঁরা পাকিস্তানি ও মুসলিম।’

পাকিস্তানি স্ত্রী তামারাহকে হারানোর কথা মনে করে কুপওয়ারার বাসিন্দা আবদুল্লাহ চোখ মুছতে মুছতে বলেন, ‘ভারত সরকার আমাদের সঙ্গে যা করেছে, তা পেহেলগামের হামলাকারীরা যা করেছে, তা থেকে আলাদা কিছু নয়। তারাও (মোদি সরকার) আমাদের পরিবার ভেঙে দিয়েছে, বাড়িঘরও। আমাদের নিরপরাধ সন্তানদের কেন শাস্তি দেওয়া হচ্ছে? তাদের দোষ কী?’