কী কারণে নির্বাচনী প্রচার কৌশলে বদল আনলেন মোদি

ভারতের উত্তর প্রদেশের মহারাজগঞ্জে নির্বাচনী জনসভায় নরেন্দ্র মোদি। ২১ মে, উত্তর প্রদেশছবি: এএনআই

নির্বাচনী জনসভায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির প্রচারের কৌশল বদলের জন্য প্রধানত দায়ী কংগ্রেসের ইশতেহার। ওই ইশতেহার প্রকাশের পর থেকেই ‘উন্নয়ন, প্রগতি, বিশ্বগুরু ও মোদি কি গ্যারান্টি’ থেকে সরে প্রধানমন্ত্রী বাধ্য হয়েছেন হিন্দু–মুসলমান আখ্যান আঁকড়ে ধরতে। প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া ১১১টি ভাষণ নিরীক্ষণ করে এই তথ্য পেশ করেছে দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকা।

১৭ মার্চ থেকে মোদি শুরু করেছেন তাঁর নির্বাচনী প্রচার। ১৫ মে পর্যন্ত দেশের কোনায় কোনায় তিনি ১১১টি জনসভায় ভাষণ দিয়েছেন। সেসব ভাষণ তিনটি পর্যায়ে ভাগ করে দেখানো হয়েছে, কীভাবে মোদি উন্নয়নসহ বিভিন্ন বিষয় ছেড়ে বেশি করে আঁকড়ে ধরেছেন হিন্দু–মুসলমান, রাম মন্দির ইস্যু। অবশ্য প্রতিটি পর্বেই তাঁর আক্রমণের কেন্দ্রে রয়েছে কংগ্রেস। শতাব্দী প্রাচীন এই দলের দিকেই ধাবিত তাঁর আক্রমণের যাবতীয় তির।

১৭ মার্চ থেকে মোদি শুরু করেছেন তাঁর নির্বাচনী প্রচার। ১৫ মে পর্যন্ত দেশের কোনায় কোনায় তিনি ১১১টি জনসভায় ভাষণ দিয়েছেন। সেসব ভাষণ তিনটি পর্যায়ে ভাগ করে দেখানো হয়েছে, কীভাবে মোদি উন্নয়নসহ বিভিন্ন বিষয় ছেড়ে বেশি করে আঁকড়ে ধরেছেন হিন্দু-মুসলমান, রাম মন্দির ইস্যু।

আদর্শ নির্বাচন বিধি চালু হয় গত ১৬ মার্চ। পরদিন থেকে ৫ এপ্রিল পর্যন্ত মোদি ভাষণ দিয়েছেন ১০টি জনসভায়। সেখানে তিনি তুলে ধরেছিলেন তাঁর সরকারের উন্নয়নমুখী চরিত্র। সেই সঙ্গে জনমুখী সব প্রকল্প কীভাবে সাধারণ মানুষের উপকার করেছে, সেই কাহিনি। এরই পাশাপাশি তিনি দেখিয়েছেন কীভাবে তাঁর আমলে ভারত গোটা বিশ্বের সমীহ আদায় করেছে, কীভাবে দেশ ‘বিশ্বগুরু’র মর্যাদা পেয়েছে।

হিসাবে দেখা যাচ্ছে, ১০ জনসভার প্রতিটিতেই তিনি কংগ্রেস ও বিরোধীদের দুর্নীতি, স্বজন পোষণ ও অপশাসনের বিরুদ্ধে যেমন সরব হয়েছেন, তেমনই তুলে ধরেছেন তাঁর সরকারের উন্নয়ন ও প্রকল্পের কাহিনি। দারিদ্র্য ও নারী প্রসঙ্গে কথা বলেছেন ৯ বার। বিশ্বগুরু ও অন্য বিরোধী দল নিয়ে ৮ বার। মোদি গ্যারান্টির উল্লেখ করেছেন ৭ জনসভায়, ৬টিতে রাম মন্দির।

এই সময়ের প্রতিটি জনসভায় মোদি নিয়ম করে ‘চার শ পার’ লক্ষ্যের কথাও জাহির করেছেন। ১০ জনসভার মধ্যে ৮টিতেই বিষয়টি উল্লেখ করেছেন। তুলনায় রাম মন্দির উচ্চারিত হয়েছে কম। মাত্র ৬ বার। সেটাও এসেছে তাঁর সরকারের সাফল্য হিসেবে। স্পষ্টত, তখনো তাঁর ধারণা ছিল, ১০ বছরের কাজের খতিয়ানই তাঁকে তৃতীয়বার ক্ষমতাসীন করবে।

ছবিটা হঠাৎই বদলে যায় ৬ এপ্রিল থেকে। কারণ, কংগ্রেসের নির্বাচনী ইশতেহার। কংগ্রেসের ইশতেহার প্রকাশিত হয় ৫ এপ্রিল। পরের দিন রাজস্থানের আজমিরে মোদি টেনে আনলেন সেই ইশতেহার। বললেন, তাতে মুসলিম লীগের ছায়া স্পষ্ট।

৬ থেকে ২০ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী মোট ৩৪টি জনসভায় ভাষণ দিয়েছেন। প্রায় প্রতিটি জনসভাতেই (৩২ জনসভায়) নিয়ম করে তিনি কংগ্রেসের সমালোচনা করেছেন। ৭ জনসভায় বলেছেন, কংগ্রেসের ইশতেহার বা ‘ন্যায়পত্র’ পড়ে মনে হচ্ছে, এটা মুসলিম লীগের নির্বাচনী ইশতেহার।

১৭টি জনসভায় মোদি বলেছেন, কংগ্রেসসহ বিরোধীরা হিন্দুবিরোধী। সেই কারণেই তারা অযোধ্যায় রাম মন্দিরের অনুষ্ঠানে যায়নি। এই পর্বে মোদির ভাষণে ২৬ বার এসেছে রাম মন্দির প্রসঙ্গ। মুসলিম লীগ ও বিরোধীদের হিন্দু বিরোধিতার নমুনা অন্য সবকিছু ছাপিয়ে এই পর্বে বড় হয়ে ওঠে। আর ২৭ বার কংগ্রেসসহ বিরোধীদের তিনি দুরমুশ করেছেন দুর্নীতি নিয়ে।

পাশাপাশি এই পর্বের ৩৪টি জনসভার মধ্যে মোদি উন্নয়ন ও প্রগতির কথা বলেছেন ৩২টিতে। সরকারের জনমুখী প্রকল্পের কথা শুনিয়েছেন ৩১ বার। ১৯ বার টেনেছেন বিশ্বগুরু প্রসঙ্গ। আশ্চর্যজনকভাবে এই পর্বে ‘চার শ পার’ তাঁর মুখে এসেছে কম। মাত্র ১৩টি জনসভায় তিনি তাঁদের ওই লক্ষ্যের কথা জনতাকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন।

২১ এপ্রিল থেকে ১৫ মে পর্যন্ত মোদি ভাষণ দিয়েছেন ৬৭টি জনসভায়। এই পর্বে তাঁর কণ্ঠে সবচেয়ে বেশি শোনা গেছে জনমুখী প্রকল্প ও উন্নয়নের কথা। মোট ৬০ জনসভায় তিনি এর উল্লেখ করেছেন। তুলনায় অযোধ্যা ও রাম মন্দির প্রসঙ্গে টেনেছেন ৪৩ বার। ‘চার শ পার’ মাত্র ১৬ বার।

গত ১০ বছর ধরে নরেন্দ্র মোদি দেশকে কংগ্রেসমুক্ত করে তুলতে চাইছেন। বারবার বলেছেন কংগ্রেসমুক্ত ভারতের কথা। অথচ এবারের ভোটেও সেই কংগ্রেসই কেড়েছে তাঁর রাতের ঘুম।

১৯ এপ্রিল ছিল প্রথম দফার ভোট। তার এক দিন পর ২১ এপ্রিল মোদি অবতারণা করেন কংগ্রেসের সম্পদ বণ্টনের প্রসঙ্গ। রাজস্থানের বাঁশবাড়ার জনসভায় তিনি মুসলমান, ঘুসপেট (অনুপ্রবেশকারী) ও মঙ্গলসূত্র কেড়ে নেওয়া নিয়ে সরব হন। মোট ১১১ জনসভায় ১২ বার তিনি অনুপ্রবেশের বিষয়টি টেনে এনেছেন। মঙ্গলসূত্র বা স্ত্রী ধনের বিষয়টি উল্লেখ করেছেন ২৩ জনসভায়।

এই পর্বে মোদির ভাষণে সবকিছু ছাপিয়ে প্রাধান্য পেয়েছে হিন্দু–মুসলমান, মুসলমান ভোট ব্যাংককে সম্পদ বিলি, তফসিল জাতি, উপজাতি ও অনগ্রসরদের সংরক্ষণ ‘লুট’ করে মুসলমানদের মধ্যে বিলি করার প্রসঙ্গ। ৬৭ জনসভার মধ্যে ৬০টিতেই তিনি সরগরম হয়েছেন এই বিষয়ে।

মোদি অবশ্য দারিদ্র্য দূর করার প্রতিশ্রুতির কথা বারবার শুনিয়েছেন। কীভাবে তাঁর সরকার গত এক দশকের রাজত্বে ২৫ কোটি মানুষকে দারিদ্র্যসীমার ওপরে নিয়ে এসেছেন, সেটি উল্লেখ করেছেন ১১১ জনসভার ৮৪টিতে। তিনি বারবার বলেছেন, তাঁর কাছে জাত মোট চারটি। নারী, যুবা, কৃষক ও দরিদ্র।

মোদি কৃষক প্রসঙ্গ উল্লেখ করেছেন ৬৯টি ভাষণে। যুবা প্রসঙ্গ ৫৬টিতে। মোদি মনে করেন, মহিলা ক্ষমতায়ন তাঁর তুরুপের তাস হবে। ৮১ বার সেই প্রসঙ্গে তিনি সরব হয়েছেন। টেনে এনেছেন রান্নার গ্যাস উজ্জ্বলা প্রকল্পের কথা এবং সংসদে ৩৩ শতাংশ নারী সংরক্ষণের বিষয়টি।

১০ বছর ধরে নরেন্দ্র মোদি দেশকে কংগ্রেসমুক্ত করে তুলতে চাইছেন। বারবার বলেছেন কংগ্রেসমুক্ত ভারতের কথা। অথচ এবারের ভোটেও সেই কংগ্রেসই কেড়েছে তাঁর রাতের ঘুম। পরিহাসের বিষয়, তাঁর প্রচারের অভিমুখ ঠিক করে দিয়েছে ওই দলের নির্বাচনী ইশতেহার।