উজরা জেয়ার ভারত সফরে গুরুত্ব পাবে গণতন্ত্র, আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা

মার্কিন আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়া
ছবি: এএফপি

মার্কিন বেসামরিক নিরাপত্তা, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার–সম্পর্কিত আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়া আজ শনিবার দিবাগত রাতে ভারত সফরে আসছেন। সফরকালে তিব্বতি ধর্মগুরু দালাই লামার সঙ্গে তাঁর দেখা করার কথা রয়েছে। ৬ জুলাই ছিল দালাই লামার ৮৮তম জন্মদিন।

দালাই লামার সঙ্গে উজরার সাক্ষাৎ চীনের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের আরও এক স্পষ্ট বার্তা। প্রবীণ এই ধর্মগুরুকে উজরা আগেই জন্মদিনের শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়ে বলেছেন, সহমর্মিতা, সহিষ্ণুতা ও সবার মানবাধিকার রক্ষায় তাঁর বার্তা সদা অনুসরণযোগ্য। ভারত বা দালাই লামার কার্যালয় থেকে এই বিষয়ে কোনো মন্তব্য অবশ্য করা হয়নি। ভারত সফর শেষে উজরা যাবেন বাংলাদেশে। সেখান থেকে তিনি দেশে ফিরবেন ১৪ জুলাই।

উজরা জেয়ার এই সফর যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ঘোষণা করেছে। ভারতে তাঁর কর্মসূচি কী, সে বিষয়ে এ দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আজ সন্ধ্যা পর্যন্ত অবশ্য কিছু জানায়নি। যদিও যুক্তরাষ্ট্র জানিয়েছে, গণতন্ত্র, আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা, বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জের সমাধান, মানবিক ত্রাণ ও দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের বিভিন্ন দিক নিয়ে সরকারি কর্তাদের সঙ্গে তিনি আলোচনা করবেন।

সরকারি সূত্র অনুযায়ী, উজরা ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বিনয় কোয়াত্রার সঙ্গে বৈঠক করবেন। সেই আলোচনায় বাংলাদেশ–ভারত সম্পর্কের বিভিন্ন দিক, গণতান্ত্রিক আবহ ও আঞ্চলিক সুস্থিতি প্রাধান্য পাবে। বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মাও এই সফর উপলক্ষে দিল্লি এসেছেন। বৈঠকে তিনিও থাকবেন বলে সরকারি সূত্রের খবর।

বাংলাদেশে উজরার আলোচনার বিষয়গুলোর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হলো সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন এবং মানবাধিকার রক্ষা, যা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র যথেষ্ট উদ্বিগ্ন। নির্বাচন সুষ্ঠু, অবাধ ও শান্তিপূর্ণ হওয়ার পথে যাঁরা অন্তরায় হবেন, তাঁদের ভিসা দেবে না বলে যুক্তরাষ্ট্র কিছুদিন আগে নতুন নীতি ঘোষণা করেছে। স্বাভাবিকভাবেই উজরা জেয়ার বাংলাদেশ সফর যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। মনে করা হচ্ছে, এ সফরে তিনি নির্বাচনের পটভূমিতে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করবেন। সরকারি–বেসরকারি ও বিভিন্ন মহলের সঙ্গে কথা বলে তিনি দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা বোঝার চেষ্টা করবেন। এ ছাড়া বাংলাদেশ সফরকালে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বিষয় নিয়েও বিভিন্ন মহলের সঙ্গে কথা বলবেন।

যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র ও মানবাধিকার–সম্পর্কিত আন্ডার সেক্রেটারির একযোগে ভারত ও বাংলাদেশ সফর একাধিক কারণে বিশেষ গুরুত্ব পাচ্ছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরের পর এই প্রথম যুক্তরাষ্ট্রের কোনো মন্ত্রী ভারত সফর শুরু করছেন। সেই মন্ত্রী আবার গণতন্ত্র ও মানবাধিকার বিষয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত, যার ক্রমাবনতি নিয়ে পশ্চিমা সরকারি–বেসরকারি সংগঠনগুলো ধারাবাহিক সমালোচনা করে চলেছে।

প্রধানমন্ত্রী মোদিকেও যুক্তরাষ্ট্র সফরের সময় তা নিয়ে প্রকাশ্যে জবাবদিহি করতে হয়েছে। হোয়াইট হাউসে দাঁড়িয়ে তিনি সব অভিযোগ অস্বীকার করলেও ধর্মীয় স্বাধীনতাহীনতা, মানবাধিকার, সংখ্যালঘু নির্যাতনের মতো বিষয়গুলো নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মত বদলেছে মনে করার কারণ নেই। ভারতের গণতন্ত্রের অধোগমন নিয়ে অনেক দিন ধরেই তারা তাদের দুশ্চিন্তা ব্যক্ত করে আসছে। এখন দেখার, এ নিয়ে উজরা কী মন্তব্য করেন।

এই দুশ্চিন্তারই প্রকাশ ঘটেছে ভারতে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত এরিক গারসেটির সাম্প্রতিক মন্তব্যে। কলকাতায় এক সংবাদ সম্মেলনে মণিপুরের ক্রমাগত হিংসাত্মক ঘটনাবলিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘রোজ মৃত্যু ও সহিংসতায় উদ্বিগ্ন হতে গেলে ভারতীয় হওয়ার দরকার পড়ে না। উন্নয়নের প্রাথমিক শর্তই হলো শান্তি। তবে চাইলেই আমরা সাহায্যের হাত বাড়াতে পারি না। মণিপুর ভারতের বিষয়।’

গারসেটি স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্র কখনো ভারতীয় সংবিধান, তার গণতন্ত্রের আদর্শ নিয়ে কথা বলায় বিরত থাকবে না।

মার্কিন রাষ্ট্রদূতের মন্তব্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে বিব্রত করেছে। মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র অরিন্দম বাগচি এ–সম্পর্কিত এক প্রশ্নের জবাবে গত বৃহস্পতিবার বলেন, ‘উনি কী বলেছেন, জানি না। না জেনে মন্তব্য করা ঠিক নয়। তবে সাধারণত ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশি কূটনীতিকেরা মন্তব্য করেন না।’ তিনি বলেন, মণিপুরে সরকার ও নিরাপত্তারক্ষীরা শান্তি প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট।

গণতন্ত্র, মানবাধিকার রক্ষা ও সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র যে উদ্বিগ্ন, গারসেটির মন্তব্য তার প্রমাণ। উজরা জেয়ার সফরও তাই গুরুত্বপূর্ণ।

ভারত ও বাংলাদেশ একই সঙ্গে উজরা জেয়ার সফরসূচিতে থাকা আরও তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের ‘বাংলাদেশ নীতি’ ভারতকেও চিন্তায় রেখেছে। ভারত চায় না প্রতিবেশী দেশে নির্বাচন ঘিরে এমন কোনো পরিস্থিতির সৃষ্টি হোক, যাতে ভারতের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ে। দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের প্রভাব বাড়ে, এমন কোনো পদক্ষেপও ভারতের কাম্য নয়। মনে করা হচ্ছে, উজরার ভারত ও বাংলাদেশ সফরের মূল উদ্দেশ্য দুই দেশের জমিনি বাস্তবতার সুলুকসন্ধান।