পলাশ ফুলের দেশে একদিন
পলাশ ফুল জানান দেয়, বসন্ত এসে গেছে। বনে–প্রান্তরে পলাশের বিস্তার আগুন ছড়িয়ে দেয় হৃদয়ে। পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া এখন পলাশে ঢেকে গেছে। এই ফাল্গুন মাসে পুরুলিয়া জেলার বিভিন্ন জঙ্গল আর বনবাদাড়ে পলাশের লাল আগুন।
অযোধ্যা পাহাড়ের পাদদেশের শহর পুরুলিয়া। এই অযোধ্যা পাহাড় আর পুরুলিয়ার বিভিন্ন সড়কের পাশে এই বসন্তে পলাশ ফুটে পর্যটকদের বিমোহিত করে। সম্প্রতি সেই পলাশ দেখতেই পুরুলিয়ায় যাওয়া।
কলকাতা থেকে ট্রেনে করে যাওয়া হলো পুরুলিয়ার বরাভূম স্টেশনে। সেখান থেকে পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড় কাছের হোটেলে। বরাভূম থেকে পুরুলিয়া শহর ঘণ্টাখানেকের পথ। সকালে ট্রেন থেকে নেমে ট্যাক্সিতে করে পুরুলিয়ার হোটেলের পথে পা বাড়াই। বরাভূম স্টেশন থেকে মোড় ঘোরার পর চোখ ঝলছে ওঠে। এত পলাশ গাছে! এত আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। রাস্তার দুই ধারে প্রচুর পলাশগাছ চোখে পড়ে।
ট্যাক্সিচালক বলেন, ‘এত ব্যস্ত হবেন না। গোটা শহর এখন পলাশে ঢেকে আছে। শুধু লাল আর লাল। রাস্তার দুই ধারে শুধু ফুটে আছে লাল পলাশ ফুল। মাঝে দু–একটি কমলা ও হলুদ। এই ফুল নেওয়ার লোক নেই।’
তখনই মনে পড়ে গেল কলকাতার সরস্বতী পূজায় একটি পলাশ বিক্রি হয় ২০ রুপিতেও।
আমাদের চিত্রগ্রাহক ভাস্করকে বললাম, এবার তো সরস্বতী পূজা শেষ হয়ে গেল। সামনের বছর সরস্বতী পূজার আগে এসে এখান থেকে পলাশ নিয়ে কলকাতায় বেচলে কেমন হয়? ভাস্কর হেসে বলল, কদিন টেকানো যাবে এই পলাশকে?
কলকাতাসহ দেশের বিভিন্ন রাজ্য এবং বাংলাদেশের পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে জঙ্গলমহলের পলাশপাড়াসহ অযোধ্যা পাহাড়ের বিভিন্ন পর্যটনকেন্দ্রে পলাশ ফুলের মালা বিক্রি হয়। কিনে নেন পর্যটকেরা। অনেক নারী তাঁদের খোঁপায় ঝুলিয়ে দেন এই পলাশের মালা। অনেকে গলায় ঝুলিয়ে হাঁটেন।
আমরা রাস্তার দুই ধারের অজস্র পলাশগাছ দেখে বিমোহিত। পথে পড়ল পুরুলিয়া শহরের পরে বাঘমুন্ডি এলাকার গভীর জঙ্গল। এ সড়কে রাতের বেলা কোনো আলো থাকে না। স্ট্রিটলাইট নেই। দূরে দূরে বসতি এলাকায় সামান্য একটু–আধটু আলোর রেশ দেখা যায়। এরপর হঠাৎ চোখে পড়ল একটি সাইনবোর্ড। তাতে লেখা, ‘এই সড়কটি হাতি পারাপারের রাস্তা।’ এই পথেই হাতি ঢুকে যায় জঙ্গলের গভীরে।
হঠাৎ সাইনবোর্ডটি দেখে আঁতকে উঠি। ভাবতে থাকি এখন যদি একটি হাতির পাল এসে যায় তখন আমরা কী করব? আতঙ্কের মধ্যেই চলতে থাকে আমাদের গাড়ি।
চলতে চলতে পৌঁছালাম পলাশগ্রামে। এত পলাশ ফোটে যে গ্রামের নামই হয়েছে এমন। সাইনবোর্ডে লেখা, ‘পলাশগ্রাম ইকো রিসোর্ট, মাথা ফরেস্ট।’ গাড়ি থামাই। পলাশগাছের কাছে গিয়ে কিছু ছবি তুলি।
রাস্তার অপর দিকে ছোট্ট একটি দোকানঘর। আমরা দোকানের সামনে দাঁড়াই।
দোকানের মালিক জিতেন কুমার বললেন, এটা বাঘমুন্ডি থানার বেরেংটাঁড় গ্রাম। এ সড়কের ওপর দিয়েই হাতির পাল চলে। তাই আমরা দারুণ আতঙ্কে থাকি। কারণ, ওরা যখন তাদের এই সেভ প্যাসেজ দিয়ে চলাচল করে তখন ওরা গাছপালা ভেঙেচুড়ে ফসলের খেত নষ্ট করে বনবাদাড় পেরিয়ে চলে।
জিতেন কুমার আরও বললেন, এই বাঘমুন্ডি এলাকা মাওবাদীদের আস্তানা ছিল একসময়। এখন অবশ্য মাওবাদীদের তৎপরতা কমে গেছে।
এই বসন্তে গাছের পলাশের মেলা মন জুড়িয় দেয়।
জিতেন কুমার বললেন, ‘আপনাদের যত ইচ্ছে এখানকার পলাশ ফুল নিয়ে যেতে পারেন। কেউ বাধা দেবে না।’
এই পলাশের বিস্তৃতি পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া ও বাঁকুড়া জেলা পার হয়ে পাশের রাজ্য ঝাড়খন্ড পর্যন্ত। এই পলাশের মৌসুম চলে মধ্য ফেব্রুয়ারি থেকে মধ্য মার্চ পর্যন্ত।
স্থানীয় লোকজন জানান, এই পলাশ ফুল থেকে এখন তৈরি হয় হোলি উৎসবের আবির।
বেরেংটাঁড় থেকে আমরা চলে এলাম কাছের সহড়িয়া শিবমন্দিরে। আসার পথে পাহাড়ের ঢালের দুই ধারে ছিল ছোট ছোট পলাশগাছ। প্রতিটিতেই ফুটে ছিল ছিল লাল পলাশ।