ভাষাসন্ত্রাস, ভারতে সংসদ সদস্যদের জন্য নয়া শব্দবিধি

ভারতীয় সংসদ ভবন
ছবি: এএনআই

ভারতে কোনটা শালীন, কোনটা অশালীন, এ বিতর্ক বহুদিনের। শালীনতা ভঙ্গের অভিযোগে মামলামোকদ্দমাও কম হয়নি দেশটিতে। সাহিত্যিক সমরেশ বসুর দুই উপন্যাস ‘বিবর’ ও ‘প্রজাপতি’ শালীন না অশালীন, তা নিয়ে বিতর্কের জলও গড়িয়েছিল বহুদূর। শেষ পর্যন্ত দীর্ঘ ১৭ বছর পর সুপ্রিম কোর্ট রায় দিয়েছিলেন, ‘প্রজাপতি’ উপন্যাস অশ্লীল নয়। তবু শালীনতার সংজ্ঞা নির্ধারণের ক্ষমতা ও অধিকার কার, সে বিতর্ক আজও অমীমাংসিত।

ভারত ও তার অঙ্গরাজ্যের আইনসভা, অর্থাৎ সংসদ ও বিধানসভাকক্ষের অভ্যন্তরে সদস্যদের ভাষায় লাগাম টানার রেওয়াজ চালু আছে বহুদিন ধরে। নির্ধারিত আছে ‘অসংসদীয়’ শব্দাবলির তালিকাও। সময়-সময় তাতে নতুন শব্দ সংযোজিতও হয়। সম্প্রতি সে তালিকায় এমন কিছু শব্দ ঢোকানো হয়েছে, যাতে মনে হতে পারে, সরকার চায় আইনসভায় সদস্যরা মুখে কুলুপ এঁটে থাকুন। কেননা, মুখ খুললেই অসংসদীয় শব্দ উচ্চারণের অপরাধে দোষী হতেই হবে।

ভারতীয় সংসদের বর্ষাকালীন অধিবেশন শুরু হবে ১৮ জুলাই। এর আগে লোকসভা সচিবালয় এক পুস্তিকা প্রকাশ করেছে, যাতে ৬৫টি নতুন শব্দ রয়েছে, যেগুরো অতঃপর ‘অসংসদীয়’ বলে গ্রাহ্য হবে। তালিকায় চোখ বোলালে চক্ষু চড়কগাছ অবধারিত। কেননা, সংসদকক্ষে সরকার বা কোনো মন্ত্রীকে ‘অহংকারী’ বলা যাবে না।

জনতা ‘নির্যাতিত’ হচ্ছে, বলা যাবে না। সরকার বা প্রধানমন্ত্রীকে ‘নৈরাজ্যবাদী’ অভিহিত করা যাবে না। ব্যবহার করা যাবে না ‘অপমান’, ‘লজ্জিত’ শব্দও। সংসদ সদস্যরা এত দিন ধরে কারও বিরুদ্ধে ‘মিথ্যা’ বলার অভিযোগ আনতে পারতেন না। কেননা, ইংরেজিতে ‘লাই’ শব্দটি ছিল অসংসদীয়। যদিও ‘অসত্য’ শব্দটি উচ্চারণযোগ্য ছিল। নতুন শব্দমালায় ‘লাই’য়ের পাশাপাশি ‘অসত্য’কেও জুড়ে দেওয়া হয়েছে।

বস্তুত, এই শব্দাবলিতে ইংরেজি ও হিন্দির পাশাপাশি প্রচলিত অন্যান্য ভাষা, এমনকি বিদেশি শব্দও স্থান পেয়েছে। যেমন ‘চামচা’, ‘চামচাগিরি’, ‘চেলা’, ‘বেচারা’, ‘বেহরি’ (বধির) সরকার, ‘বাল (শিশুসুলভ) বুদ্ধি’, ‘ঢিন্ঢোরা পিটনা’ (ঢেঁড়া পেটনো), ‘গাদ্দার’ (বিশ্বাসঘাতক)। তালিকায় দেদার ঢোকানো হয়েছে ইংরেজি শব্দ, যা এত দিন সংসদ সদস্যরা আকছার ব্যবহার করে এসেছেন। কিন্তু নতুন নির্দেশিকা অনুযায়ী ব্যবহার করা যাবে না ‘ড্রামা’, ‘আইওয়াশ’, ‘ফুলিশ’, ‘হিপোক্রেসি’ বা ‘সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্ট’–এর মতো শব্দ! সরকার, বিরোধী অথবা কেউ গরিবদের প্রতি ‘সংবেদনহীন’, সে কথা বলা যাবে না তা। ‘নিকম্মা’ (নিষ্কর্মা) বলা যাবে না। ‘শকুনি’ বলা যাবে না। ‘নৌটঙ্কি’ বা ‘ভাঁড়ামি’ শব্দ উচ্চারণ করা যাবে না। ‘আচ্ছে দিন’–এর স্লোগান বাস্তবায়িত হোক না হোক ‘কালা দিন’ শব্দ উচ্চারণ করা যাবে না। বলা যাবে না ‘কালোবাজারি’ও।

একের পর এক নির্বাচনে শাসক দলের বিরুদ্ধে বিরোধীরা ‘জুমলাবাজি’র (ভাঁওতা) অভিযোগ আনলেও এবার থেকে কাউকে ‘জুমলাজীবী’ বলা যাবে না। উচ্চারণ করা যাবে না ‘গুনস’ (গুন্ডা) ও ‘হুলিগানিজম’ শব্দ। সরকারের বিরুদ্ধে ‘কুম্ভীরাশ্রু বিসর্জন’–এর ভূরি ভূরি অভিযোগ এত দিন আনা হলেও এবার থেকে কেউ আর ইংরেজিতে ‘ক্রোকোডাইল টিয়ার্স’ অথবা হিন্দিতে ‘ঘড়িয়ালি আঁশু’ ফেলার তুলনা টানতে পারবেন না। ‘দালাল’, ‘দাঙ্গা’, ‘ডিক্টেটোরিয়াল’ ‘ডিসগ্রেস’ উচ্চারণ যেমন করা যাবে না, তেমনই কাউকে ‘গাধা’ও বলা যাবে না। বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণের মতো হুঁশিয়ারি, ‘কোভিড স্প্রেডার’, ‘ব্লাডি’, ‘ব্লাডশেড’, ‘বিট্রে’, ‘অ্যাশেমড’ (লজ্জিত), ‘কাওয়ার্ড’, ‘করাপ্ট’, ‘ক্রিমিনাল’ শব্দ বললেও সদস্যের ভাষণ থেকে তা বাতিল করে দেওয়া হবে।

সংসদীয় শালীনতা রক্ষার এই ফরমানে স্বাভাবিক ক্ষোভ প্রতিফলিত হয়েছে আজ বৃহস্পতিবার। কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী টুইট করে বলেছেন, সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে সাধারণত যেসব বিশেষণ ব্যবহৃত হয়ে থাকে, এখন থেকে তা বলা যাবে না! উদাহরণ, ‘জুমলাজীবী (ভাঁওতাজীবী) তানাশাহ (স্বৈরাচারী) কুম্ভীরাশ্রু (ক্রোকোডাইল টিয়ার্স) বিসর্জন দেন, যখন তাঁর মিথ্যা (লাইস) ও অযোগ্যতা (ইনকম্পিটেন্স) প্রমাণ হয়ে যায়।’

তৃণমূল কংগ্রেস সংসদ সদস্য ডেরেক ওব্রায়ান টুইট করে বলেন, ‘সংসদের অধিবেশন শুরু হতে চলেছে। সংসদ সদস্যদেরও কণ্ঠরোধ হচ্ছে। এখন আমরা আর ভাষণের সময় এই মৌলিক শব্দগুলো উচ্চারণ করতে পারব না, অ্যাশেমড, অ্যাবিইউসড, বিট্রেড, করাপ্ট, হিপোক্রেসি, ইনকম্পিটেন্ট। আমি কিন্তু এসব শব্দ ব্যবহার করব। পারলে সাসপেন্ড করুন।’

প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে কংগ্রেসের সংসদ সদস্য ও মুখপাত্র জয়রাম রমেশের টুইট, ‘মোদি সরকারের বাস্তবতা প্রতিফলিত যেসব শব্দে, সব নিষিদ্ধ হলো। এরপর কি বিশ্বগুরু?’

শিবসেনার প্রিয়াঙ্কা চতুর্বেদীর টুইট, ‘কী করি, কী বলি, শুধু এটাই বলি, বাহ মোদিজি বাহ।’

তৃণমূল কংগ্রেসের মহুয়া মৈত্রের তীক্ষ্ণ ও তির্যক প্রশ্ন, ‘তার মানে লোকসভায় দাঁড়িয়ে আমি বলতে পারব না কীভাবে ভারতবাসীর সঙ্গে একটা অপদার্থ সরকার বিশ্বাসঘাতকতা করছে? ভণ্ডামির জন্য সেই সরকারের কীভাবে লজ্জিত হওয়া উচিত?’

এ তালিকা ‘স্বৈরাচারী’ মনোভাবের প্রতিফলন মনে হলেও তা যে সরকারের ‘দাদাগিরি’, বলা যাবে না সে কথা। ভারতের সংসদ সদস্য ও বিধায়কদের জন্য এই নবনিদান মনে করাতে পারে সুকুমার রায়ের অবিস্মরণীয় ‘একুশে আইন’–এর প্রথম দুই পঙ্‌ক্তি, ‘শিব ঠাকুরের আপন দেশে/ আইন কানুন সর্বনেশে’।