নির্বাচনী বন্ড: এত বড় দুর্নীতি ভারতের ইতিহাসে আগে হয়নি

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে নানাভাবে চাপ প্রয়োগ করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে বিপুল অঙ্কের অর্থ আদায়ের অভিযোগ করেছেন বিরোধীরাফাইল ছবি

ভারতে নির্বাচনী বন্ড নিয়ে একের পর এক নতুন তথ্য সামনে আসছে। যত দিন যাচ্ছে, তত উঠছে নতুন নতুন প্রশ্ন। সংশয় জাগছে বন্ডের দাতা আর গ্রহীতার পরিচয় ও সম্পর্ক গোপন রাখতে শাসক দল বিজেপি কেন এত ব্যগ্র ছিল, তা নিয়ে।

শাসক দল বিজেপি চার রকমভাবে চাপ দিয়ে চাঁদাবাজি করেছে বলে প্রচার চালাচ্ছে কংগ্রেস। প্রথমটি, ‘চান্দা দো, ধান্দা লো’। মানে, পার্টিকে চাঁদা দাও, তার বদলে সরকারি প্রকল্পের ঠিকাদারি পাও। দ্বিতীয়ত, ‘ঠেকা লো, রিশবত দো’। ঠেকা অর্থাৎ কাজের বরাত নাও, তারপর রিশবত অর্থাৎ ঘুষ দাও। তৃতীয়ত, ‘হপ্তা উসুল’। প্রথমে ইডি, সিবিআই বা আয়কর বিভাগের মতো তদন্তকারী সংস্থা হানা দেবে। চাঁদা দিলে সব ধামাচাপা পড়ে যাবে। চতুর্থত, ভুয়া সংস্থার কাছ থেকে চাঁদা নেওয়া। কংগ্রেস বলছে, তারা মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যে এক বিশেষ সফটওয়্যারের (পাইথন) সাহায্যে চাঁদার দাতা ও গ্রহীতার সম্পর্ক বের করে ফেলেছে। জেনে গেছে কোন সংস্থা কখন কোন পরিস্থিতিতে কত টাকার বন্ড কিনেছে ও কোন রাজনৈতিক দলকে তা দিয়েছে।

কংগ্রেস মুখপাত্র জয়রাম রমেশ এই দাবি জানিয়ে বলেছেন, স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া (এসবিআই) এই তথ্য প্রকাশের জন্য তিন–চার মাস সময় চেয়েছিল। বেশ বোঝা যাচ্ছে, সরকারের চাপে পড়ে তারা কিছুতেই ভোটের আগে এসব তথ্য দিতে চাইছিল না। জয়রাম বলেন, বন্ড চালু করে যিনি কালো টাকার ঝনঝনানি বন্ধের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তিনি আসলে এই দুর্নীতিকেই আইনি তকমা দিতে চেয়েছিলেন। এখন ধরা পড়ার পর তা লুকাতে প্রাণপাত করছেন।

জয়রাম তাঁর দাবির সমর্থনে বেশ কিছু তথ্য পেশ করেছেন। চাঁদা দিয়ে বরাত পাওয়ার সমর্থনে তিনি দেখিয়েছেন, ৩৮টি সংস্থা বন্ড কিনে বিজেপিতে জমা দিয়ে ১৭৯টি প্রকল্প বাগিয়ে নিয়েছে। বন্ড মারফত চাঁদা দেওয়ার পর সেগুলোর কাজ শুরু হয়েছে। জয়রামের হিসাব অনুযায়ী ওই সংস্থাগুলো মোট ২ হাজার ৪ কোটি রুপি চাঁদা দিয়ে ৩ লাখ ৮০ হাজার কোটি রুপির কাজ আদায় করেছে। দ্বিতীয় ধরনের নমুনায় দেখানো হচ্ছে, বিভিন্ন সংস্থা মোট ৬২ হাজার কোটি রুপির বরাত পাওয়ার তিন মাসের মধ্যে বিজেপিকে ৫৮০ কোটি রুপি চাঁদা দিয়েছে। তৃতীয় ধরন, চাপ সৃষ্টি করে চাঁদা আদায়। এর উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, ৪১টি করপোরেট সংস্থায় ইডি, সিবিআই, আয়কর দপ্তর ৫৬ বার তল্লাশি চালিয়েছে। ওই সংস্থাগুলো বিজেপিকে মোট ২ হাজার ৫৯২ কোটি রুপি বন্ড মারফত দিয়েছে। তার মধ্যে ১ হাজার ৮৫৩ কোটি রুপি দেওয়া হয়েছে হানা দেওয়ার পর। চতুর্থ ধরন ভুয়া কোম্পানির কাছ থেকে আদায়। জয়রামের হিসাবে, ১৬টি ভুয়া সংস্থা বিভিন্ন দলকে ৫৪৩ কোটি চাঁদা দিয়েছে। তার মধ্যে বিজেপিকে দিয়েছে ৪১৯ কোটি রুপি। এই সংস্থাগুলোর কারও বিরুদ্ধে টাকা পাচারের অভিযোগ আছে। কেউ কেউ কোম্পানি তৈরি করেই কোটি কোটি রুপি চাঁদা দিয়েছে। কেউ–বা মূলধনের অনেক বেশি টাকা বন্ড কিনে বিজেপিকে দিয়েছে। কংগ্রেসসহ বিরোধীরা বলছে, এত বড় দুর্নীতি ভারতের ইতিহাসে আগে হয়নি।

কেজরিওয়ালের গ্রেপ্তারও সন্দেহজনক
দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালের গ্রেপ্তারও সন্দেহ ও বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। সেখানেও নির্বাচনী বন্ডের ভূমিকা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। কারণ, যাঁর স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে কেজরিওয়ালকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, হায়দরাবাদের সেই শিল্পপতি পি শরৎচন্দ্র রেড্ডি আবগারি (মদ) মামলায় গ্রেপ্তার হওয়ার পর বিজেপিকে চাঁদা দেন। তারপর জামিন পান। তারও পর বন্ড মারফত বিজেপিকে আরও চাঁদা দেন এবং রাজসাক্ষী হয়ে যান।

কেজরিওয়ালের দল আম আদমি পার্টির (আপ) পক্ষ থেকে এ বিষয়ে জোর প্রচার চালানো হচ্ছে। সংবাদ সম্মেলন করে দলের দুই মন্ত্রী আতিশী ও সৌরভ ভরদ্বাজ এবং নির্বাচনী স্বচ্ছতা আন্দোলনকর্মী অঞ্জলি ভরদ্বাজ বিষয়টি সামনে এনেছেন। অভিযোগের সমর্থনে তাঁরা হাজির করছেন নির্বাচনী বন্ড তথ্য।

আবগারি দুর্নীতির তদন্তে ২০২২ সালে প্রথম গ্রেপ্তার করা হয়েছিল হায়দরাবাদের ওষুধ কোম্পানি অরবিন্দ ফার্মার অন্যতম পরিচালক পি শরৎচন্দ্র রেড্ডিকে। সেই সময় তিনি দাবি করেছিলেন, অরবিন্দ কেজরিওয়ালের সঙ্গে তাঁর কোনো দিন দেখা হয়নি। কোনো পরিচয়ও নেই। গ্রেপ্তার হওয়ার পাঁচ দিন পরেই তিনি ৫ কোটি টাকার বন্ড কিনে বিজেপিতে জমা দেন। তার কিছুদিন পর কোমরে ব্যথার কারণে দিল্লি হাইকোর্ট থেকে জামিন পান।

আরও পড়ুন

আতিশী ও সৌরভ ভরদ্বাজ সংবাদ সম্মেলন করে নির্বাচনী বন্ড–সংক্রান্ত তথ্য দেখিয়ে বলেছেন, ২০২২ সালের ১০ নভেম্বর ইডি রেড্ডিকে গ্রেপ্তার করে। এর ৫ দিন পর ১৫ নভেম্বর অরবিন্দ ফার্মা ৫ কোটি রুপির বন্ড কেনেন এবং তা বিজেপির দলীয় তহবিলে জমা পড়ে। ২০২৩ সালের মে মাসে রেড্ডি দিল্লি হাইকোর্টে জামিনের আবেদন জানান। ইডি সেই আবেদনের বিরোধিতা করেনি। এর পরেই জুন মাসে রেড্ডি রাজসাক্ষী হয়ে যান ও কেজরিওয়ালকে ১০০ কোটি রুপি ঘুষ দেওয়ার দাবি করেন। তাঁরা বলেন, যিনি প্রথমে বলেছিলেন কেজরিওয়ালকে চেনেনই না, তিনিই পরবর্তীকালে ঘুষ দেওয়ার অভিযোগ আনলেন এবং সেটাই হলো মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে একমাত্র হাতিয়ার!

আপের পক্ষ থেকে তথ্য দিয়ে প্রমাণের চেষ্টা করা হয় যে পি শরৎচন্দ্র রেড্ডি নির্বাচনী বন্ড মারফত দফায় দফায় বিজেপিকে মোট ৫৯ কোটি ৫০ লাখ রুপি চাঁদা দিয়েছেন। রাজসাক্ষীও হয়েছেন। কেজরিওয়ালের সরকারের দুই মন্ত্রী বলেন, ইডি একটা সময় এই রেড্ডিকে মূল ষড়যন্ত্রকারী বলে আখ্যা দিয়েছিল। বলেছিল, তিনিই এই দুর্নীতির ‘কিংপিন’ বা নাটের গুরু। রেড্ডিকে রাজসাক্ষী করার পর তাঁর বয়ানের ওপর ভিত্তি করে ইডি এখন কেজরিওয়ালকে মূল ষড়যন্ত্রকারী ও নাটের গুরু বলছে। তাঁরা বলেন, এ এক অদ্ভুত খেলা!

একই ছক নির্মাণ সংস্থা ডিএলএফের ক্ষেত্রেও
নির্মাণ সংস্থা ডিএলএফের জমি দুর্নীতি ও সেই দুর্নীতিতে কংগ্রেস নেত্রী প্রিয়াঙ্কা গান্ধী ভদ্রের স্বামী রবার্ট ভদ্রকে জড়িয়ে ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে ব্যাপক প্রচার করেছিলেন নরেন্দ্র মোদি। সেই ডিএলএফ ১৭০ কোটি রুপি বন্ড মারফত বিজেপিকে দেওয়ার পর হরিয়ানা সরকার বলেছে, জমি অধিগ্রহণে কোনো অনিয়ম হয়নি।

দিল্লির সন্নিকটে গুরুগ্রামে (সাবেক গুরগাঁও) ডিএলএফের বিরুদ্ধে জমি দুর্নীতি ও প্রতারণার অভিযোগ এনেছিল হরিয়ানা সরকার। কংগ্রেসের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ভূপিন্দর সিং হুডা ও রবার্ট ভদ্রকে সেই অভিযোগে জড়ানো হয়েছিল। ২০১৮ সালে ওই অভিযোগে ডিএলএফ ও রবার্টের বিরুদ্ধে মামলা করেছিল বিজেপিশাসিত হরিয়ানা সরকারের পুলিশ। কিন্তু ২০২৩ সালে রাজ্য সরকার জানায়, জমি লেনদেনে কোনো অনিয়ম হয়নি।

হঠাৎ এই ভোলবদলের নেপথ্যে নির্বাচনী বন্ড কী ভূমিকা রেখেছিল—এই প্রশ্ন এখন আলোচিত হচ্ছে। নির্বাচনী বন্ডসংক্রান্ত তথ্য খতিয়ে দেখে বোঝা যাচ্ছে, ২০১৯ সালের অক্টোবর মাস থেকে ২০২২ সালের নভেম্বর পর্যন্ত ডিএলএফ গোষ্ঠী বিজেপিকে দফায় দফায় মোট ১৭০ কোটি রুপি দিয়েছে। তার পরেই পাঞ্জাব ও হরিয়ানা হাইকোর্টকে প্রাদেশিক সরকার জানিয়ে দেয়, কংগ্রেসের আমলে রবার্টের সঙ্গে জমি লেনদেনে ডিএলএফ অনিয়ম কিছু করেনি। ওই ঘটনার পর রবার্ট ভদ্র সামাজিক মাধ্যমে বলেছিলেন, বিজেপি উদ্দেশপ্রণোদিতভাবে ওই অভিযোগ এনেছিল। বিজেপি তা খারিজ করে জানায়, কাউকেই ‘ক্লিনচিট’ দেওয়া হয়নি। নতুন করে তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে। যদিও হাইকোর্ট তদন্তপ্রক্রিয়া নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন।