থ্রি ইডিয়টসের বাস্তবের ‘র‍্যাঞ্চো’ লাদাখে আমরণ অনশনে

ভারতের লাদাখের রাজধানী লেহতে আমরণ অনশনে সোনম ওয়াংচুক। ১৯ মার্চছবি: এএনআই

ফুংসুক ওয়াংচুক বললে এখনো অনেকের চোখে ভেসে ওঠে বলিউডের সিনেমা ‘থ্রি ইডিয়টস’-এর আমির খানের মুখ। ফুংসুক ওয়াংচুক ছিলেন ওই সিনেমার সেই নায়ক, যার ডাক নাম ছিল ‘র‌্যাঞ্চো’। তাঁর খোঁজে তিন বন্ধু পাড়ি দিয়েছিলেন লাদাখের রাজধানী লেহ।

সিনেমার সেই ‘র‌্যাঞ্চো’ বাস্তবে লাদাখের অতিপরিচিত পরিবেশবিদ সোনম ওয়াংচুক। লাদাখকে পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা, পরিবেশ রক্ষাসহ কয়েকটি দাবিতে তিনি ‘আমরণ অনশন’ কর্মসূচি শুরু করেছেন। আজ বুধবার ১৫ দিনে পড়ল তাঁর অনশন। খোলা আকাশের নিচে মাইনাস ১৫ ডিগ্রিতে তাঁর সঙ্গে দিনরাত অতিবাহিত করছেন আরও অন্তত ২৫০ থেকে ৩০০ জন লাদাখবাসী। অথচ কেন্দ্রীয় সরকার এখনো হেলদোলহীন।

ম্যাগসাইসাইজয়ী সোনম ওয়াংচুক আজ বুধবার সরাসরি জানতে চাইছেন, লাদাখের পর্বতরাজি বিভিন্ন শিল্প সংস্থা ও খনির কারবারিদের কাছে বেচে দিতে কেন্দ্রীয় সরকার এই বিস্তীর্ণ এলাকাকে কাশ্মীর থেকে বিচ্ছিন্ন করে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পরিণত করেছে কি না।

সোনম ওয়াংচুক ও তাঁর সঙ্গীরা আমরণ অনশনের সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হন ৪ মার্চ। সেই দিন কেন্দ্রীয় সরকার লাদাখবাসীদের জানিয়ে দিয়েছিল, তাদের সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিলে অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব নয়। প্রতিবাদে ৬ মার্চ থেকে সোনম ও তাঁর অনুগামী সমর্থকেরা আমরণ অনশনের সিদ্ধান্ত নেন।

ওই দিন থেকে খোলা আকাশের নিচে রচিত হচ্ছে ওয়াংচুক ও তাঁর সহযোগীদের দিবারাত্রির কাব্য। তাঁদের আন্দোলনে প্রতিদিন যোগ দিতে হাজির হচ্ছেন লাদাখের হাজার হাজার মানুষ। রুখু লাদাখের পাহাড় ও নদী পেরিয়ে সেই আন্দোলনের ঢেউ ভারতের মূল ভূখণ্ডের প্রথম সারির গণমাধ্যমে প্রতিফলিত হচ্ছে যৎসামান্যই। তাতে বাস্তবের ‘র‌্যাঞ্চো’ যদিও ভ্রুক্ষেপহীন। তাঁর কথায়, সত্যের পথে থাকলে জয় অবধারিত।

২০১৯ সালের ৫ আগস্ট জম্মু-কাশ্মীর থেকে লাদাখকে বিচ্ছিন্ন করে গড়ে তোলা হয়েছিল দুই পৃথক কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল। জম্মু-কাশ্মীর ও লাদাখ। অবিভক্ত ওই রাজ্যে বিধানসভা ছিল। কেন্দ্রশাসিত জম্মু-কাশ্মীরকে বিধানসভা দেওয়ার পাশাপাশি প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল রাজ্যের মর্যাদা ফিরিয়ে দেওয়ার।

সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিলের পর সাড়ে চার বছর পার হয়ে গেছে। রাজ্যের মর্যাদা জম্মু-কাশ্মীর এখনো পায়নি। হয়নি বিধানসভার নির্বাচনও। লাদাখবাসীও পায়নি তাদের দেওয়া প্রতিশ্রুতিগুলো।

অনশনরত সোনম ওয়াংচুক সেই কথা সবাইকে মনে করিয়ে দিয়ে এক বার্তায় বলেছেন, ২০১৯ সালের লোকসভা ভোট ও ২০২০ সালের পার্বত্য পরিষদের নির্বাচনের সময় বিজেপির সরকার বলেছিল, লাদাখকে সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিলের রক্ষাকবচ দেওয়া হবে। সেই প্রতিশ্রুতি তাদের বিপুল ভোটে জয়ী করেছিল।

তার পর থেকে আজ পর্যন্ত প্রতিশ্রুতি রক্ষার ধারকাছে দিয়ে সরকার হাঁটেনি। বরং ৪ মার্চের বৈঠকে জানিয়ে দেওয়া হয় ষষ্ঠ তফসিল দেওয়া যাবে না। পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা বা বিধানসভাও নয়।

কারগিল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স (কেডিএ) ও লেহ অ্যাপেক্স কাউন্সিলের ৬ সদস্যের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে ওই বৈঠক করেছিলেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। অথচ আগে তিনি বারবার বলেছেন, সংবিধান অনুযায়ী জমি, চাকরি ও সংস্কৃতি রক্ষায় লাদাখের রক্ষাকবচের ব্যবস্থা সরকার করবে।

সোনম ওয়াংচুকের সঙ্গে কেডিএ ও লেহ অ্যাপেক্স কাউন্সিলও সহমত, কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হওয়ার কারণে লাদাখের জমি ও খনিজ পদার্থের ভার ধীরে ধীরে শিল্পপতিদের হাতে চলে যাবে, যার ফলে ভঙ্গুর লাদাখের পরিবেশ বিপন্ন হবে। সোনমের আন্দোলন তাই দ্বিমুখী। রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের পাশাপাশি পরিবেশ রক্ষা।

সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিল অনুযায়ী আসাম, মেঘালয়, মিজোরাম ও ত্রিপুরায় তফসিল উপজাতি অধ্যুষিত মোট ১০টি জেলা রয়েছে, যেখানে তাদের স্বায়ত্তশাসন ব্যবস্থা জারি রয়েছে।

জম্মু-কাশ্মীর থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর লাদাখে স্থানীয় বাসিন্দাদের জন্য সংরক্ষণব্যবস্থা চালু হয়নি। বিধানসভার মতো গণতান্ত্রিক কাঠামোও দেওয়া হয়নি। ফলে মানুষের জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণে কোনো গণতান্ত্রিক রীতিও নেই। কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলটি চালিত হচ্ছে দিল্লির মর্জিমাফিক। তাদের নিযুক্ত আমলাদের দিয়ে।

সোনম ওয়াংচুকের অভিযোগ, মানুষের মোহভঙ্গ ঘটেছে। প্রতিশ্রুতি রক্ষা না করায় লাদাখে সেনাদের মনোবলও ভেঙে পড়ছে। এই বৈচিত্র্যপূর্ণ লাদাখের পরিবেশ রক্ষার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করানোর পাশাপাশি সোনম ওয়াংচুক চান লাদাখের জন্য পূর্ণ রাজ্য ও ষষ্ঠ তফসিলের মর্যাদা।

সোনম ওয়াংচুকের আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়েছে কারগিল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স (কেডিএ)। আজ তারা গোটা লাদাখে অর্ধদিবস ধর্মঘট পালন করে। ২৪ মার্চ, অনশন আন্দোলনের ২১তম দিনে লাদাখের পরিবেশ রক্ষায় বিশ্বব্যাপী সহমর্মিতা জানানোর আবেদন জানিয়েছেন সোনম ওয়াংচুক।