বিজ্ঞাপন দিয়েও ভোটারদের উজ্জীবিত করতে পারল না বিজেপি

কাশ্মীরের অনন্তনাগে ভোট দেওয়ার পর আঙুলের কালি দেখাচ্ছেন জম্মু-কাশ্মীর ন্যাশনাল কনফারেন্স নেতা পিয়ার মোহাম্মদ হোসেন সোহরাওয়ার্দীসহ অন্যরা। আজ ২৫ মেছবি: এএনআই

ভারতের লোকসভা নির্বাচনে আগের পাঁচ দফার মতো ষষ্ঠ দফার ভোটও মানুষকে সেভাবে উজ্জীবিত করতে পারল না। আজ শনিবার ৫৮টি আসনে বিকেল ৫টা পর্যন্ত ভোটের গড় হার ৫৭ দশমিক ৭০ শতাংশ। অথচ আজ দেশের সব প্রভাতী সংবাদপত্রে প্রধানমন্ত্রীর ছবি দিয়ে বিজেপির বিজ্ঞাপন ছিল, ‘আগে ভোট দিন। বাকি সব পরে।’

ব্যতিক্রম শুধু পশ্চিমবঙ্গ ও কাশ্মীর। তাপ, উত্তাপ, উত্তেজনা ও ভোটকেন্দ্রিক অভিযোগ সবকিছুতেই পশ্চিমবঙ্গ এগিয়ে রইল। বিকেল ৫টা পর্যন্ত রাজ্যের ৮ কেন্দ্রে ভোটের হার ৭৭ দশমিক ৯৯ শতাংশ। পশ্চিমবঙ্গের পরই ভোটের হারে এগিয়ে রয়েছে ঝাড়খন্ড। সন্ধ্যা ছয়টার পর এই হার অবশ্যই কিছু বাড়বে। অতীতের তুলনায় বিপুল ভোট পড়েছে কাশ্মীরের অনন্তনাগ-রাজৌরি কেন্দ্রেও। ৫১ দশমিক ৩৫ শতাংশ।

ভোট ঘিরে তুমুল বিতর্কের মধ্যে আজই নির্বাচন কমিশন জানিয়ে দিল, প্রথম পাঁচ দফায় কোন কোন কেন্দ্রে মোট কত ভোট পড়েছে, সেই তথ্য। তা প্রকাশ করার সঙ্গে সঙ্গে কমিশন এক বিবৃতিতে বলেছে, নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে বানচাল ও অকার্যকর করে তুলতে এক মিথ্যা প্রচার চালানো হচ্ছে।

গতকাল শুক্রবারই নির্বাচন চলাকালে এ–সংক্রান্ত মামলায় হস্তক্ষেপ করতে সুপ্রিম কোর্ট রাজি হননি। অথচ এর ২৪ ঘণ্টার মধ্যে কমিশন তথ্য প্রকাশ করায় কংগ্রেস মুখপাত্র পবন খেরা, তৃণমূল কংগ্রেসের রাজ্যসভার সদস্য সাকেত গোখলেরা খোঁচা দিয়ে জানতে চান, ‘হঠাৎ কী হলো? হাওয়ার অভিমুখ কি পাল্টে গেল?’

ভোট ঘিরে বিতর্কের মতো উত্তর ভারতের আবহাওয়াও উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। তাপপ্রবাহ পৌঁছেছে অসহনীয় অবস্থায়। সেই সঙ্গে বয়ে চলেছে হালকা হাওয়া। এর মধ্যেই দিল্লির ভিআইপি কেন্দ্রগুলোয় আজ সকাল সকাল ভোট দেন রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু, সোনিয়া, রাহুল ও প্রিয়াঙ্কা গান্ধী, দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর ও মুখ্য নির্বাচন কমিশনার রাজীব কুমাররা।

কোনো কোনো কেন্দ্রের ভোট ঘিরে বিক্ষিপ্ত ঘটনা ও অভিযোগ শোনা যায়। যেমন দিল্লির কিছু কেন্দ্রে ইন্ডিয়া জোটের পোলিং এজেন্টদের ঢুকতে দেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ করেছেন উত্তর-পশ্চিম দিল্লি আসনের প্রার্থী উদিত রাজ। আম আদমি পার্টির (আপ) নেত্রী ও রাজ্যের মন্ত্রী আতিশি ভোট দিয়ে জানান, যেখানে বিরোধীরা শক্তিশালী, সেখানে ধীরগতিতে ভোট গ্রহণের চক্রান্ত করেছেন উপরাজ্যপাল ভি কে সাকসেনা। সে জন্য দিল্লি পুলিশকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

কাশ্মীর উপত্যকায় তাপপ্রবাহ না থাকলেও অনন্তনাগ-রাজৌরি কেন্দ্রের ভোট নিয়ে ক্ষোভ দেখান পিডিপি নেত্রী মেহবুবা মুফতি। তাঁর অভিযোগ, পুলিশ বেছে বেছে তাঁর এজেন্টদের আটক করছে। প্রতিবাদে তিনি বিজবেহরা থানার সামনে অবস্থান বিক্ষোভ করেন। উপত্যকার তিন আসনে ইন্ডিয়া জোটের দুই শরিক ন্যাশনাল কনফারেন্স ও পিডিপির মধ্যে আসন সমঝোতা হয়নি, ফলে লড়াই ত্রিমুখী।

ষষ্ঠ দফার এই পর্বে যে ৫৮ আসনে ভোট, ৫ বছর আগে তার ১টিতেও কংগ্রেস জয়ী হতে পারেনি। বিজেপি ও তার সহযোগীরা জিতেছিল ৪৫টি আসন। হরিয়ানার ১০ ও দিল্লির ৭ আসনের প্রতিটিতেই জিতেছিল বিজেপি। এই দুই রাজ্যে এবার কংগ্রেস ও আপের মধ্যে জোট হয়েছে। হরিয়ানায় বিভিন্ন কারণে বিজেপি কোণঠাসা। ফলে বিজেপি তার জয়ের ধারা এবারও অব্যাহত রাখতে পারবে কি না, সেই প্রশ্ন বড় হয়ে উঠেছে। এই জিজ্ঞাসা শুধু হরিয়ানা ও দিল্লিতেই নয়, উত্তর প্রদেশ, বিহার ও ঝাড়খন্ডেও।

আজ ভোটে নির্ধারিত হয়ে গেল অনেক হেভিওয়েট প্রার্থীর ভাগ্য। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন হরিয়ানার কারনাল কেন্দ্রে সে রাজ্যের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী মনোহররাল খাট্টার, ওড়িশার সম্বলপুরে বিজেপির কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ধর্মেন্দ্র প্রধান, পুরীর প্রার্থী বিজেপির মুখপাত্র সম্বিত পাত্র, হরিয়ানার গুরগাঁওয়ে কংগ্রেস প্রার্থী রাজ বব্বর, উত্তর প্রদেশের সুলতানপুরের বিজেপি প্রার্থী মেনকা গান্ধী, উত্তর–পূর্ব দিল্লির দুই প্রার্থী কংগ্রেসের কানহাইয়া কুমার ও বিজেপির মনোজ তিওয়ারি এবং নিউ দিল্লির দুই প্রতিদ্বন্দ্বী বিজেপির বাঁশুরী স্বরাজ ও আপ নেতা সোমনাথ ভারতী।

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবারের নির্বাচনী প্রচারে বারবার বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন। আজ বিহারের পাটলিপুত্রে নির্বাচনী জনসভায় তিনি সেই অস্ত্রে বিরোধীদের ঘায়েল করতে চেয়েছেন, যে অস্ত্র তাঁর বিরুদ্ধে বিরোধীরা প্রয়োগ করে আসছে, সাম্প্রদায়িকতা।

হিন্দু-মুসলমানে বিভাজন টানতে নরেন্দ্র মোদি বলেন, ‘ইন্ডিয়া জোটের সবাই সাম্প্রদায়িক। তাই তারা ধর্মের ভিত্তিতে সংরক্ষণ চালু করতে চাইছে কিন্তু আমি তা হতে দেব না। প্রাণ থাকতে আমি তফসিল জাতি, উপজাতি ও অনগ্রসরদের সংরক্ষণ কাড়তে দেব না। ইন্ডিয়া জোট তাদের ভোট ব্যাংকের (মুসলমান) গোলামি ও দাসত্ব করতে চাইলে করুক। চাইলে তাদের সামনে মুজরা (নাচ) করুক। কিন্তু আমি সংবিধান বিকৃত হতে দেব না।’

ইন্ডিয়া জোট শুরু থেকেই বলে আসছে, বিজেপি ‘চার শ পার’ করতে চায় সংবিধান বদলানোর তাগিদে। এই প্রচার দলিত সমাজের মধ্যে প্রবল আলোড়ন ফেলেছে, যেহেতু সংবিধান প্রণেতা বাবাসাহেব আম্বেদকরের সঙ্গে দলিত সমাজ একাত্মবোধ করে। এই প্রবণতা রুখতে মোদিও পাল্টা সংবিধানকে হাতিয়ার করেছেন। টেনে এনেছেন সংরক্ষণ অপরিবর্তিত রাখার প্রশ্ন এবং তার সঙ্গে জুড়ে দিয়েছেন মুসলমানদের সংরক্ষণ দেওয়ার বিষয়টি।

লক্ষণীয় অন্ধ্র প্রদেশে বিজেপির জোটসঙ্গী তেলুগু দেশম নেতা চন্দ্রবাবু নাইডু মুসলমানদের জন্য ৪ শতাংশ সংরক্ষণের প্রতিশ্রুতি দিলেও মোদি তাঁর বিরুদ্ধাচরণ করছেন না।