দার্জিলিংয়ে সাবেক পররাষ্ট্রসচিব শ্রিংলাকে কেন প্রার্থী দিতে চায় বিজেপি

হর্ষবর্ধন শ্রিংলার ফাইল ছবি

লোকসভা নির্বাচনের অন্তত দুই মাস আগে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের ৪২ আসনের মধ্যে ১টি আসন নিয়ে নিয়মিত গণমাধ্যমে খবর হচ্ছে। আসনটি উত্তরবঙ্গের দার্জিলিং এবং এর কারণটিও স্পষ্ট। রাজ্য বিজেপির কয়েকটি সূত্র প্রথম আলোকে নিশ্চিত করেছে, এই আসনে ভারতের সাবেক পররাষ্ট্রসচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলা প্রার্থী হতে পারেন। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে এই আসনে জিতেছিলেন বিজেপিদলীয় শিল্পপতি রাজু বিস্তা। তখন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নিজে তাঁকে মনোনয়ন দিয়েছিলেন।

দার্জিলিং আসনের গুরুত্ব

দার্জিলিং নির্বাচনী এলাকা কেবল পশ্চিমবঙ্গকে উত্তর-পূর্ব ভারতের প্রতিবেশীদের সঙ্গেই যুক্ত করেনি, নেপাল, বাংলাদেশ ও ভুটানের সঙ্গেও যোগাযোগের সেতু হিসেবে কাজ করে। এ কারণে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির নেতাদের একাংশ, সামরিক কর্মকর্তা ও ভূকৌশলগত বিশ্লেষকেরা প্রায়ই বলেন, কৌশলগত গুরুত্বের কারণে পশ্চিমবঙ্গের উত্তরের জেলাগুলো সরাসরি দিল্লির নিয়ন্ত্রণে থাকা প্রয়োজন।

এই করিডরের তাৎপর্য উপেক্ষা করা কঠিন। বাংলাদেশের একেবারে উত্তরের সীমান্ত থেকে নেপালের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তের মধ্যে প্রায় ২০ কিলোমিটার প্রসারিত ‘শিলিগুড়ি করিডর’ দার্জিলিং লোকসভা আসনের সমভূমিতে অবস্থিত। ভুটানের ডোকলাম অঞ্চলের কর্তৃত্ব নিয়ে ২০১৭ সালে ভারত ও চীনের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছিল।

ভারতের ভূকৌশল বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, সেই ঘটনার পর ওই অঞ্চলে ওপরের দিকে পাহাড়ে চীনের সেনাবাহিনী তাদের অবস্থান মজবুত করেছে। অঞ্চলটি শিলিগুড়ি করিডর থেকে মোটামুটি ১৫০ কিলোমিটার ওপরে, যা যেকোনো স্বল্পমাত্রার ভূমি থেকে ভূমিতে নিক্ষেপণযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্রের পাল্লার মধ্যে রয়েছে।

বিশ্বে চীনের কাছে সবচেয়ে বেশি ভূমি থেকে ভূমিতে নিক্ষেপণযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে। চীনা সেনাবাহিনী ডোকলামের ওপরে কৌশলগত পয়েন্টে অবস্থান করছে কি না, তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। তবে যে বিষয়ে বিতর্ক নেই, তা হচ্ছে এই করিডরের তাৎপর্য। কোনো কারণে এটি বন্ধ হয়ে গেলে উত্তর-পূর্বের সাতটি রাজ্য, সিকিম ও উত্তর পশ্চিমবঙ্গের পাঁচটি জেলা ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। এর অর্থ, ভারতের ৪ শতাংশের বেশি মানুষ মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে।

এরই পরিপ্রেক্ষিতে বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব এমন একজনকে চেয়েছিলেন, যিনি পেশাদার রাজনীতিবিদ নন; কিন্তু এই স্পর্শকাতর অঞ্চলের ভূরাজনীতি ও কূটনীতি সম্পর্কে তাঁর ব্যাপক ধারণা রয়েছে।

ঠিক সেই কারণেই কিনা বাংলাদেশ, যুক্তরাষ্ট্র ও থাইল্যান্ডে ভারতের নিযুক্ত সাবেক রাষ্ট্রদূত এবং পররাষ্ট্রসচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলার নাম আসছে। এই বিবেচনাকে শ্রিংলা তাঁর পিতৃভূমিতে প্রত্যাবর্তন হিসেবে দেখছেন।

কেন উত্তরবঙ্গে ফিরলেন শ্রিংলা

সাবেক কূটনীতিক শ্রিংলা মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি আমার নিজের এলাকায় ফিরে এলাম। আমার বাড়ি রয়েছে প্রধান নগরের শিলিগুড়িতে এবং চকবাজারের দার্জিলিংয়েও। ৪০ বছর বিভিন্ন পদে সরকারি চাকরি করার পর আমি এখানে এসেছি। এই অঞ্চলের প্রতি আমার যে ঋণ, তা খানিকটা শোধ করতে চাই।’

লোকসভায় প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নের ব্যাপারে শ্রিংলার উত্তর একজন কূটনীতিকের মতোই। তিনি বলেন, নির্বাচনে তাঁর লড়ার বিষয়টি নির্ভর করছে দার্জিলিংয়ের মানুষের ওপর। তাদের নিজস্ব চিন্তাভাবনা রয়েছে। তারা নিজেদের এলাকা থেকে কাউকে (প্রার্থী হিসাবে) চাইলে...সেটা রূপায়িত হবে কি না, তা ভবিষ্যৎই বলবে।’

শ্রিংলা এই মুহূর্তে নিজের ভূমিকাকে একজন নিয়মিত রাজনীতিকের চেয়ে ‘একজন সমাজকর্মী’ হিসেবে বর্ণনা করতে বেশি আগ্রহী।

বেশ কিছুদিন ধরে উত্তরবঙ্গ ও দার্জিলিংয়ে কিছু কাজ করার চেষ্টা করেছেন ভারতের সাবেক পররাষ্ট্রসচিব। যেমন ২০২৩ সালে ভারতের জি–২০ প্রেসিডেন্সির প্রধান সমন্বয়কারী হিসেবে শ্রিংলা নিশ্চিত করেছিলেন, জি–২০ ট্যুরিজম মিটিং দার্জিলিংয়ে হবে।

শ্রিংলা ১৫ থেকে ২০টি ভারতীয় বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের কর্তাদের দার্জিলিংয়ে এনেছিলেন, যাতে তাঁরা এখানকার স্থানীয় ছেলেমেয়েদের সঙ্গে কথাবার্তা বলে তাঁদের নিয়োগ দেন। সাক্ষাৎকারের পর ২৭০ জনকে চাকরির প্রাথমিক চিঠি দেয় সংস্থাগুলো। পাশাপাশি, শ্রিংলা চা-শ্রমিকদের সহায়তার জন্য কোম্পানির শীর্ষ কর্মকর্তাদের এবং গেটস ফাউন্ডেশনে নিযুক্ত মার্কিন প্রতিনিধিদলের সফরের ব্যবস্থা করেন।

বাংলাদেশ প্রসঙ্গ

হর্ষবর্ধন শ্রিংলার নাম আসার আরেকটি কারণ ভারতের পররাষ্ট্রনীতির কেন্দ্রে বাংলাদেশের অবস্থান জোরালো হওয়া এবং সেই দেশে সাবেক পররাষ্ট্রসচিবের ‘পারফরমেন্স’। শ্রিংলা বাংলাদেশে বেশ কিছু ভালো উদ্যোগ নিয়েছেন। বাংলাদেশে ভারতের হাইকমিশনার থাকাকালে ভারতের ভিসা দেওয়ার সংখ্যা ৫ থেকে ১৫ লাখে পৌঁছায়।

এ ছাড়া শ্রিংলা বাংলাদেশে দায়িত্বকালে সিকিমসহ ভারতের কিছু রাজ্য ও অঞ্চল ভ্রমণে বাংলাদেশের ওপর থাকা নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়। ফলে সিকিম, দার্জিলিং, শিলিগুড়ি, পশ্চিমবঙ্গ এবং উত্তর-পূর্বের কিছু অংশে বাংলাদেশের পর্যটকেরা আসতে শুরু করেন এবং দুই দেশেরই ব্যবসা বাড়ে। একই সঙ্গে মিতালী এক্সপ্রেসও চালু হয়, যা পর্যটকদের বাংলাদেশ থেকে সরাসরি শিলিগুড়ি ও দার্জিলিংয়ে নিয়ে আসে। শিলিগুড়ি থেকে পার্বতীপুর পর্যন্ত ডিজেল পাইপলাইন আনার ব্যাপারেও কথাবার্তা শুরু হয়।

শ্রিংলা বলেন, ‘আমার জন্য অত্যন্ত আনন্দের একটা বিষয়, আমি গত বছর জি–২০ বৈঠকে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে পেরেছিলাম। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে তারাই একমাত্র দেশ, যাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। আমি মনে করি, দিল্লির জি–২০ বৈঠকে থাকাটা বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল।’

নির্বাচনে জিতলে রাজনীতিবিদ হিসেবে শ্রিংলার অভিজ্ঞতা কীভাবে ভারত কাজে লাগাতে পারে? তিনি লড়ছেন উত্তরবঙ্গ থেকে। তাই এই প্রশ্ন স্বাভাবিক যে ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত ইস্যু তিস্তা নদীর পানি বণ্টন নিয়ে কোনো ইতিবাচক পদক্ষেপ দেখা যেতে পারে কি না।

শ্রিংলা সরাসরি উত্তর না দিয়ে বলেন, ‘আমি জনগণের সঙ্গে জনগণের সংযোগ বাড়াতে যথাসাধ্য চেষ্টা করব।’

ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পররাষ্ট্রনীতির পর্যবেক্ষকেরা মনে করছেন, নির্বাচিত হলে হর্ষবর্ধন শ্রিংলা অবশ্যই কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হবেন এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করকে সহায়তা করবেন।