মণিপুরে থানা, বিজেপি বিধায়কের বাড়িতে হামলার চেষ্টা, সংঘর্ষ

মণিপুরের মন্ত্রী নেমচা কিপগেনের বাড়িতে আগুন দেয় ক্ষুব্ধ জনতা। গত বৃহস্পতিবার তোলা
ছবি: এএনআই

ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় মণিপুর রাজ্যের পরিস্থিতি সামাল দিতে রাষ্ট্র ‘ব্যর্থ’ হয়েছে বলে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর মন্তব্য করেছেন। এরই মধ্যে সাবেক এক সেনা কর্মকর্তা মণিপুরের পরিস্থিতিকে উত্তর আফ্রিকা ও পশ্চিম এশিয়ার সংঘাতদীর্ণ রাষ্ট্রের সঙ্গে তুলনা করেছেন। গুরুত্বপূর্ণ এই দুই ব্যক্তির বক্তব্যের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে রাজ্যে ক্ষুব্ধ জনতার সঙ্গে নিরাপত্তা বাহিনীর তীব্র লড়াই শুরু হয়েছে। বিক্ষিপ্ত সহিংসতায় রাজ্যের রাজধানী ইম্ফলে অন্তত দুজন আহত হয়েছেন। বিজেপি নেতাদের বাড়িতে হামলার ঘটনাও ঘটেছে।

গতকাল শুক্রবার রাত থেকে একাধিক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। ইম্ফলে উন্মত্ত জনতা রাজপরিবারের সংরক্ষিত ‘কাংলা ফোর্ট’–সংলগ্ন ভবনগুলোয় অগ্নিসংযোগের চেষ্টা করেছে। স্থানীয় পুলিশ, আধাসামরিক বাহিনী ও সেনাবাহিনীর যৌথ কমান্ড অবশ্য কাঁদানে গ্যাসের শেল ও রাবার বুলেট ছুড়ে বিক্ষুব্ধ জনতাকে সরিয়ে দেয়। প্রাসাদ ও ভবনগুলো অক্ষত রয়েছে বলে জানানো হয়েছে।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ইম্ফল পশ্চিম জেলার ইরিংবাম থানায় হামলা হয়েছে। তবে কোনো অস্ত্র খোয়া যায়নি। চূড়াচাঁদপুর জেলার কাংভাই অঞ্চলে স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্র থেকে ধারাবাহিক গুলির শব্দ শোনা গেছে। বিষ্ণুপুর জেলার কয়াক্টা থেকেও গুলির শব্দ শোনা গেছে।

আরেক ঘটনায় ক্ষুব্ধ জনতা বিধানসভার বিজেপি বিধায়ক বিশ্বজিতের বাড়িতে আগুন দেওয়ার চেষ্টা করে। র‍্যাপিড অ্যাকশন ফোর্স অবশ্য জনতাকে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। গতকাল রাতে জনতা ইম্ফল পূর্ব জেলার সিনজেমাইতে বিজেপির কার্যালয় ঘেরাও করে। সেখান থেকেও জনতাকে সরিয়ে দেয়। একইভাবে গতকাল মধ্যরাতে ইম্ফলের পোরামপেটের কাছে বিজেপি (মহিলা) সভাপতি সারদা দেবীর বাড়িতেও দুষ্কৃতকারীরা ভাঙচুরের চেষ্টা চালায়। তাদেরও সরিয়ে দেওয়া হয়।

স্থানীয় সূত্র বলছে, গত ৩ মে সহিংসতা শুরুর পর ছয় সপ্তাহ চলে গেছে। মণিপুরের পরিস্থিতি এখন আরও জটিল হয়ে উঠেছে। সহিংসতা থামার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।

কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ও সাবেক সেনা কর্মকর্তা যা বলেছেন

বিজেপির কেন্দ্রীয় সরকারের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ও সংসদ সদস্য রাজকুমার রঞ্জন সিং ভারতীয় এক সংবাদ সংস্থাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, মণিপুর রাজ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার চেষ্টা সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার তাঁর বাড়িতে দ্বিতীয়বারের মতো হামলার পর তিনি বলেন, ‘এবার তৃতীয়বারের মতো আমার ওপর, আমার ছেলেমেয়ের ওপর হামলা হতে পারে। মণিপুরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে।

মণিপুরের বর্তমান সরকার পরিস্থিতি সামাল দিতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ। এ জন্যই কেন্দ্রীয় সরকারকে বিশাল বাহিনী পাঠাতে হয়েছে। আমি জানি না, কীভাবে রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যর্থ হলো।’
রাজকুমার রঞ্জন সিংয়ের ইম্ফলের বাড়িতে বৃহস্পতিবার রাতে দ্বিতীয়বার হামলার ঘটনা ঘটে। তবে ওই সময় মন্ত্রী বা তাঁর পরিবারের সদস্যরা বাড়িতে ছিলেন না।

প্রতিমন্ত্রীর পাশাপাশি মণিপুরে বসবাসকারী লে. জেনারেল (অব.) এল নিশিকান্ত সিং সামাজিক মাধ্যমে বলেছেন, ‘আমি মণিপুরের একজন সাধারণ ভারতীয়। রাজ্য এখন “রাষ্ট্রহীন”। লিবিয়া, লেবানন, নাইজেরিয়া, সিরিয়া প্রভৃতির মতো যেকোনো সময় এখানে জীবন ও সম্পদ ধ্বংস হতে পারে। মনে হচ্ছে, মণিপুরকে তার নিজের রসে চুবিয়ে মারা হচ্ছে। কেউ কি শুনছেন?’

দীর্ঘ ৪০ বছর সেনাবাহিনীতে ছিলেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল সিং, তিনি সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগেও কাজ করেছেন। ফলে স্বাভাবিকভাবেই তাঁর বক্তব্যকে গুরুত্ব দিচ্ছে প্রচারমাধ্যম ও নাগরিক সমাজ।

নিশিকান্ত সিং গোড়া থেকেই বলছেন, মণিপুরে পরিস্থিতি ক্রমে জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। তাঁর দাবি, মিয়ানামার থেকে ৩০০ জঙ্গি মণিপুরে ঢুকে জাতিগত দাঙ্গা ছড়াচ্ছে।

অবশ্য সাবেক এই সেনার দাবিটি ব্যক্তিগত ও বিতর্কিত। এ ধরনের দাবির ভিন্নমত মণিপুরে রয়েছে। মিয়ানামার থেকে উপজাতীয় জঙ্গি আসার দাবির সপক্ষে তিনি কোনো প্রমাণ দেননি।

ভারতের সেনাবাহিনীর সাবেক প্রধান জেনারেল ভি পি মালিক সামাজিক মাধ্যমে জেনারেল সিংয়ের বক্তব্য তুলে ধরে বলেছেন, ‘মণিপুর থেকে একজন অবসরপ্রাপ্ত লে. জেনারেলের একটি মন্তব্য অত্যন্ত দুঃখজনক। মণিপুরের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নে জরুরি ভিত্তিতে সর্বোচ্চ পর্যায়ের মনোযোগ প্রয়োজন।’

টুইটারের মন্তব্যে জেনারেল মালিক প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।

ভারতের নাগরিক সমাজের বড় অংশ মনে করছে, ভারত ধীরে ধীরে মণিপুরের ওপরে নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে, বিশেষত মিয়ানমারের সঙ্গে সীমান্তবর্তী অরণ্য-পাহাড় অঞ্চলে।